এই এতটা মেঠো পথের আল ধরে ছুটতে ছুটতে জোনাকির হাঁপ ধরে যায় ।শালগাছের জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যাবার তাড়া যতখানি আসবার সময় তা দ্বিগুণ বেড়ে যায় ।ঘরে আছে তার তিনটি ছা।একেবারে কচিটাকে বড়টির জিম্মায় রেখে তার বাইরে বেড়ানো ।কোথাও কোনো কাজ নাই,ভাত নাই, কাপড় নাই , কিছু নাই ।কি এক মরণখেকো রোগে সবকিছু গিলে খেয়ে নিল।একেবারে শূন্য করে দিল।মরদ টাকেও নিয়ে নিল।বেঁচে থাকার লড়াই টা তবু রোজ রোজ জোনাকি কে চালিয়ে যেতে হয় ।মাঝে মাঝে ঝিম ধরে থাকে ।মাথার ওপর রোদ আর বিষ্টি নিয়ে পাতা গোঁজা মাটির প্রায় ভেঙে পড়া ঘরে ওরা থাকে ।বাচ্চা দুটো ইস্কুলে পড়ত,এখন সব বন্ধ ।মিড ডে মিলের যা খাবার পায় তা দিয়ে আর কতদিন চলে? পেট তো মানেনা।কত আর সান্তনা দেবে সে শিশুদের! জঙ্গল ঘেরা প্রান্তিক গ্রামে জোনাকিদের খোঁজ কে আর রাখে? অসুখ বিসুখ হলে শীতলা মায়ের থান ই ভরসা। দূরে হাসপাতালে যাবার সামর্থ্য কোথায়! জীবন যেন ঝাঁকুনি দিতে দিতে চলে ।
গত দুদিন ধরে পেটে কিছু পড়েনি।দুদিন আগে গ্রামের মোড়লের থেকে একটু খুদ পেয়েছিল,তাও ধানকাটার মজুরি হিসেবে টাকা তেমন কিছু না ।এখানে সবাই গরীব, চাষবাস তেমন হয়না ।জোনাকি রা ফি বছর দূরের শহরে মজুরের কাজে যেত,এখন তাও বন্ধ ।ছোট ছেলেদের নিয়ে সে করবেই বা কি? পড়শি বা নিজের লোকও এসময় মুখ ফিরিয়ে নেয়।এবার কি সে ভিক্ষা করবে রেল স্টেশনে গিয়ে? কাল ও জোনাকি বাচ্চাদের ভুলাতে কাঠ জ্বেলে হাঁড়িতে জল দিয়ে পাথর ফুটিয়েছে।'ভাত এখনো হয় নাই'এই বলে বার বার ধমক দিয়েছে।বাচ্চাদের খিদের যন্ত্রণাময় কান্না তার মন ঝাঁঝরা করে দেয় ।সর্ব শরীর দিয়ে যেন আগুন ঝরে। চোখের জল আর নেই ।বাচ্চাগুলি কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে নিজেও খেয়াল করেনি।
কিন্তু আজ দিন টা অন্যরকম ।সবাই বলাবলি করেছে তাদের শতছিন্ন গ্রামে ,কারা যেন শহর থেকে গাড়ি করে খাবার নিয়ে এসেছে ।শুনে অবধি জোনাকি থির থাকেনি। কোন ভোরে সে বেড়িয়েছে,আর ফিরছে এখন ।পুঁটুলি ভরা চাল,ডাল, আলু আর বিস্কুট ।হাতে যেন চাঁদ পেয়েছে।মাথার উপর আর সূয্যি নেই ।পড়ন্ত বিকেল। জোনাকি ঘরে ফিরে দেখে বাচ্চা রা কাদা নিয়ে খেলছে আর তেঁতুল পাতা চিবোচ্ছে।মায়ের হাসিমুখ দেখে তারাও বোঝে আজ দিন টা অন্যরকম ।তাড়াতাড়ি আগুন জ্বেলে হাঁড়িতে আজ সে সত্যিকারের চাল দেয় ,সাথে আলু।আহা অমৃত।একটু নুন নিলেই চলবে ।সবাই চান সেরে উবু হয়ে বসে একচিলতে ফুটিফাটা ঘরে ।যে ঘরে রোদ আসে,বৃষ্টি পড়ে, আর ঝরে অকৃপণ জোছনার আলো ।ভাত ফোটার মোহময় আবেশ ছড়িয়ে পড়ে ঘরের আনাচে কানাচে ।কতদিন না খাওয়ার খিদেমুখগুলি আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । জোনাকি আলু সিদ্ধ মাখা ফেনা ভাত বাচ্চাদের মুখে তুলে দেয়, নিজেও খায়।জোছনার আলোয় তার মুখ ঝিক্ মিক্ করে ,যেন অন্নদা পৃথিবীর সন্তানদের খাইয়ে দিচ্ছেন।সন্তানরা যেন দুধে ভাতে থাকে ।

