সকালবেলা অন্তুকাকু ব্রেকফাস্ট দিতে এলে সাচ্ছন্দ্য তার কাছ থেকে মোবাইলটা চেয়ে নিল। ব্রেকফাস্ট সেরে ঘরে গিয়ে সেই ফোনে গতকালের রহস্যময় ফোন নাম্বারটা তুলে নিয়ে ফোন করতেই ওপ্রান্ত থেকে এক নারী কন্ঠের মিষ্টিমধুর সাড়া এলো-"হ্যালো "। নারী কন্ঠ শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেও সাচ্ছন্দ্য নিজেকে সামলে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লো, -"কে মাসিমা...?"
ওপ্রান্ত থেকে উত্তর এলো,-" না, মা নাতিকে নিয়ে একটু বেড়িয়েছেন,আমাকে বলতে পারেন।"
-"আপনি...?"
-"আমি ওনার মেয়ে মল্লিকা।" নামটা শুনে সাচ্ছন্দ্য একটু চমকে উঠলো। এবারেও সামলে নিল নিজেকে। বললো,-"মল্লিকা.....ফ্রম বর্দ্ধমান....! আপনি কি বার বার কাউকে ফোন করেছেন কালকে?" সাচ্ছন্দ্য বেশ বুঝতে পারছে ওপ্রান্তের মেয়েটি বিভ্রান্ত আর অপ্রস্তুত। কোন উত্তর নেই তার মুখে। খানিক পরে উত্তর দিল,-"হ্যাঁ।"
-"শুনুন আমি সাচ্ছন্দ্য। কোথা থেকে কে আমাকে কালকে এতোবার ফোন করছে জানার জন্যে অন্তুকাকুর ফোন থেকে এই নাম্বারে ফোন করলাম। অবশ্য এইটুকু কৌশল করতেই হলো নাহলে আমার ফোন থেকে রিংব্যাক করলে হয়তো আপনি ফোনটা ধরতেন না।"
-"আপনি আমার মাকে চাইছিলেন,তাঁকে কি বলবেন বলছিলেন,সেটা আমাকে বলতে হবে না। মা এলে বলবো এই নাম্বারে ফোন করতে।" মল্লিকা কুন্ঠিত কন্ঠে বললো।
-"না আমি যখন ফোনটা করেছি,তখন,আপনি ফোনটা কাটবেন না। কাল কি বলতে চাইছিলেন বলুন।" সাচ্ছন্দ্যের কন্ঠে কঠোরতা ঝরে পরলো।
মল্লিকা আমতা আমতা করে কুন্ঠা মেশানো গলায় বললো -" আপনার কিছু পরামর্শ চাই..তাই দেখা করার ইচ্ছা ছিল।"
-"ছিল! গতকাল রাত পযর্ন্ত? আজ আর সেই ইচ্ছা নেই?" কিছুক্ষণের জন্য মল্লিকার তরফ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সাচ্ছন্দ্য বেশ বুঝতে পারলো মল্লিকা একটু ঘাবড়ে গেছে তাই সে এবার বলেই ফেল্লো,
--" কি হলো, কিছু বলছেন না যে?"
-"কি বলবো?" মল্লিকার ইতস্তত কন্ঠ।
-"ওই যে আজ আমার পরামর্শ নেওয়ার জন্য দেখা করার প্রয়োজনটা আর আছে কিনা..."
-"হ্যাঁ আছে। আপনি যদি বলেন আমি ওখানে মানে আপনাদের বাড়ি যেতে পারি।"
'আপনাদের বাড়ি'কথাটায় সাচ্ছন্দ্যের মনের মধ্যে যেন ঝড় তুললো। বহু প্রশ্ন তার মনে একসাথে জড়ো হলো, তাই এবারে বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা ছিল এপ্রান্তের। মল্লিকা এবার পাল্টা প্রশ্ন করলো,
-" কিছু বলছেন না যে!"
-"কি বলবো?"
-"আপনার কোন আপত্তি আছে কিনা।"
- "কি ব্যাপারে বলো তো?"সাচ্ছন্দ্য যে একটু অন্যমনষ্ক বেশ বোঝা গেল।
- -"আমি কি যাবো?"
-"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চিন্তে আসতে পারেন।'
-" তাহলে আজ তো ছুটি নিশ্চয়ই বাড়িতে থাকবেন? তিনটে নাগাদ যাবো?"
--"অবশ্যই।"
কলিংবেল বাজতে সাচ্ছন্দ্য দরজা খুলতেই একরাশ ফুলের গন্ধ যেন সে অনুভব করলো। যে কটা দিন মল্লিকা তার ঘরে ছিল সেই কটা দিন এইরকম ফুলের গন্ধ বাড়িময় ছড়িয়ে ছিল। সেই ছিপছিপে গরণ,সেই স্বর্ণোজ্জ্বল লাবণ্যেভরা মুখ। সাচ্ছন্দ্য ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল তারপরে উন্মুক্ত দরজার একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বললো-"আসুন।" মল্লিকা দরজার বাঁদিকে রাখা জুতোর আলমারিটার সামনে পায়ের চটিটা ছাড়লো।লাল নেলপলিশ পরা সেই সুন্দর পা দুখানা চেয়ে চেয়ে দেখলো সে। সেদিন এই পা দুখানা ছিল আলতায় রাঙানো। নম্র পায়ে ঘরে ঢুকে মল্লিকা দুটো সিঙ্গেল সিটের সোফার একটাতে বসলো। গতকালই হিসেব করে দেখেছে সাচ্ছন্দ্য,প্রায় তিন বছর আগে মল্লিকার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিল। প্রশ্ন করলো তাকে আনলে না? মল্লিকা বললো,-"কি হবে তাকে এনে?"
-"মানে?"
-"শুধু শুধু তার ওপর আপনার মায়া জন্মাক তা আমি চাই না।"
--"কি বলতে চাইছো একটু বুঝিয়ে বলবে প্লিজ।" সাচ্ছন্দ্যের কন্ঠে ধৈর্য্য চ্যুতির ইঙ্গিত।
-"কেন আমি তো বাবাকে সব বলেছিলাম।"
--"বাবা!কার বাবাকে?"
-"আপনার বাবাকে।" একটু ইতস্তত করে উত্তর দিল মল্লিকা।-"তিনি বলেন নি কিছু?"
--"তুমি জানোনা আমার বাবা দুবছর হয়ে গেল মারা গেছেন! ওঃ জানবেই বা কি করে অন্তুকাকু তো তোমাদের খবর দেয় নি।"
-"জানতাম না,তবে আজই জানলাম।"
হঠাৎ সাচ্ছন্দ উঠে পরলো,কিচেনে গিয়ে একটা ডিশে কিছু মিষ্টি আর জল এনে সেন্টার টেবিলে রেখে বললো,-"অনেক দূর থেকে এসেছো জল মিষ্টিটা খেয়ে নাও। কখন বেড়িয়েছো? লাঞ্চ করে আসনি বোধহয়?"
-"হ্যাঁ-হ্যাঁ এসেছি,আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।"
--"আসলে অন্ত কাকুকে বলা হয়নি তোমার আসার কথা। কাকু হঠাৎ জরুরি কাজ আছে বলে বেড়িয়ে গেল। ফ্রিজে দেখলাম ডিসে মিষ্টি সাজিয়ে রেখেছে...হয়তো ভেবেছে আজ ছুটির দিনে বাড়িতে কেউ আসতে পারে। জানতো,বাবা অন্তুকাকুকে এবাড়ির অভিভাবক বলতেন আমিও তাই বলি।"
ছেলেবেলায় মাকে হারানোর পর বাবা,দাদু আর অন্তুকাকুর কাছে সাচ্ছন্দ্যের বেড়ে ওঠা। দাদু প্রভাত লাহিড়ী স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসারে এক অনাথ ছেলেকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার মা-বাবা কয়লা খনির শ্রমিক ছিলেন।খনিতে ধ্বস নামার ফলে তাঁরা দুজনেই মারা যান। প্রভাতবাবু আসানসোলে অফিসের কোন কাজে গিয়েছিলেন। সদ্য অনাথ হওয়া ছেলেটা কোন কাজের সন্ধানে তাঁর সাথে কলকাতায় আসতে চেয়ে বলেছিল ওই অঞ্চলে থেকে কয়লাখনির কাজ সে কোনদিনও করবে না। প্রভাতবাবু নিজের ছেলের সমবয়সী ছোট্ট অনাথ অছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। ছেলে আকাশ একজন সঙ্গী পেল এই ভেবে গৃহকর্ত্রী অনুপমা খুব খুশী হয়েছিলেন। একবেলাতেই দুটি বালকের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ছেলে আকাশের সাথে ছেলেটাও সমান যত্ন আর আদর ভালোবাসা পেতে থাকে। অনুপমা আকাশের সাথে তাকেও পড়তে বসাতেন। অক্ষর পরিচয় হয়ে গেলে প্রভাতবাবু তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। স্কুলে দাদু ওর নাম অনন্ত লেখেন। সেই মতন বাড়িতে তাকে অন্তু নামে ডাকা শুরু হয়। পড়াশোনার চাপে অন্তুর দুষ্টুমি আর বকবকানিও কমতে থাকে। আকাশ চিরদিনই লেখাপড়ায় ভালো তার ওপর অন্তুকাকুর চাইতে উঁচু ক্লাসে পড়ত,তাই তার স্কুল ছিল দুপুরে আর অন্তুর স্কুল হতো সকালে। দিনের বেশীর ভাগ সময়ে একলা অনুপমাদেবীর কাছাকাছি তার সময় কাটতো। সুযোগ পেলেই জোড় আর বায়না করে গৃহিণীর সাথে সমস্ত কাজে হাত লাগাতো সে। ধীরে ধীরে দেখা গেল পড়াশোনার চাইতে ঘরকন্যার কাজেকর্মে তার আগ্রহ বেশী। অনেক কষ্টে তাকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো সম্ভব হয়েছিল। যদি কখনও অনুপমাদেবী অসুস্থ হতেন তাহলে অন্তু অসুস্থ গৃহিণীর কাছ থেকে রান্নার কায়দা জেনে জেনে রান্নাঘর সামলাতো। অনুপমাদেবী সুস্থ হলে আরও যা যা শেখার ইচ্ছে হতো সেগুলোও শেখার উৎসাহ চতুর্গুণ বৃদ্ধি পেতো। সুতরাং তাঁর মৃত্যুর পর গৃহকর্তা অন্তুর হাতে সম্পূর্নভাবে রান্নাঘরের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। শুধু রান্নাঘর নয় তাঁদের পরিবারের সমস্ত খুঁটিনাটি কাজে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। এছাড়া সকল পরামর্শে,সকল সিদ্ধান্তে সমস্ত আলোচনায় পরিবারের সদস্য হিসেবে অন্তুর মতামতকেও সমান ভাবে প্রাধান্য দেওয়া হতো।অন্তুকাকুর ব্যাপারে আজও সাচ্ছন্দ্য সেই ধারা বজায় রেখেছে।
সাচ্ছন্দ্য শুনেছে অন্তুকাকু লেখাপড়া সম্পূর্ণ করেনি বলে ঠাম্মীর ইচ্ছা ছিল একটুকরো জমি কিনে ওখানে অন্তুকাকুর জন্য একটা ছোটখাটো বাড়ি আর একটা দোকান ঘর তৈরি করা হবে। কিসের দোকান করবে সেটা ওকেই ঠিক করতে হবে।অন্তুকাকুর কিন্তু সেদিকে উৎসাহ ছিল না। বলতো,-"আমি না চাইতে আমার এই জীবনে তোমাদের কাছে যা পেয়েছি তাতেই খুশী,এবার আমার ধর্ম হলো তোমাদের সুখে রাখা।" ঠাম্মির ইচ্ছাপূরণের জন্য দাদু অন্তুকাকুর জন্য কাছাকাছি একটা একতলা বাড়ি আর দোকান ঘর করে বলে দিয়েছিলেন,-"আকাশের বিয়ে হলে বৌমা তখন এই সংসার সামলাবে। আর অন্তু বিয়ে করে নতুন বাড়িতেই সংসার বাঁধবে আর দোকান চালাবে। কার বৌ কেমন হবে জানিনা। পরবর্তী কালে দুই বৌয়ের জন্য সংসারে অশান্তি বা ঝামেলা হয় এমন রাস্তা খুলে না রাখাই ভালো।" অন্তুকাকুর বিয়ের মাসখানেকের মধ্যে সাচ্ছন্দ্য জন্মায় কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে নবজাতককে মাতৃহারা হতে হয়। সেই মাতৃহীন সংসারে দাদু বাবাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার শত অনুরোধ করেও কোন ফল পাননি। সেই থেকে মহিলাহীন এই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব অন্তুকাকু আবার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল কিন্তু কোনদিনও তার নিজের স্ত্রীকে এই পরিবারের কোন দায়িত্ব দেয়নি।
মহিলাবিহীন এই পরিবারে সাচ্ছন্দ্যের বেড়ে ওঠা। সুযোগ পেলেই ছেলেবেলা থেকে আজও অন্তুকাকু তার কাছে ওই স্নেহশীল দাদু আর স্নেহশীলা ঠাম্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গল্প বলার কায়দায় তাঁদের স্মৃতিচারণ করে।
দাদুর মৃত্যুর পর বাবা আর অন্তুকাকুর স্নেহের সংস্পর্শে সাচ্ছন্দ্যর জীবনটা ছিল সম্পূর্ণ মসৃণ। তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বাবা আর কাকুর শখ ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মহিলাহীন সংসারে পুত্রবধূ আনার। চাকরী জীবনে পা দেওয়ার সাথে সাথে তাঁদের বাসনা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছিল তাই তাঁদের ইচ্ছাকে সমর্থন করে মাত্র তেইশ বছর বয়সে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। ঘটকের কথায় বাবা আর অন্তুকাকু তড়িঘড়ি মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন বর্দ্ধমানে। বলে গিয়েছিলেন মেয়ে পছন্দ হলে আজই মেয়েকে আশীর্বাদ করে বিয়ের দিন ঠিক করে আসবেন। মল্লিকার মতন সুন্দরী, অল্পবয়সী মেয়েটাকে অপছন্দ করার কোন কারণই ছিল না সুতরাং যেকথা সেই কাজ তাঁরা করলেন। বধূবরণে উদগ্রীব দুই পিতা বিয়ের দিন স্থির করতে কোন দেরী করেননি। সাত দিনের মধ্যে এই দু'জন অভিভাবক উঠে পরে তাঁদের মনের মতন করে বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠেছিলেন। এই প্রথম অন্তুকাকুর স্ত্রী কয়েকজন বিবাহিতা মহিলাকে সঙ্গে করে এই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিল।
মিষ্টি ফুলের গন্ধ মেখে নববধূ বেশে মল্লিকা এই বাড়িতে যেদিন এসেছিল বাবাকে নতুন রূপে দেখেছিল সাচ্ছন্দ্য। বাবা মল্লিকাকে যেন এই বাড়ির প্রতিটি কোণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আর প্রতিবারই 'তোমার শাশুড়ী মা থাকলে আমাকে এসব করতে হতো না। "এই কথাটা ব্যবহার করছিলেন। সাচ্ছন্দ্য বাবার চোখের কোণে দেখতে পেয়েছিল চকচকে জলের বিন্দু। তার এতদিনের জীবনে বাবাকে কক্ষনো মৃতা স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করতে দেখেনি সে। অতি নম্র অথচ উচ্ছল প্রকৃতির মেয়ে মল্লিকাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিল সাচ্ছন্দ্য। বাবা কখনও ডাইনিং টেবিলে,কখনও ড্রইং রুমে কখনো স্টাডি রুম থেকে অথবা ব্যালকনি থেকে হাঁক দিতেন -"বৌমা"। পায়ের নুপূর, অঙ্গের অলঙ্কারের মিষ্টি তরঙ্গ তুলে একরাশ ফুল আর এসেন্সের গন্ধ মেখে রঙিন নতুন শাড়ির আঁচল তুলে মাথায় আলতো ঘোমটা টানতে টানতে হাসিমুখে মল্লিকা পৌঁছে যেতো বাবার সামনে। মল্লিকা যে এ সংসারকে কয়েকদিনের মধ্যে আপন করে নিয়েছে তার ঠোঁটের কোণের সাবলীল মিষ্টি হাসিতে তা প্রকাশ পেতো। অষ্টমঙ্গলা করতে যাওয়ার দিনও সাচ্ছন্দ্য বাবা আর মল্লিকার চোখের কোণ জলে ভিজে উঠতে দেখেছিল। শ্বশুর বাড়িতে দুদিন কাটিয়ে ফিরে আসার সময় কি কারণে যে শাশুড়িমা মল্লিকাকে তার সাথে বাড়ি ফিরতে দিলেন না এ প্রশ্নের উত্তর আজও তার কাছে অজানাই রয়ে গেছে। বাড়িতে তাকে একলা ফিরতে দেখে বাবা আর অন্তুকাকু দুজনের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল। সাচ্ছন্দ্যের পক্ষে মল্লিকার না ফিরে আসার কোন সংগত উত্তর দেওয়া সম্ভবও ছিল না। আকাশ বাবু বেয়ানকে ফোন করে সাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মল্লিকার না ফেরার কারণ জানতে চাইলে সুমিত্রাদবী অর্থাৎ মল্লিকার মা অত্যন্ত মিষ্টস্বরে জানিয়েছিলেন মল্লিকার শরীরটা ভালো নেই। সে সুস্থ হলে তিনি স্বয়ং তাকে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেবেন। সাময়িক ভাবে নিশ্চন্ত হলেও বৌমার শরীর খারাপের ভাবনাটা কিছুতেই আকাশবাবুকে নিশ্চন্তে থাকতে দিচ্ছিল না। তিনি প্রায় প্রতিদিন বেয়ানকে ফোন করে মল্লিকার শারীরিক সুস্থতার খবর জানতে থাকেন। সুমিত্রাদেবীর নিয়মিত একই উত্তরে অন্তু এবং আকাশবাবু দুজনেই বিচলিত হয়ে পরেছিলেন। একদিন অন্তুর সঙ্গে পরামর্শ করে আকাশ বাবু বর্দ্ধমানে চলে যান। সুমিত্রাদেবী তাঁকে যত্নসহকারে আপ্যায়ন করে মিষ্টিমুখ করিয়ে জানান তাঁর পুত্রবধূ এখন সন্তানসম্ভবা সুতরাং তাকে তিনি এখন কাছ ছাড়া করতে চাননা। সেদিন মহাআনন্দে বাক্স ভরে বর্দ্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা কিনে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। সপ্তাহ শেষে ছুটির দিন দেখে সাচ্ছন্দ্যেকে তার স্ত্রীর খবরাখবর নেওয়ার জন্য জোর করে বর্দ্ধমানে পাঠিয়েছিলেন। মল্লিকা তার মাসীর বাড়ি গিয়েছিল,সেকারণে মল্লিকার সাথে দেখা না করেই সাচ্ছন্দ্য বাড়ি ফিরে এসেছিল। এরপর সাচ্ছন্দ্য আবার একদিন বর্দ্ধমান গিয়েছিল। অনেকদিন হলো মল্লিকার সঙ্গে দেখা বা কথা হয়নি। নিজের একটা ফোন থাকলে মল্লিকার সরাসরি তার সাথে কথা বলার সুবিধা হবে এই ভেবে যাওয়ার পথে সঙ্গে করে একটা ফোন কিনে নিয়ে গিয়েছিল।। কিন্তু তার মনোবাসনা সফল হলোনা।সুমিত্রাদেবী বা মল্লিকা কেউ সেদিন বাড়ি ছিলেন না ছিলেন মল্লিকার বাবা সুধাংশুবাবু। তিনি জানিয়েছিলেন মল্লিকা তার মায়ের সাথে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গেছে। সাচ্ছন্দ্য মল্লিকার জন্য কেনা ফোনটা তাঁর হাতে দিয়ে এসেছিল। এবারও ছেলের সাথে বৌমার দেখা হয়নি শুনে আকাশবাবুর মনোকষ্ট হলেও বলেছিলেন,-" পরের বার কলকাতায় কবে ডাক্তার দেখাতে আসবে জেনে নিস। আমার মনে হয় স্বামী হিসেবে স্ত্রীর ডাক্তার চেকআপের দিন তোর বৌমার পাশে থাকা উচিৎ।" কিন্তু এবারেও বাদ সাধলেন ভদ্রমহিলা। বললেন,-"ওর যা শরীরের অবস্থা ভাবছি আর কলকাতায় নিয়ে যাবোনা, এখানেই হাসপতালের কার্ড করে দেবো। তুমি ওসব বুঝবেনা বাবা। তা ছাড়া ডাক্তারি চেকআপ ছুটির দিনেও হয়না। অফিস কামাই করে তোমাকে আসতে হবে না আমি ঠিক মেকআপ করে নেবো। আর শোনো, ওকে ফোন করে বিরক্ত করবে না, তুমি হয়তো জানোনা পোয়াতি মেয়েদের এ সময় ওই সব ফোন ধরতে নেই।" তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বিরক্ত মিশ্রিত গলায় তিনি বলেছিলেন,-"কারা এই সময় ফোন ব্যাবহার করে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার মেয়ে এই সময় ফোনে কথা বলুক তা আমি কিন্তু চাই না।" সেদিন সুমিত্রাদেবীর এই রকম রূঢ় আচরণ সাচ্ছন্দ্যকে আঘাত দিয়েছিল তবে সেই কথা সে বাবা বা অন্তুকাকু কাউকেই বলেনি। মাস খানেক পর বাবা আবার ফোন করেছিলেন সেদিন সুমিত্রাদেবী জানিয়েছিলেন মল্লিকার একটা ছেলে হয়েছে। সঠিক তারিখের আগেই জন্মেছে তাই ডাক্তারবাবু মা আর ছেলেকে একটু সাবধানে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
লাহিড়ী পরিবারে কোনদিন কোন জটিলতা ছিল না।এই স্বচ্ছ পরিবারের মানুষের মানসিকতাও ভারি স্বচ্ছ। বহুদিন মহিলা সংসর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন এই পরিবারে মহিলা জড়িত অনেক সমস্যা বা অসুবিধার কথা অজানা। এই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করছিলেন সুমিত্রাদেবী একথা কারোও মাথায় আসেনি। তাই নাতির মুখ দেখার উৎসাহ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক উপহার নিয়ে আকাশবাবু যখন বর্দ্ধমান গিয়েছিলেন সুমিত্রাদেবী তাঁকে আশাহত করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন মা আর বাচ্চা দুজনেই আঁতুর ঘরে আর তাদের কোন রকম ইনফেকশন হোক সেটা তিনি চাননা। বাধ্য হয়ে আকাশ সুমিত্রাদেবীর হাতে নাতির মুখ দেখার জন্য নিয়ে যাওয়া সোনার চেন,বালা,আঙটি আর সমস্ত উপহারসামগ্রী তুলে দিয়ে ফিরে এসেছিলেন। নাতি যাতে সুস্থ থাকে এই মনোষ্কামনা নিয়ে তিনি সাধারণ ভাবেই ছেলেকেও শ্বশুরবাড়ি যেতে বারণ করেছিলেন। মাসদুয়েক কাটার পর আকাশ বাবু নাতির মুখেভাতের দিন নির্ধারণ করার জন্য অন্তুকে সঙ্গে নিয়ে বর্দ্ধমানে গিয়েছিলেন। । সেদিন তাঁদের ফিরতে রাত হয়েছিল। সাচ্ছন্দ্য সে সময় অফিসের জরুরি অনলাইন মিটিংএ ব্যস্ত ছিল। সুতরাং বাবার কাছে বর্দ্ধমানের খবর জানা সম্ভব হয়নি। পরেরদিন সকালে বাবাকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে না দেখে অবাক হয়েছিল। অন্তুকাকুকে প্রশ্ন করলে সে ব্যস্ত হয়ে অন্য কাজে চলে গিয়েছিল । সাচ্ছন্দ্য বাবার ঘরে গিয়ে দেখেছিল বাবা ঘরের আরামকেদারায় চুপটি করে বসে আছেন। বাবার কপাল স্পর্শ করে সে জানতে চেয়েছিল শরীর খারাপ কিনা।আকাশবাবু ছেলের হাত দুটো ধরে বলেছিলেন,-"বাবা তুমি কখনো তোমার স্ত্রী বা তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না, মনে রেখো এইটুকুই আমার আব্দার। তবে আমি জানি তুমি না গেলেও বৌমা একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।" দিন কয়েকের মধ্যে আকাশবাবু সেলিব্রাল এ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন। সেদিন বর্দ্ধমান থেকে তিনি বা অন্তুকাকু কি এমন মনোকষ্ট নিয়ে ফিরে এসেছিলেন তা আজও সাচ্ছন্দ্যের কাছে রহস্যময়।
সেদিন বিবাহের পক্ষে অনুপযুক্ত বয়সের সাচ্ছন্দ্য আজও সমানভাবে সাংসারিক ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। আজ ছাব্বিশ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে সরাসরি মল্লিকার মুখের দিকে তাকালো সে।
-"প্রকৃতভাবে বাবা চেয়েছিলেন এই সংসারের ভার একজন অভিভাবিকার হাতে তুলে দিতে। মায়ের মৃত্যু আমার জন্মকালে। তবু আমার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। তিনি অনেক সাধ করে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু কি দুর্ভাগ্য! আমার স্ত্রী তাঁর বাসনাকে অপূর্ণ রেখে অযৌক্তিকভাবে এই সংসার ছেড়ে চলে গেল! মল্লিকা,বলতে পারো কি অপরাধ ছিল তাঁর যে নিজের নাতিকেও কোলে তুলে আদর করতে পারলেন না!"
মল্লিকা ছলো ছলো চোখে বললো,-"না সব অপরাধ আমার ছিল, আজও আপনার কাছে আমি অপরাধী। তবে আমি বাবার কাছে আমার সব দোষ স্বীকার করেছিলাম। জানিনা তিনি আপনাকে কিছু বলেছিলেন কিনা।"
-"কি বলেছিলে তুমি আমি কি জানতে পারি?"রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করলো সাচ্ছন্দ্য।
-"বলতে পারি, কিন্তু আমার বলতে ভালো লাগবে না...সেই স্মৃতি আমি ভুলে যেতে চাই।"মল্লিকার দুচোখে জলের ধারা।
সাচ্ছন্দ্য অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে রইলো! কি এমন দুঃখজনক স্মৃতি এই মেয়েটা তার নরম মনের ভেতরে আড়াল করে রাখতে চায় !! সাচ্ছন্দ্য বললো,-"থাক বলতে হবে না..তোমাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি মল্লিকা। প্লিজ চোখের জল মোছো। আমার সঙ্গে তোমার কি পরামর্শ করার আছে বলো।" হাতের চেটোর উল্টোদিক দিয়ে বাচ্ছাদের মতন চোখ মুছতে মুছতে হেসে ফেল্লো মল্লিকা,
--"বাঃ! আমি যদি না বলি তাহলে আপনার পরামর্শ আমি কি করে পাবো! আপনার পরামর্শ নিতে হলে আমাকে যে সবটা বলতেই হবে।"সাচ্ছন্দ্য বিস্ময়ভরে মল্লিকাকে পর্যবেক্ষণ করছিল....তার সেই মিষ্টি বৌটা আজও মিষ্টি হাসে! আজও তার কথার স্বরে জলতরঙ্গ বাজে। নিজের বৌটাকে এতো অচেনা লাগে,পরমুহূর্তে যেনো বড্ড চেনা মনে হয়। সাচ্ছন্দ্যকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু ধমকের সুরে মল্লিকা বলে,-"কই বসুন।আমি বলতে শুরু করি নাহলে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। অতো দেরী করতে পারবো না,আমাকে বেড়োতে হবে...কই বসুন।"সাচ্ছন্দ্য সোফায় বসে পরে।
-"আমি নিতান্তই সাধারণ পরিবারের সাধারণ মেয়ে। বাবা সামান্য কেরানি। সম্পত্তি বলতে ঠাকুরদাদার বাড়িটা। তার তিনটে ঘর। আমরা থাকতাম একটা ঘরে। বাইরের ঘরটা বসার ঘর আর ছিল একটা ঘর, যেখানে মা ইউনিভার্সিটির চারজন ছাত্রের পেইংগেস্ট হিসেবে থাকার মতন ব্যবস্থা করেছিলেন। এটা ছিল আমাদের বাড়ির বারতি আয়। একবার ইউনিভার্সিটির এক প্রাক্তন ছাত্র এসে কয়েকদিনের জন্য পেইংগেস্ট হিসেবে থাকতে চাইলো। কোনো সিট খালি ছিলনা। ছেলেটা জানালো সে বিদেশে চাকরি পেয়েছে, দিন কয়েকের মধ্যে বিদেশে চলে যাবে , কিন্তু চাকরির জন্য কলেজ থেকে কিছু সার্টিফিকেট নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে বর্দ্ধমানে কিছুদিন থাকতে হবে, তাই একটা ঘরের খুব দরকার। মা তাকে বললেন পুরো একমাসের দুজন থাকার খরচ এ্যাডভানস্ দিলে হয়তো কয়েকদিনের জন্য তাকে পেইংগেস্ট হিসেবে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। ছেলেটি রাজি হয়। মা তাকে আমাদের শোওয়ার ঘরটা ছেড়ে দেন আর আমরা বসার ঘরকে শোওয়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতে থাকি। মা ছেলেটার খাবার দেওয়ার জন্য আমাকে পাঠাতেন। দিন সাতেকের মধ্যে তার কাজ শেষ হয় কিন্তু শেষ দিন প্রচন্ড জ্বর নিয়ে ছেলেটা ফিরলে মা ব্যস্ত হয়ে ওষুধ-পত্র দেন। তাতেও জ্বর না কমায় সারারাত জল পটি দিয়ে তার জ্বর নামানোর চেষ্টা করেন। পরেরদিন দুপুরে বাবা অফিস গেলে, স্টুডেন্টদের খাইয়ে দাইয়ে মা মাসকাবারি করতে যাওয়ার সময় আমায় ছেলেটার খেয়াল রাখার নির্দেশ দিয়ে যান। আমি মাঝে মাঝে ওই ঘরে উঁকি মেরে দেখেছিলাম, ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। শেষবার উঁকি মারতে গিয়ে দেখি সে বিছানায় বসে আছে। আমি জানতে চাইলাম ,-"কেমন আছো?" বললো-" জল খাবো।" জল দেওয়ার সময় বল্লাম,-" মা দোকানে গেছেন এক্ষুণি ফিরবেন।"বললো,-" বড্ড মাথা ধরেছে একটু টিপে দেবে?" ভাবলাম সত্যি মাথার যন্ত্রনায় কষ্ট পাচ্ছ বুঝি! তাই তার কপালে বাম লাগাতে গেলাম। ছেলেটা হঠাৎ আমাকে তার বুকের ওপর টেনে নিয়ে শক্ত করে জাপটে ধরলো। আমি ছাড়াতে চেষ্টা করলাম.... ছাড়াতে পারলাম না...আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখলাম মা আমার চোখে মুখে জল ছিটোচ্ছে। আমার কাছ থেকে সব শুনে বললেন,-"হুম, বুঝতে পারছি, অমনটা করে ছেলেটা ভয় পেয়ে পালিয়েছে।" আমার সমস্ত শরীরে যন্ত্রণা করছিল,খুব কান্না পাচ্ছিল...খুব কাঁদছিলামও। মা ছেলেটাকে ফোন করে দেখলেন তার ফোনের সুইচড অফ। কয়েকদিন পর ছেলেটা মাকে যে কলকতার বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিল অনেক খুঁজে মা ওই বাড়িতেও গিয়েছিলেন। আসলে ছেলেটা ভুল ঠিকানা দিয়েছিল। মা বললেন,-" এতদিনে হয়তো ছেলেটা বিদেশে চলে গেছে। ভেবেছিলাম তোর সাথে ছেলেটার বিয়ে দিয়ে দেবো।" মায়ের এই কথাটায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আজ মনে হয় মা ইচ্ছে করে আমাকে ছেলেটার ঘরে তার খাবার দিতে পাঠাতেন। হয়তো তাঁর এমন ছেলেক জামাই করার সাধ ছিল। যাই হোক, একদিন কি হয়েছিল আমার মনে নেই যখন চোখ খুললাম ডাক্তার বাবুকে বেড়িয়ে যেতে দেখলাম। মা বল্লেন,আমি নাকি জ্ঞান হারিয়ে পরে গিয়েছিলাম। এখন ভালো আছি। পরের দিন থেকে হঠাৎ করে বাড়িতে ঘটকের আসা যাওয়া শুরু হলো। তারপর হঠাৎ একদিন আপনার বাবা আর কাকু আমাকে পছন্দ করে আশীর্বাদ করে গেলেন। আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আপনাদের পরিবারে আমি যে কটাদিন ছিলাম বেশ সুখে আর আনন্দে ছিলাম। মনে হয়েছিল আমি অনেকদিন আপনাদের সঙ্গে বাস করেছি...এই পরিবারকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। অষ্টমঙ্গলায় যাওয়ার পর মা কিছুতেই আমাকে আপনার সঙ্গে ফিরতে দিলেন না।আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ঘুম ভাঙলে বাইরের ঘরে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। মা তখন ফোন কানে মাসীর সাথে কথা বলছিলেন। কথাগুলো আমাকে নিয়ে। আগে বুঝতে পারিনি। সেইদিনের ঘটনায় নাকি আমার পেটে ছেলেটার সন্তান এসেছিল। আমি অজ্ঞান হওয়ার দিন মা সেটা বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি আমার বিয়ের জন্য ঘটক ডেকেছিলেন। আর তাঁর ভাগ্য ভালো আমার এমন পরিবারে বিয়ে হয়েছে যেখানে শাশুড়ি বা ননদের বালাই নেই, ফলে আমার
গোপন করা মেয়েলি রহস্য ধরা পরার সম্ভাবনাও নেই। আমাকে আপনার সাথে এখানে ফিরতে না দেওয়ার কারণ হিসেবে মা মাসীকে বললেন,-"ভাবছি, এই ফাঁকে একবার ডাক্তার দেখিয়ে মলির পেটের বাচ্ছাটাকে নষ্ট করার ব্যবস্হা করবো।" বিশ্বাস করুন,আড়াল থেকে মায়ের কথাগুলো শুনে সেই প্রথম আমি অনুভব করলাম আমার শরীরে আর একজনের বেড়ে ওঠা। মনে হলো সে যেন পরম নিশ্চিন্তে এই পৃথিবীর আলো দেখার প্রহর গুণছে। সাবধান হলাম। বাচ্ছাটাকে যেন মা নষ্ট করার কোনো সুযোগ না পায়। মাকে জানালাম আমি মা আর মাসীর ফোনের কথপোকথন শুনে ফেলেছি। মা বল্লেন,-"বেশ তুমি এখানেই থাকো,বাচ্ছার জন্ম হলে তোমার শ্বশুরবাড়িতে জানাবো যে সঠিক মাসের আগেই বাচ্ছা জন্মে গেছে। তারপর তুমি বাচ্ছা নিয়ে শশুর বাড়ি ফিরো। তবে এ বাচ্ছাটা যে তাদের পরিবারের কেউ নয় তা বলা চলবে না।" তখনকার মতন মায়ের কথা মেনে নিয়ে বাচ্ছা নষ্ট করার পথ বন্ধ করলাম। একবার ভেবেছিলাম আপনাকে সবটা বলি কিন্তু মা কিছুতেই সেই সুযোগ আর সন্মতি আমাকে দিচ্ছিলেন না। ডাক্তারের বলে দেওয়া সঠিক তারিখেই আমি মা হলাম।
আপনার বাবা কিংবা আপনাদের ঠকানোর ইচ্ছা আমার কোনদিনও ছিলো না। বাবা যেদিন শেষবার আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন সেদিন আমার সন্তানকে কোলে নিতে চাইলেন। ছেলেকে বাবার কোলে দিয়ে আমি বলেছিলাম যে,
-"এই বাচ্ছাটা আসলে আপনাদের পরিবারের কেউ নয়। তাই একে আপনাদের পরিবারের সন্তান এই মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার আর ওখানে ফেরা হবেনা। আবার আমার পক্ষে একা আপনাদের সংসালে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। যে সন্তানকে পেটে থাকতে মারতে পারিনি, জন্ম দিয়ে তাকে ছেড়ে থাকবো কি করে! আপনারা বরং একটা ভালো মেয়ের সাথে ছেলের আবার বিয়ে দিন।" বাবা কোন উত্তর দেন নি। ছেলেকে একবার বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে আমার কোলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অন্তুকাকু বলেছিলেন,-"যার বাবা যৌবনকালে পত্নীবিয়োগ ঘটা সত্বেও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি তার ছেলে কি করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে! "
সাচ্ছন্দ্য মল্লিকার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে তার কথাগুলো মগ্ন হয়ে শুনছিল এতক্ষণ। মল্লিকা নীরব হলেও সেইভাবেই বসে রইল সে। নিজের মাকে কোনোদিনও দেখেনি সে। জ্ঞানত মায়ের অভাব কোনদিনও সে অনুভব করেনি। বাবা, দাদু, অন্তুকাকুকে নিয়েই তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। ছেলেবেলা থেকেই মাতৃহারা সাচ্ছন্দ্যের জন্য অনেকের চোখেই সে সমবেদনা দেখেছে। তাদের সেই অনুভূতি তার মনে কোনদিনও মায়ের অভাবকে জাগিয়ে তুলতে পারেনি। এতোদিন গল্প, উপন্যাসে পড়ে বা সিনেমায় দেখে 'মা'সম্পর্কে তার একটু ধারণা ছিল। আজ এই প্রথম মল্লিকার বর্ণনায় মাতৃত্বের বাস্তব অনুভূতিগুলো সে যেন অন্তর থেকে অনুভব করলো। ছেলেবেলায় এই মহিলাহীন পরিবারে বাস্তবিকভাবে কোন নারীর সংস্পর্শ পায়নি সে। মল্লিকা তার জীবনে এসেছিল ঝড়ের মতন কয়েকদিনের অতিথি হয়ে। প্রবল ঝড়ের দাপটে তার নিরিবিলি জীবনের আমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফিরে গিয়েছিল সে। সেই সরল সিধাসিধে মেয়েটার কাছে সেদিন তার গর্ভস্থ সন্তানের খবর ছিল অজানা,তাই নির্ভাবনায় সে এই পরিবারের আপনজন হয়ে ওঠার ব্যাপারে ছিল যত্নশীল। যেদিন গর্ভস্থ সন্তানের সাথে তার পরিচয় ঘটেছিল সেদিন থেকে তার মাতৃসত্বা তাকে শক্তিশালীনি করে তুলেছিল। আজ বুঝতে পারছে সাচ্ছন্দ্য,মাতসত্বার জোরেই সেদিন তার বাবার কাছে মল্লিকা বিনা দ্বিধায় তার অকপট স্বীকারোক্তি বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিল। বাবা হয়তো প্রথমদিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফিরে এসেছিলেন কিন্তু তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে তুলেছিল। তাঁর শরীরে এই আঘাত সইবার ক্ষমতা ছিলনা,তাই, তাঁকে হয়তো অসময় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। যাওয়ার আগে তাই তার হাতদুটি ধরে বাবা বলেছিলেন,-"খোকা, তুমি কখনো তোমার স্ত্রী বা তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না মনে রেখো এইটুকুই আমার আব্দার। তবে আমি জানি তুমি না গেলেও বৌমা একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।"
অনেকক্ষণ সাচ্ছন্দ্যের পলকহীন দৃষ্টির সামনে বসে থেকে মল্লিকা অস্বস্তি বোধ করছিল। বললো, ,-"সব ঘটনা আপনাকে সবিস্তারে বললাম।"
-"হুম! বলো এবার আমায় কি করতে হবে।" সাচ্ছন্দ্যর উদ্বেগহীন প্রশ্নে মল্লিকা দ্বিধাগ্রস্ত। বললো,
-" আপনাকে আমি ইচ্ছা করে ঠকাতে চাইনি, বিশ্বাস করুন। জানলে আমি...."
-জানলে কি করতে মল্লিকা! বিয়ে করতে না তাইতো? কিন্তু বিয়েতো করে ফেলেছো মল্লিকা।"
-"জানলে হয়তো সত্যি করতাম না কিংবা বিয়ের আগেই আপনাদের সমস্ত জানাতাম।"
--"হুম তাহলে বিয়ের দায়টা তোমার নয় তাই বলতে চাইছো তো?" সাচ্ছন্দ্য যে কখনও এতোটা রূঢ় হতে পারে এমন বিশ্বাস তার নিজেরই ছিলনা কোনদিন।মল্লিকা খানিক নীরব থেকে বললো,-"মা-বাবা সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন, তাঁরা
হয়তো ভেবেছিলেন,সকলের কাছে গোপন রেখে হঠাৎ ঘটা দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত মেয়েকে যদি জীবনে সুখী করা যায়...! কিন্তু আমার বিবেক তাতে সায় দেয়নি। আমি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম ঠিকই তবে জ্ঞানত নয়, এমন কি আমার মা হওয়ার সংবাদটাও আমার সংজ্ঞাহীন অবস্থার জন্য সঠিক সময় জানা সম্ভব হয়নি। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন তাঁরা। তবে যখনই আমি জানতে পেরেছিলাম তখনই মা হয়ে গর্ভস্থ সন্তানকে রক্ষা করার সাথে সাথে স্ত্রী হয়ে স্বামী আর তাঁর সংসারকে এই অনৈতিক অন্যায়ের দায়ভার থেকে রক্ষা করার প্রবল দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আমি সজাগ হয়েছিলাম। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, তবে সেই দিনগুলোতে আমার মনে হচ্ছিল আমি এক শত্রুপুরীতে বাস করছি! যাঁরা স্বার্থপরের মতন কেবল নিজেদের মান-সন্মান আর নিজেদের সন্তানের সুখের জন্য সুযোগ পেলেই আমার গর্ভস্থ সন্তানকে মেরে ফেলতে পারেন অথবা আমার শান্তিপ্রিয় শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোকে ঠকাতে দুবার ভাববেন না। সে সময় আমার মনে হয়েছিল আপনি আমার জীবনসঙ্গী। আপনার কাছে ছুটে চলে আসি। এসে আমার সব কথা খুলে বলি আর সেইসঙ্গে আপনার কাছে আমার সন্তানের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় ভিক্ষা করি। কিন্তু আমার মায়ের কঠোর পাহারা আমাকে সেই সুযোগ দেয় নি..। দিনে দিনে শরীরটাও ভারী হয়ে উঠছিল। শেষ পযর্ন্ত সন্তানকে কোলে নিয়ে বুঝলাম প্রথম বিপদ আমি কাটিয়ে উঠেছি। তাই দ্বিতীয় বিপদ ঘটার আগেই বাবার কাছে সব কথা স্বীকার করেছিলাম।"
-"বাবা সব শুনে কি বলেছিলেন?"মল্লিকার বর্ণনায় একবার শুনলেও আরও একবার জানতে চাইলো সাচ্ছন্দ্য।
-"বাবা ছেলেকে বুকের মধ্যে কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তারপর আমার কোলে তাকে দিয়ে উঠে এসেছিলেন। আমি তাঁর চোখের কোলে জল দেখেছিলাম।"
সাচ্ছন্দ্য অবাক হয়ে শুনছিল। সে যেন 'মা' আর 'নারী' চরিত্রের অজানা অনেক তথ্য ধীরে ধীরে বোঝার চেষ্টা করছে।
-"আমার পক্ষে আর বেশীক্ষণ থাকা সম্ভব হবে না।আমাকে এখুনি ফিরতে হবে। নইলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। "হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মল্লিকা ব্যস্ত হলো।
-"তাহলে সংক্ষেপে বলো আজ আমার কাছে কিসের পরামর্শ নেওয়ার জন্য ছুটে এসেছো?" সাচ্ছন্দ্য উঠে দাঁড়িয়ে সেন্টার টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা থুলে নিয়ে মল্লিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,-"অনেকক্ষণ কথা বলেছো,এবার একটু জল আর মিষ্টি খেয়ে তারপর জরুরি কথাটা বলো। মল্লিকা জলের গ্লাসটা তার হাত থেকে নিয়ে ঢকঢক করে জলটা শেষ করে বললো,
-"আমার ছেলের স্কুলে ভর্তি করার সময় আসছে।আপনি এখনো আমার স্বামী, সেই হিসেবে আমার সন্তানের বাবার নামের জায়গায় আপনার নামের ব্যবহার হোক সেটা আমি মানতে পারছি না। কোন শিশুর শিক্ষা জীবনের প্রথম পদক্ষেপ মিথ্যা পরিচয় নিয়ে হোক এটা কি আপনি মানতে পারেন?"
-"পারিনা, কিন্তু এই ঘটনায় শিশুটার কি দোষ বলতে পারো?"
-"নাঃ! শিশু পবিত্র তা মানি কিন্তু তার মা তো অপবিত্র।"
চমকে উঠলো সাচ্ছন্দ্য। ভালো করে মল্লিকাকে দেখলো এমন সৎ আর আত্মবিশ্বাসী মেয়ে কি করে অপবিত্র হতে পারে! -"নাঃ! তুমি কখনো অপবিত্র নও মল্লিকা।"স্বগোক্তি করলো সে। মল্লিকা বললো,
-"সবচাইতে ভালো উপায় হলো আপনার আমাকে ডিভোর্স করে দেওয়া। আমি তো আপনার বা আপনার পরিবারের কোন কাজে লাগছি না,তাহলে শুধু শুধু আপনার নামের সাথে আমার নামটা জুড়ে রাখার কি দরকার। আপনি কোনো ভালো মেয়েকে নিয়ে সংসার বাঁধুন,আর আমি একজন ডিভোর্সী মেয়ে হিসেবে শুধু ছেলের মা হয়ে থাকি। কি বলেন আপনি?" কথা শেষ হতে না হতে ছোট্ট ছেলেটা দরজা ঠেলে -"এইতো মা, এইতো মা "বলতে বলতে ঘরে ঢুকে মল্লিকার দিকে ছুটে আসলো। তার পেছনে অন্তুকাকুকে দেখে অবাক হলো সাচ্ছন্দ্য। অন্তুকাকু বললো,-"নাতিকে আর সামলাতে পারলাম না বৌমা, আমাকে এখানে আনতেই হলো।" মল্লিকা ছেলেকে কোলের ওপর বসিয়ে বললো,-"আসলে আমাকে ছেড়ে বেশীক্ষণ থাকতে পারবে না বলে সঙ্গে করে এনেছিলাম। আপনি সকালে বলেছিলেন অন্তু কাকুর ফোন থেকে ফোন করছেন। সেই নাম্বারে ফোন করে অন্তুকাকুকে বলেছিলাম,-"আপনাকে গোপন করে ছেলেকে নিয়ে আসবো, অন্তুকাকু যেন আপনার কাছে কথাটা গোপন রেখে আমার ছেলেটাকে একটু সামলান। কাকু শেষ কথাটা আমার দোষেই রাখতে পারলোনা। আমি এতো দেরি করবো এমন কথা ছিলো না।" ছেলে মিষ্টির প্লেট দেখে ততক্ষণে কোল থেকে নেমে পরেছে একটা সন্দেশ নিজে একটু কামড়ে মল্লিকার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,-"খেয়ে নাও।" তারপর দুহাতে দুটো মিষ্টি তুলে একটা অন্তু কাকুর মুখের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্যটাতে কামড় বসিয়ে সাচ্ছন্দ্যের মুখে ঢুকিয়ে দিল। সাচ্ছন্দ্য আদর করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।অন্থুকাকু বললো,-"নাতি আমাদের খুব মিশুকে।তোমার কাছ থেকে ঘুমন্ত ছেলে নিয়ে ঘরের বিছানাতে শুইয়ে দিলাম,ভাবলাম, জেগে উঠে খুব কাঁদবে, কিন্তু, নাঃ! উঠেই আমার গলা জড়িয়ে আদর করলো, জল খেলো, মিষ্টি আর বিস্কুট খেয়ে বললো,-"মা কোথায় ?"বললাম,-"বাড়িতে আছে।" বললো,-"চলো বাড়ি।" মল্লিকা দেখলো সাচ্ছন্দ্য ছেলে কোলে বাবার ছবির সামনে গেলো। ছবির গলায় মালা দেখে ঠাকুর ভেবে ছেলে হাতজোড় করে বোললো,-"নমো নমো।"
মল্লিকা বললো,-"এবার আমাকে যেতে হবে নাহলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। ছেলেটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পরবে। সাচ্ছন্দ্য ততক্ষণে ফিরে দাঁড়িয়েছে ,-" বললো পরামর্শ শেষ না করেই চল যেতে চাইছো!"
-" ওই তো বললাম আমাকে ডিভোর্স করে
একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করুন।"
--"বিয়ে মানে কি তুমি বোঝো?
বিয়ের সময় কি মন্ত্র বলা হয়েছিল তা কি তোমার মনে আছে?...তার অর্থ জানো?"সাচ্ছন্দ্য প্রশ্ন করলো।
--"জানি। এই মন্ত্র উচ্চারণ এর মধ্যে দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একে অপরের প্রতি সমভাব, আপন করে নেওয়া, একে অপরের দায় দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে আবদ্ধতা স্বীকার করে নেয়।"
-"তাহলে,তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছো কেন মল্লিকা?"
-"আমি চাইনা আপনি কোন মিথ্যের দায় মাথায় নেন,তাই।"
--"তুমি তো সমস্ত সত্যি স্বীকার করে নিয়েছো তাহলে মিথ্যেটা কোথায়! একদিন তুমি বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফেরোনি আজ আমি তোমাকে ফিরতে দেবোনা মল্লিকা। অনেক হয়েছে...যে সন্তানের পিতৃত্বের দাবী নিয়ে কেউ কোনদিন ফিরবে না সেই সন্তানকে মা হয়ে চিরদিনের জন্য পিতৃহারা কোরোনা মল্লিকা।"
-"যদি সে ফেরে কোনদিন...!"
-"যে পুরুষ মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়, সে না জানি আর কতো কুমারী মেয়ের সর্বনাশ করেছে!তুমি তার জন্য অপেক্ষা করবে! আর তাছাড়াও তার সাথে কোনোদিন যদি সাক্ষাৎ হয় তাহলে পারবে তোমার প্রাণের অধিক প্রিয় এই সন্তানকে ওই লম্পটের হাতে তুলে দিতে !"
মল্লিকা মাথা নোওয়ালো। তার কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হলো। এতোটা সে ভেবে দেখেনি।
অন্তুকাকু বলে উঠলো,-"আকাশের বৌ মারা গিয়েছিল তার ফেরার আর উপায় ছিল না কিন্তু তুমি তো বেঁচে আছো... আমি জানতাম সাচ্ছন্দ্য তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকবে। আজ তুমি ফিরে এসেছো বৌমা, তুমি আর যেওনা।"
ছেলে ততক্ষণে সাচ্ছন্দ্যের কোল থেকে নেমে এঘরে- ওঘরে উঁকি মেরে আসছে। একবার অন্তুদাদুর কাছে এসে বললো,-"তুমি যে বললে -'মা বাড়িতে আছে'- এটা কি মায়ের বাড়ি?"
দাদু বললো,-"হ্যাঁ দাদুভাই।" ছেলে এবার ছুটে গিয়ে সাচ্ছন্দের ঘরে ঢুকলো তারপর ওখান থেকেই ডাকলো,-"মা দেখবে এসো এখানে তুমি আছো।"হাতে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নিয়ে সে হাজির হলো ড্রইং রুমে। মল্লিকা আর সাচ্ছন্দ্যের ছবি। মল্লিকা ওর হাত থেকে সেটা নিতে নিতে বললো,-"হাত থেকে পরে গেলে ভেঙ্গে যাবে সোনা। ওটা আমাকে দাও।" ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলো। এছবি এখনো এই বাড়িতে প্রকাশ্যে তার স্বামীর শোওয়ার ঘরে সাজানো আছে ! ভেবে আশ্চর্য হলো সে, সেইসঙ্গে সেই দিনগুলোর কথা ভেবে তার মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।
সাচ্ছন্দ্য তার ছেলেকে কোলে তুলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,-"আর তোমাকে যেতে দেবোনা মল্লিকা। বাবা আমাকে বলেছিলেন, 'তুমি কখনো তোমার স্ত্রী বা তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না মনে রেখো এইটুকুই আমার আব্দার। তবে আমি জানি তুমি না গেলেও বৌমা একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।' আজ তুমি ছেলে নিয়ে নিজের সংসারে ফিরেছো।দেখি আমাদের ভালোবাসার বাঁধন কাটিয়ে তুমি কি করে যেতে পারো!"
অন্তুকাকু ঠাকুরমার হাতে সাজানো ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে শঙ্খে ফুঁ দিতেই মল্লিকা বলে উঠলো,-"কাকু আজকে তুমি সন্ধ্যায় বাতি জ্বাললে, শঙ্খ বাজালে। ঠিকই আছে, কাল থেকে কিন্তু ও দায়িত্ব আমার মনে রেখো।"ছেলে কোলে প্রতিটা ঘরে বাতি জ্বালতে জ্বালতে সাচ্ছন্দ্য উত্তর দিল,-"আজ অন্তুকাকুর কাছে সব বুঝে নাও কাল থেকে এ সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।আলো ঝলমলে ঘর আর ঘরের আনাচে কানাচে তাদের সন্মিলিত হাসির শব্দ যেন তরঙ্গ সৃষ্টি করলো।
