সায়াহ্ণে : কল্পনা মিত্র



   ক’টা দিন বেশ গরমের পর আজ যে কখন বৃষ্টি পরলো বুঝতে পারেনি গণেশচন্দ্র ।জোলো হাওয়ায় প্রকৃতি শীতল হয়েছে তাই ভাত ঘুমটাও আজ গভীর হয়েছিল , মশার কামড়ে ঘুম ভাঙতে দেখলো বাইরেটা বেশ অন্ধকার। ।গনেশচন্দ্র চট্ করে পোষাক পাল্টে বেড়িয়ে পরলো। মনে মনে বললো, " কালকে মেয়েটাকে অতো বকাঝকা করা উচিৎ হয়নি।"


     ছেলেবেলায় আর পাঁচটা ছেলের মতই ছটফটে ছিল গনেশচন্দ্র । তার মা প্রায়ই শ্বাসকষ্টে ভুগতেন তাই তিনি চঞ্চল গনেশকে সামলাতে পারতেন না , বাড়িওয়ালি মাসিমা আদর করে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতেন। সেখানে তাঁর তিন ছেলে পড়াশোনা করত। মাসিমা তাকেও খাতা - বই , স্লেট -পেন্সিল দিয়ে বসিয়ে দিতেন । ।বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার, সকালে ঘরের কাজকর্ম সেরে স্কুল যেতেন ।স্কুল শেষে কয়েকটা টিউশানি করে বাড়ি ফিরে আবার সংসার সামলাতেন । অসুস্থ মা কে নিয়ে বাবাকে সবসময় চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন দেখাতো । স্কুলের কোন পরীক্ষাতেই গণেশ একবারে উত্তীর্ণ হতে পারত না সহপাঠী বন্ধুরা উঁচু ক্লাসে উঠে যেতো সেকারণে গণেশ ক্রমশ বন্ধুদের সাথে মেলামেশা আর খেলাধুলা বন্ধ করে দেয়। ঘরে মাকে নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন পরিবেশ, বাবার কর্মব্যস্ততা ......সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা দমবন্ধ করা অভিমানে তার দুরন্ত ছেলেবেলা উচ্ছ্বাসহীন হয়ে পরেছিল। বাড়িওয়ালী মাসিমা ছিলেন তাদের পরিবারের পরম হিতৈষী। তাঁর ছেলেরা যখন বেশ ছোট তখন তিনি বিধবা হয়েছিলেন । সম্পত্তি বলতে ছিল কেবল এই বাড়িটা । একতলাতে একটা বারান্দাকে ঘিরে চারটে ঘর মাঝখানে একটা উঠোন ,উঠোনের এককোণে কলতলা আর কুঁয়ো  । মাসিমা চারটে পরিবারকে ঘর চারটে ভাড়া দিয়ে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে ছেলেদের নিয়ে থাকতেন । বাড়ি ভাড়ার সাথে কিছু সেলাই আর ঠোঙ্গা তৈরি করে কোনপ্রকারে ছেলেদের মানুষ করতেন। আজ নিচের তিনটি ঘরে তাঁর তিনছেলে বউ বাচ্ছা নিয়ে থাকে। গনেশকে কখনোই তিনি বা তাঁর পরিবারের সদস‍্যরা ভাড়াটের নজরে দেখতেন না


         চোদ্দ বছর বয়সেও গণেশের পক্ষে ক্লাস ফাইভের গণ্ডী ডিঙনো সম্ভব হয়নি।সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত বাবা মায়ের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল গণেশ যেন অন্তত ক্লাস এইট পাস করে । এক সন্ধেবেলা বাবা আর মাসিমার প্রাণপণ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে তাঁদের সমস্ত উদ্বিগ্নতার অবসান ঘটিয়ে মা পরম শান্তির জগতে চলে গেলেন। বাবা ভেঙ্গে পরলেও জীবন আর জীবিকার জন্যে তিনি নিয়মিত কর্মক্ষেত্র, সংসার আর ছেলের পড়াশোনার দেখাশোনা করতেন । গনেশ ক্লাস এইটে ওঠার আগেই মাত্র দুদিনের প্রচণ্ড জ্বরে তার বাবা কাউকে কোন চিকিৎসা করার সুযোগ না দিয়ে চিরতরে বিদায় নেন । বাড়িওয়ালী মাসিমা গণেশকে স্বান্তনা দিয়ে নিশ্চিন্তে তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বলেন কিন্তু ভাবলেশহীন গণেশের আচরণে কোনরকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় না।স্বভাবতই সে নিজেকে প্রায় গৃহবন্দী করে ফেলে। বাড়িওয়ালী মাসিমা অনেক বোঝানোর পর অবশেষে একদিন সে তাঁর মেজছেলের সঙ্গে গিয়ে একটা গ্যারাজে গাড়ি ধোয়ার কাজ ধরে ।


        গ্যারাজের মালিক সুধাংশুদা তার বাবার ছাত্র । গ্যারাজে অনেকেই গাড়ি রাখতেন বা সাড়াতে দিতেন ,তাদের সঙ্গে সুধাংশুদা স্যারের ছেলে গনেশের পরিচয় করিয়ে দিলেও সে কারও সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলতো না ।সুকুমারদার সঙ্গে সুধাংশুদার বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল তিনি কাছাকাছি একটা মেসে থাকতেন ।বছর খানেক আগে সুধাংশুদার পরামর্শে তিনি একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ট্যাক্সি কিনেছিলেন । গত মাসে স্ত্রীর অসুস্থতার খবর পেয়ে সুকুমারদা দেশের বাড়ি যান তার কিছুদিনের মধ‍্যেই ভয়ানক ডেঙ্গু জ্বরে স্ত্রী মারা যান । বোনেদের বিয়ের জন্যে একে একে দেশের জমিজমা বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো মায় বাড়ীটাও মহাজনের কাছে বন্ধক পড়েছিল । বাড়িটা মহাজনের হাতে তুলে দিয়ে দেশের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে মাধ্যমিক পাস করা একমাত্র মেয়ে মালতীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ফিরে আসেন।মেসের বাসা ছেড়ে সুধাংশুদার চেষ্টায় অল্প ভাড়ায় ছোট একটা ঘর ভাড়াও নেন । প্রত্যেকদিন বিকেলে সুকুমারদা মেয়েকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে দোকান বাজার করতেন ,ফেরার সময় মেয়েকে গ্যারাজের উল্টোদিকের ফুটপাতে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে ট্যাক্সিটাকে গ্যারাজে রাখতে আসতেন তাঁর বক্তব্য ছিল ‘ মেয়েটাকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি এখানকার পথঘাট চিনিয়ে দিতে চাই , আচেনা পথে তো মেয়েটাকে একলাই চলতে হবে । ’ গাড়ি সাড়াতে ব্যাস্ত গণেশের চোখ হঠাৎ কখনো ওফুটে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার ওপর পরে যেতো।কোনোদিন বা হলুদ কোনোদিন বা লালফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় লম্বা বিনুনি ঝোলানো পরনে অতি সাধারণ ছাপা শাড়িতে মেয়েটাকে অপরূপা মনে হতো । 


        একদিন সুকুমারদা মেয়েকে নামিয়ে সবে ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে গ্যারাজের দিকে এগোচ্ছিলেন এমন সময় একটা দ্রুতোগামি লড়ির ধাক্কায় ট্যাক্সিটা ছিটকে গিয়ে বেশ কয়েকহাত দূরের অশ্বত্থ গাছের সাথে ধাক্কা খায়। বাবার এই আকস্মিক দুর্ঘটনা সুকুমারদার সদ্য মাতৃহারা মেয়েটাকে বেশ কিছুক্ষনের জন্য স্থবির করে দিয়েছিলো । বন্ধুর চিরবিদায় বেলাকে শান্তিময় করার প্রচেষ্টায় সুধাংশুদা গনেশকে সুকুমারদার মেয়ে মালতীকে বিয়ে করে তাকে তার সংসারে আশ্রয় দেওয়ার অনুরোধ করেন। এটাই নাকি এই মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছে। মালতী আর গণেশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সন্ধ্যালগ্নে ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া মণ্ডপের নীচে উপস্থিত সকলের উদ্যোগে সিন্দুরদান প্রক্রিয়াটা সাড়া হয়ে যায় । পুলিস,হাসপাতাল,ডেথসারটিফিকেট ,দাহ এইসব পর্ব শেষে ভোরবেলা সুধাংশুদা নবদম্পতিকে বাড়ীতে পৌঁছে দিলে বাড়িওয়ালী মাসিমা তাদের সাদরে বরণ করেন। 


         মাসিমার নির্দেশে গণেশ মুখ বুঁজে ঘরের একটা কোণ পরিষ্কার করেছিল ,এখানেই নাকি তার বউ অশৌচের কয়টা দিন শোবে ।মায়ের হাতে সাজানো সংসারে চতুর্দিকে শুধু বিশৃঙ্খলা ছড়ানো ছিল , চিররুগ্না মায়ের সুষ্ঠুভাবে সংসারকে সাজিয়ে রাখার ক্ষমতা ছিলনা । বাবার জীবনটাও নানবিধ ব্যাস্ততার মধ্যে কেটেছিল। গণেশ সেই অগোছালো সংসারের জানালা গুলোও বন্ধ করে রাখতো। 


         অশৌচ কাটার পর মালতী এই অগোছালো সংসারটাকে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করলো । তাকে একলা করে হঠাৎ বাবার চলে যাওয়াতে কষ্ট পেলেও বাবার শেষ সময়ের সিদ্ধান্তকে সে মর্যাদা দেয় , মেয়েকে আশ্রয়হীন অবস্থায় রেখে বাবা নিশ্চিন্তে স্বর্গে যেতে পারছিলেন না তাই সুধাংশু কাকুর অনুরোধ সে ফেলতে পারেনি। মায়ের কাছে শুনেছিল মেয়েদের সবচাইতে নিরাপদ আশ্রয় হলো স্বামির ঘর । তবে গণেশচন্দ্র ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি । সুকুমারদার শোচনীয় অবস্থা দেখে সে অবশ্যই কষ্ট পেয়েছিল। সুকুমারদার মৃত্যু হলে তাঁর মেয়েটা আশ্রয়হীন হবে তাই সুকুমারদার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী সুধাংশুদা গণেশকে সেই মুহূর্তে মেয়েটাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তার ঘরে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলে সে আর অমত কেরেনি । সুধাংশুদা নব্দম্পতির হাতে বেশ কিছু টাকা আশীর্বাদ হিসেবে দিয়ে নিয়মিত বাজার হাট করে ঘরে রান্নার ব্যাবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন । মাসিমার নির্দেশে এখন নিয়মিত মালতীর লেখা ফর্দ মিলিয়ে রান্নার জ্বালনি , তেল, মসলা , আনাজপাতি এসব কেনার নিত্য ঝক্কি সামলানোর সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান খরচা গণেশকে তিতিবিরক্ত করে তুলছিল । 


         আলো-বাতাসহীন -অপরিচ্ছন্ন ঘরে থাকতে অভ্যস্ত গনেশ মালতীর সযত্নে সাজানো নিজের ঘরটাকে চিনতে পারে না। ঘরের পড়ার টেবিলটায় বহুদিন থেকে জমে থাকা অগোছালো বই খাতার সাথে বহুদিনের ওষুধের প্যাকেট,খাম, শিশি , কাগজের টুকরো,পুরনো ‌প্রেসক্রিপ্সানের গোছ,বিস্কুটের ছেরা প্যাকেট সমস্ত কিছু সরিয়ে সেখানে বই ,খাতা, ডায়েরি ,পেন, পেন্সিল মায় একটা ফুলদানি রাখা হয়েছে । ঘরের মধ্যে টাঙ্গানো তেলচিটে দড়িতে বহুদিনের জমে থাকা কাপড় চোপর দড়িসহ উধাও । ভাঙ্গা আলনাটাকে ইঁট দিয়ে খাড়া করে তাতে কিছু জামা কাপড় পরিপাটি করে রাখা । দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে টাঙ্গানো মশারী খুলে খাটে পরিস্কার চাদর টান টান করে পাতা। বারান্দার কোণার রান্নার জায়গাটাতে রান্নার সাজ সরঞ্জাম গোছানো ... । এমন পরিপাটি ঘরে থাকতে আর পরিপাটি বিছানায় শুতে গণেশ অভ্যস্ত নয়। ‘ আজ আর তার ঘুম আসবে না ’ ভেবে মনে মনে বেশ বিরক্ত হয় সে কিন্তু সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত গণেশ কখন যে ওই পরিচ্ছন্ন বিছানায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরেছিল তা মনে করতে পারেনি।


        সুধাংশুদার নির্দেশে গণেশ দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতে আসে। অনভ্যস্ত ভরা পেটে শরীরে ক্লান্তি নেমে আসলে কিছুক্ষণ বিছানায় গরিয়েও নেয় ।প্রানবন্ত মেয়ে মালতী সর্বদাই ব্যাস্ত । মাসিমার জন্য কিছু করা , ছোটবউদির এক বছরের ছেলেকে খাওয়ানো ঘুম পারানো ,বড় বউদির ছেলের পড়াশোনা দেখা , মেজো বউদির মেয়েটার সাথে খেলা করা এমন কি মেজো বউদির সেলাইয়ের কাজে সাহায্যও করে সে। গতকাল পুরানো সেলাই মেশিনের ঘরঘর শব্দে গণেশচন্দ্রের দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামে ব্যঘাত ঘটাতে বিরক্ত হয়ে গণেশ মালতিকে অনেক বকাঝকা করে ছিল তাই আজ দুপুরে সে কোন শব্দ না করাতে তার ঘুম ভাঙতেও দেরি হল । 


            পরের দিন দুপুরে খেতে আসার সময় সুধাংশুদা বললেন ‘ কালকের মতন আজ যেন সে গ্যারাজে ফিরতে দেরি না করে।’  সুধাংশুদার এই অভিযোগে গণেশ ক্ষুব্ধ হল । তার জীবনে ওই মেয়েটা এসে তার ঘর আর অভ্যস্ত জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আজকাল কাজে বেরনোর সময় পরিছন্ন পোশাক আর গ্যারাজে গিয়ে গ্যারাজের পোশাক পরতে হচ্ছে , দিনশেষে মাসীমার নির্দেশে সাবান মেখে স্নানও করতে হচ্ছে। মালতী নিয়মিত তেল-কালি মাখা পোশাকগুলো কেচে দিচ্ছে । বাড়িতে রান্না হচ্ছে তাই বাড়িতে খেতে আসছে আর সেই সঙ্গে ভাতঘুমের হাতছানিকে কিছুতেই অগ্রাহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্রমশ ঘরমুখি হয়ে পরা গণেশ মনে মনে মালতীকেই এই সব কারণের জন‍্য দায়ী করতে থাকলো ! কেন যে সেদিন সে সুধাংশুদার অনুরোধে মেয়েটাকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিতে গেলো আর তার সাথে ঘরে রান্নার ব্যাবস্থাও করলো ! এর চাইতে তার ফেলে আসা একক জীবনে ফুটপাতের দোকানের ভাত,ডাল,সবজি খেয়ে আর গ্যারাজের তেলকালি মাখা নোংরা পোষাকে থেকে সেই দিনগুলো বেশ নির্ঝঞ্ঝাটেই কাটতো।


         খেতে বসে গণেশ হঠাৎ ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিতে ভাত-তরকারি চারিদিকে ছড়িয়ে গেল সেইসঙ্গে জলের গ্লাসটাও উল্টে গেল । মালতী আচমকা ভয় পেয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পরা খাবারগুলো জড়ো করতে ব্যাস্ত হল । মাসীমা উঠোনে কাপড় মেলছিলেন শব্দ শুনে তাড়িঘরি তাদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন । চির মুখচোরা গণেশ সেদিন দোর গোড়ায় মাসীমাকে দেখে গর্জে উঠলো "কোত্থেকে একটা মেয়ে ঢুকে পরেছে আমার ঘরে নামেও না ঘাড় থেকে ! এই যে বরবটি ,উচ্ছে ঢ্যাঁড়শ রান্না করেছে কই এতো দামি সব্জি আমি তো কিনিনি ! ও পেলো কোত্থেকে ! নিশ্চয়ই সেলাই করে রোজগার করে আর বাজার থেকে দামি আনাজ কেনে ! তাহলে এখন আর ও অসহায় - বেচারি নয় ! মাসিমা, ওকে বলে দাও এসব বাহাদুরি করে এখানে থাকা ওর আর চলবে না । " মাসিমা এগিয়ে এসে গণেশের হাতটা চেপে ধরে খাওয়ার আসন থেকে টেনে তুলে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেলেন, গণেশ দেখলো সেখানে ভাঙ্গা বালতি ,গামলা ,হাড়ি সবকিছুতে মাটি ভরে নানান গাছ লাগানো আছে আর তাতে কিছু সব্জিও ফলে আছে । তারপর মাসিমা তাকে একই রকমভাবে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনে, সেখানে কুমড়ো ,ঝিঙ্গে লাউ, পুঁই আরও কত গাছ । রাগে এবং অত‍্যধিক উত্তেজনায় পরিশ্রান্ত মাসিমা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,"এই হল তোর বৌয়ের বাজার আর পুঁজি হল দেশ থেকে সংগ্রহ করে আনা বীজ আর রাস্তা থেকে বয়ে আনা মাটি । ভাল মানুষের মতন মুখ করে থাকলে কি হবে গণশা এই দুদিন বউমার সাথে যে ব্যবহার করলি তাতে আমি চিনে নিয়েছি তোকে । আজ থেকে তোর বউ আমার মেয়ে হয়ে আমার কাছেই থাকবে তোর ঘরে আর যেতে দোবোনা, তুই থাক একলা একলষেঁড়ে হয়ে......।" গণেশ ঘরে ঢুকে ভাতের থালাটা টেনে নিয়ে খেতে লাগল, খাওয়া শেষে নীরবে কাজে চোলে গেলো। 


        কাজ করতে করতে আজ তার চোখটা বার বার উল্টো ফুটের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর দিকে চলে যাচ্ছিল এইখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটাকে তার অপরূপা লাগত ! এখানেই গাছ থেকে ঝরা ফুলের কার্পেটে দাঁড়িয়ে ঝরা ফুলের আশীর্বাদ মাথায় করে এই মেয়েটাকে সে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিল । বাড়ি ফেরার সময় কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর তলা থেকে সে টাটকা ঝরে পরা কিছু ফুল কুড়িয়ে নিল । কখনও স্বপ্নেও সে নিজের বিয়ের কথা ভাবেনি....তার ঘরের বন্ধ দরজা জানলা কোনদিন যে খুলতে পারে বা খোলা থাকলে কেমন লাগতে পারে এসব চিন্তাও সে করেনি কখনও কিন্তু আজ রূপকথার গল্পের মতন তার ঘর আশ্চর্য সোনার কাঠির স্পর্শ পেয়েছে ! গণেশের মনে হলো হঠাৎ যদিতার নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে রূপোর কাঠির স্পর্শে তার জীবনের এই বাস্তব রূপকথা স্তব্ধ হয়ে যায় ! গণেশ দ্রুত পায় বাড়ীর দিকে এগিয়ে চলল তার মনের মধ‍্যে একটাই প্রশ্ন বার বার উঁকি মারছে 'মাসিমা কি সত্যিই মালতীকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেছেন! ' উঠোন পেরিয়ে অন্ধকার ঘরে ঢুকে গনেশ জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় দেখলো জানলার কাছে মেঝেতে মাদুরের উপর শুয়ে মালতী ঘুমোচ্ছে, চাঁদের আলোয় তার মুখটা কি অপূর্ব দেখাচ্ছে ... ।অথচ এত কাছে থেকেও সে মেয়েটার সাথে এতদিনে সরাসরি কথাও বলেনি আর ভালো করে চেয়েও দখেনি , মেয়েটা যে আজও সেই প্রথম দিনের মতন এই মেঝেতেই শোয় সেই খবরটাও সে রাখেনি ।হতের ফুলগুলো মালতির বালিশের পাশে রেখে সে তার কাছে বসে মৃদুস্বরে ডাকল, " মালতী " ।

Post a Comment

Previous Post Next Post