জীবনের উৎসব : সায়ন্তনী দাস ধর


 


         " ও মা...মা...মা...মুখুজ্জেদাদুর বাড়ি রং করা শুরু হয়ে গেছে।" তোতা লাফাতে লাফাতে বাড়িতে ঢোকে। 


অপর্ণা হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে, " তাই নাকি? পুজো তো প্রায় এসেই গেল...মুখুজ্জে মেসোমশাইয়ের ঘর এবার জমজমাট হতে চলল।" চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল অনিমেষ। সে বলল, " আরেক কাপ চা পাওয়া যাবে কি?"

" না দিলে কি তুমি ছাড়বে! বস, নিয়ে আসছি।" অপর্ণা আবার রান্নাঘরে যায়। তোতা বাবার গলা জড়িয়ে বলে ওঠে, " বাবা, এবারে কিন্তু পুজোর দিনগুলো আমি দাদুর বাড়িতেই কাটাব।" রান্নাঘর থেকে বলে অপর্ণা, " হ্যাঁ, তুমি ঐ কর। তা, রাতেও কি ফেরা হবে না?"

" সকলে মিলে কি মজাই না হয়, বল! সবাই একসাথে  থাকে, আর আমায় আড্ডা আসর ছেড়ে বাড়িতে চলে আসতে হয়! না, মা, এবারে কিন্তু আমি ওখানেই থাকব।"

অনিমেষ বলে, " আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। পুজো বলে কথা। অপু, তুমি আর আপত্তি কোরো না।"

তোতা মনে মনে ভারি খুশি হয়। বাবার 'অপু' ডাক মা এড়িয়ে যেতে পারবেই না। অপর্ণা বলে ওঠে, "ব্যস্, হয়ে গেল। বাবার অনুমতি পেয়ে গেলে, এখন আমার আপত্তি কি আর ধোপে টিকবে?"

"ইয়ে...এ...এ..." তোতা বাবার গলা জড়িয়ে চুমু খেয়ে রান্নাঘরে দৌড়ে গিয়ে মাকেও চকাস করে একটা চুমু খায়। তারপর সোজা নিজের ঘরে...বালিশটাকে বুকে জড়িয়ে সে ধপাস করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ততক্ষণে মন তার পাড়ি দিয়েছে টুবলু 'দার কাছে।

 

            মুখুজ্যেমশাই এ পাড়ার অনেক পুরোনো এক গণ্যমান্য ব্যক্তি। প্রতি বছর তাঁর বাড়িতে পুজো হয়। পুজোর সময়ে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ছেলে মেয়েরা বাড়িতে ফিরে আসে। তাঁর তিন ছেলে অমলকান্তি, বিমলকান্তি, শ্যামলকান্তি এবং এক মেয়ে অপরাজিতা। অমলকান্তির দুই ছেলে অনীক ও সৌপ্তিক। বিমলকান্তির ছেলে বিরুপাক্ষ, মেয়ে বৈদেহী। শ্যামলকান্তির মেয়ে তিয়াসা। আর অপরাজিতার ছেলে অরণ্য, মানে তোতার টুবলু 'দা। এই ছয়টি ভাইবোন একজায়গায় হলে মুখুজ্যেমশাইয়ের বাড়িতে আনন্দের হাট বসে যায়। এদের দলে যোগ দেয় মুখুজ্জেমশাইয়ের বড় স্নেহের পাত্র অনিমেষের মেয়ে তোতা যে কিনা আবার মুখুজ্জেদাদু বলতে অজ্ঞান! মুখুজ্যেমশাই তাকে আদর করে 'কচিগিন্নি' বলে ডাকেন। বিপদে আপদে অনিমেষই মুখুজ্যেমশাইয়ের ভরসা। মুখুজ্জেগিন্নিও অপর্ণাকে নিজের বউমাদের থেকে কোন অংশে কম ভালবাসেন না। দুটি পরিবারের মধ্যে ভারি সদ্ভাব। প্রতি বছর পুজোর দিনগুলো অনিমেষের পরিবারের কাটে মুখুজ্জেবাড়িতেই। খালি রাতটুকু তারা বাড়িতে ফেরে। সকলে মিলে একসাথে রান্নাবান্না, পুজোর জোগাড়...হইহই করে কটা দিন বড় আনন্দে কেটে যায়। 


        দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। মুখুজ্জেবাড়ি ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের নিয়ে জমজমাট। তোতাও মেতে উঠেছে তাদের সাথে। ওরা সকলে মিলে গেল ঠাকুর আনতে। মুখুজ্জেমশাইয়ের বড় বউমা অপালা হাঁক দেয়, "ওরে ও মেজো, নারকেলের পাকটা হল রে?"

" আর একটু বাকি বড়দি..." বলে মুখুজ্যেমশাইয়ের মেজোবউমা রঞ্জনা। 

অপালা মিষ্টি বানাচ্ছে। অপর্ণা বলে, "অপালাবৌদি, তুমি কিন্তু এবারে আমাকে মিষ্টি বানানো শিখিয়ে দেবে।"

" শেখাব রে শেখাব...ও ছোট, হাতটা একটু চটপট চালা বোন, সবজিগুলো কাটা হলে তারপর রান্না বসানো হবে। মধুর মা, মশলা বাটা হল?"

এ বাড়িতে অনেক বছর ধরে কাজ করে মধুর মা আর মালতি। মালতি বলে ওঠে, " বড়মামী, এত বাটনা বাটার ঝামেলা না করে গুঁড়ো মশলা দিতে পার!"

অপালা বলে, " হ্যাঁ, তোর বুদ্ধির বলিহারি! পুজো বাড়িতে রান্নাবান্না হবে বাজারের কেনা মশলা দিয়ে? ওতে স্বাদ আসে না। খাবারের স্বাদ বাড়ে বাটা মশলাতেই। নে নে, সবজি কাটা শেষ হল?"

আসরে প্রবেশ ঘটে মুখুজ্জেগিন্নির, " ও বড় বউমা, সব ঠিকঠাক আছে তো? তুমিই তো আমার ভরসা!" 

মুখুজ্যেমশাইয়ের ছোট বউমা সোহিনী অভিমানে বলে ওঠে, " ও! আমরা কেউ নই বুঝি? বড়দিই সব, তাই না?"

সকলে হেসে ফেলে। অপরাজিতা বলে, "ছোটবউদি, একদম ঠিক বলেছ। মা আমাদের সবার মধ্যে বড়বউদিকেই সবচেয়ে ভালবাসে।" 

রঞ্জনা বলে, " ঠিক ঠিক, আমরা সব মায়ের বেকার সন্তান!" 

অপর্ণা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে থাকে। অপালা বলে, " তোরা এবার মার খাবি কিন্তু। খালি সব উল্টোপাল্টা কথা বলে কাজে ফাঁকি দেওয়া! তাড়াতাড়ি কর বাবু!"

মুখুজ্জেগিন্নি তাঁর তিন বউমার চিবুকে হাত দিয়ে চুমো খান, প্রার্থনা করেন " চিরকাল সংসার এমন সুখের থাকুক, মা!" 


ওদিকে মুখুজ্যেমশাইয়ের নাতি নাতনিদের সঙ্গে তোতা বড্ড ব্যস্ত ঠাকুর দালান সাজাতে। কত কাজ পুজোর! তারই মধ্যে গোপনে তার অবাধ্য চোখ বারবার চলে যায় তার টুবলু'দার পানে। তার মন ভারি উচাটন, "টুবলু'দাও কি আমায় ভালবাসে?" আজকাল কোন কাজে মন বসে না তার। এ বছর কেন জানি টুবলু'দার চোখে দৃষ্টি মেলাতে ভারি লজ্জা পাচ্ছে সে। কিন্তু নিজের মনের কথা কিছুতেই সে বলতে পারবে না ওকে। ইস, সে ভারি লজ্জার ব্যাপার হবে! টুবলুর পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিতে দিতে শিহরিত হয় তোতার প্রাণমন। সকলের সঙ্গে গল্পে গল্পে বাঁধনহারা মুক্তির আনন্দে ভেসে গেলেও বিষন্নতার ছায়াও ছুঁয়ে যায় তোতার মনে। সকলের ফেরার সময় আগত। কিছুই কি বলা হবে না? আবার এক বছরের অপেক্ষা?


        সকলে মিলে ঠাকুর ভাসান দিয়ে আসে। প্রণাম করে সকলের কামনা, " পরের বছর তাড়াতাড়ি এস মা..." সবাই মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। টুবলু তোতাকে সিঁদুর মাখাতে গেলে তোতা এক ছুট্টে পালায়। টুবলুও তার পিছু নেয়। দুজনে ছুটতে ছুটতে ছাদে উঠে যায়। টুবলু তোতার হাত ধরে টানে। তাল সামলাতে না পেরে তোতা টুবলুর বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। টুবলু অজান্তেই তোতার সিঁথি রাঙিয়ে দেয়। তোতা স্তব্ধ। দুজনে দুজনের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে। কখন যে টুবলুর ঠোঁটের মধ্যে তোতা বন্দী হয়, কেউই বুঝতে পারে না। ওদের হুঁশ ফেরে রঞ্জনার চিৎকারে, "টুবলু, তোতা...ছিঃ!" তোতা ভয়ে লজ্জায় এক ছুটে নীচে নেমে যায়। 


         আনন্দে ভরপুর বাড়িটা এক লহমায় বদলে যায়। তর্ক বিতর্ক, কাদা ছোড়াছুড়ি, দোষারোপের পালা চলতেই থাকে। অপর্ণা মেয়েকে ঘরে আটকে রাখে। অপরাজিতা লজ্জায় ঘেন্নায় ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। অনিমেষের পরিবারের সঙ্গে মুখুজ্যে পরিবারের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। একদিন অনিমেষ দেখা করে অপরাজিতার সাথে," রাজি...."


বহু বছর পর অনিমেষের মুখে এই নাম শুনে আবেগে উদ্বেল হয় অপরাজিতা। অনিমেষ বলে, "ভালবাসা কি অন্যায়? একদিন তোকেই তো ভালবেসেছিলাম। সেদিন কোন রোজগার করতাম না বলে সাহসটা দেখাতে পারিনি। তুইও ভয়ে কাউকে কিছু বলতেই পারিস নি! আজ আমাদের ছেলে মেয়ে দুটোর মনে সেই একই অনুভূতি! আমরা কি পারি না ওদের স্বপ্ন পূরণ করতে?" 


অপরাজিতা কাঁদতে থাকে, বহু বছর আগেকার সেই অনুভূতির শোকে, তবে নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে এবার আর ভুল করে না। 


               দুই পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য আজ উধাও। টুবলু এখন মন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে এগোবে। অপেক্ষায় থাকবে তোতা।

Post a Comment

Previous Post Next Post