বার বার সূঁচে সুতো পরাতে হিমশিম খাচ্ছে সৃজনী।চোখের চশমা আরও ঝুলিয়ে সুতো পরানোর চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখলো না সে। পাশে কাপড় কাটার সময় যে সরু তারের মতন জরিগুলো পরে ছিল তাদের একটা টুকরো তুলে ভাঁজ করে মেশিনের সূঁচের ফুটোতে তার ডগা দুটো ঢুকিয়ে ভাঁজের ফাঁকে রিলের সুতোর ডগা গুঁজে জরিটাকে সূঁচের ফুটোর উল্টো দিকে টান মারতেই সূঁচে সুতো ঢুকে গেলো।
একটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সৃজনী। নিজের নতুন কায়দায় নিজেই খুশী। সূঁচে সুতো পরানোর সময় প্রায়ই মনে পরে মায়ের কথা। মেশিনে মা সেলাই করতে বসলেই বলতেন,
-" সূঁচে সুতো পরাতে পারিনা তাই সেলাই নিয়ে বসতে ভরসা পাই না।" সে এসে পাশে বসতো,বলতো, সূঁচে সুতো পরানোর জন্য আমি যতক্ষণ আছি তুমি নিশ্চন্তে সেলাই করো মা।" আজ মনে মনে বললো,
-" ইস্ আজ তুমি বেঁচে থাকলে এই সহজ কায়দাটা তোমাকে শিখিয়ে দিতাম মা।"
পুরনো সেলাই মেশিটায় ঘর্ঘর শব্দ করছে সেটা সূঁচে সুতো পরানোর চাইতেও বিরক্তিকর। এ বাড়ির আর পাঁচজনের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। সৃজনী ঘরের দরজা জানলাগুলোতে চোখ বোলালো। নাঃ কোথাও কোন ফাঁক নেই, এবার নিশ্চন্ত হলো সে। ঘরের বাইরে তাহলে কোন শব্দ যাচ্ছেনা। মেয়ে আর কর্তা অনেকবার নতুন মেশিন কিনে দিতে চাইলেও এখন আর নতুন মেশিনের স্বপ্ন দেখেনা সে। নতুন মেশিন যে খারাপ হবে না তা নয়। খারাপ হলে মেশিন সারানোর মিস্ত্রির অপেক্ষায় থাকতে হবে কারণ নতুন মেশিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে হতে তার চোখ নষ্ট হওয়ার বয়সটাও ঘনিয়ে আসবে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তার চাইতে পুরনো মেশিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অনেকদিনের, এর বেশ কিছু কল-কব্জার সঙ্গেও পরিচিত সে , একটু এদিক ওদিক হলে নিজেই সাড়িয়ে নিতে পারে।
সেলাই কখনো শেখেনি সৃজনী, যা কিছু বানায় তা নিজের মর্জি মতন ডিজাইনে বানায়। ছেলেবেলা থেকে তার মেয়ে অনুক্তা মায়ের হাতে বানানো জামা ছাড়া দর্জির দোকানে সেলাই করা জামায় ভরসা করতো না কোনোদিনই। এবারে ভেবেছিল মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে, এখন কতো রকম ডিজাইনের জামা পরে, তাই গতকাল তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিল,-" এবারে ষষ্ঠীর জামাটা এই টাকা দিয়ে কিনে পরিস।" সৃজনী লক্ষ করেছিল সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের মুখটা শুকিয়ে গেল, মুখে বললো,
-" তোমার নতুন কোনো সুতির ছাপা শাড়ি থাকে তো দিও, ষষ্ঠীতে নাহয় আমি সেটাই পরবো।" সৃজনী জানতে চেয়েছিল,
--" কেনরে শাড়ি কেন ! তুই তো কুর্তি পরিস, কালকে ফেরার সময় নাহয় একটা কুর্তি কিনে নিস।" মেয়ে ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কি যেন খুঁজলো, তারপর অভিমান করে প্রশ্ন করেছিল,-" এবারে আমার জন্য কিছু সেলাই করোনি?" সৃজনী বুঝতে পেরেছে আজও মেয়ে ষষ্ঠীতে তার হাতে তৈরি জামা-ই পরতে চায়। বিয়ের পর বছর দুই মেয়ে বিদেশে ছিল তাই পূজোর সময় তাকে কাছে পায়নি। ভেবেছিল হয়তো সেই ইচ্ছাটা তার চলে গেছে। ভুল ভেবেছিল। ঘরে অনেক জামার পিস্ কেনাই ছিল, একটা কুর্তি সেলাই করে দিলেই পারতো! মনে মনে নিজেকে তিরষ্কার করলো সে। পূজোর সময় বেড়াতে যাবে বলে তৃতিয়াতে এসেছে অনুক্তা। কালকে চলে যাবে। পঞ্চমীতে ফ্লাইট। আজ তাই রাত জেগে সৃজনীর সেলাই অভিযান।
সকালে মা তার হাতে সদ্য সেলাই করা জামাটা তুলে দিতে অনুক্তার দুচোখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় মাথা নিচু করে বললো,
-"আমার জন্য তুমি রাত জাগলে মা!"
-"বাঃ! তোর চোখে যে খুশির ঝিলিক দেখতে পেলাম সেটা দেখার যে বড্ড লোভ হচ্ছিল মা। রাত জাগার সব ক্লান্তি তো তোর হাসিমুখ দেখার সাথে সাথেই দূর হয়ে গেল।" অনুক্তা মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
--" তুমি আমার বিয়ের তত্ত্বে তোমার হাতে সেলাই করা যে জামাগুলো দিয়েছিলে তার থেকে বেশ কয়েকটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। নববর্ষ,জন্মদিনে আর ষষ্ঠীতে একটা করে গায়ে দিতাম। আজ তোমার কাছে থেকে,ষষ্ঠীতে, কি করে কেনা জামা গায়ে দি বলোতো! তাই তোমার একটা শাড়ি চেয়েছিলাম।" সৃজনী চোখের জল চাপতে চাপতে বললো,"দূর পাগলী।"
বিশ্বকর্মা পূজোর দিন তাড়কশঙ্কর সরকারি হাসপাতালের জানলার পাশের বেঞ্চে বসে কখনও কারখানার পাশে বেড়ে ওঠা কাশফুলের ওপর বাতাসের আনাগোনা দেখছিলেন। কখনও বা সুনীল আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতন ভাসন্ত সাদা মেঘের মাঝে লাল,নীল,কমলা,সবুজ,হলুদ ঘুড়িদের লড়াই মগ্ন হয়ে দেখছিলেন। তখন হাসপাতালের সামনের শিউলি গাছের ডালে তিড়তিড়ে বাতাসের স্পর্শে শিউলি ফুলের মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে গাছের তলায় ঝড়ে পরছিল কমলালঙের বোঁটার আগায় সাদা পাপড়ির শিউলি ফুলগুলো ! বিশ্বকর্মার প্যান্ডেলের মাইকে তখন বেজে উঠেছিল 'সুজন মাঝিরে' গানটা। ঠিক সেই সময় নার্স এসে তাঁকে কন্যাসন্তানের জন্মের খবরটা দিয়েছিলেন।তাড়ক শঙ্কর জানতেন মেয়ে জন্মেছে শুনলে বাড়ির গুরুজনেরা অসন্তুষ্ট হবেন কিন্তু পূজো পূজো গন্ধ মেশানো পরিবেশে কন্যা সন্তানের জন্মের খবরে তিনি পুলকিত না হয়ে পারেন নি। ভাবাবেগে আপ্লুত তাড়কশঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তখনও চোখে না দেখা কন্যার নাম রেখেছিলেন 'সৃজনী'। এ গল্প অনুক্তা দাদুর কাছে অনেকবার শুনেছে। দাদু বলতেন,-" আমি জানি সৃজনীর মধ্যে এমন অনেক গুণ আছে আর পাঁচজন সাধারণ মেয়ের এমন গুণ থাকেনা। একটু যত্ন, একটু খেয়াল করতে পারলে তোর মা হয়তো অসাধারণ হতে পারতো। আমি তো তেমন যত্ন করতে পারিনি, তেমন অর্থবল কোনোদিনও ছিল না আমার, যতটুকু তার গুণ আছে সব তার নিজস্ব।তোরা কিন্তু দেখিস,পারলে যত্ন করিস।"
মুখে না প্রকাশ করলেও মনে মনে মায়ের তারিফ না করে পারেনা অনুক্তা এতো ক্রিয়েটিভ এতো পরিশ্রমী যে হতে পারে কেউ ভাবতেই পারেনা সে। দরিদ্র বাবার কাছে আর্থিক অসংগতির কারণে মা যত্ন পায়নি সে কথা মানে অনুক্তা। কিন্তু বাবার কাছে এসে মা কি পেয়েছে! একান্নবর্তী পরিবারের বড় বৌ হওয়ার কারণে ছেলেবেলায় সে মাকে উদয়অস্ত খাটতে আর সংসারের সদস্যদের মনজুগিয়ে চলার জন্য তটস্থ থাকতে দেখেছে। তারই মাঝে তাঁর গলায় শুনেছে রবীন্দ্র, নজরুল, মধুসূধনের কবিতা আবৃত্তি। মায়ের প্রিয় কবি মধুসূধন, একথা শুনে তার কারণ সে একদিন মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল। সৃজনী বলেছিল,-" অতি অল্পদিন বাংলা ভাষার কাব্যচর্চায় তাঁর সাফল্য লাভ। কবি মধুসূধনের এই গুণ-ই হলো তাঁর প্রতি প্রধান আকর্ষণের বিষয়।" অনুক্তা দেখেছে দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে মা কখনও ছবি আঁকছেন।ছবি আঁকতে বসে বলতেন,-"আমি ভালো আঁকতে পারিনা তবে চেষ্টা করি।"ছোট্ট অনুক্তার কাছে তার 'মা' ছিল তার আদর্শ। তখন কোনটা ভালো আঁকা কোনটা ভুল আঁকা সেটা বুঝতো না সে। তার মায়ের হাতের আঁকা দেখে মনে হতো সবটাই ঠিক আর সুন্দর। পরবর্তীতে বুঝেছে মা একটু গাইডেন্স পেলে ভালো ছবি আঁকতে পারতেন,তাহলে হয়তো মায়ের মনে ভালো না আঁকতে পারার খুঁতখুঁতানিটা থাকতো না। তখনই অনুক্তার দাদুর কথাগুলো কানে এসে ভাসে,
-"একটু যত্ন,একটু খেয়াল করতে পারলে তোর মা হয়তো অসাধারন হতে পারতো।" আজ অনুক্তার মনে হয় 'যদি দাদুর অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো সে পূরণ করতে পারতো। কখনও বা মা তার জামায় এমব্রয়ডারি করতে ব্যস্ত থাকতেন। কিম্বা সোয়েটার বুনতেন। একান্নবর্তী পরিবারে কাকিমা, পিসিমারা থাকলেও আত্মকেন্দ্রিক মানুষগুলোর মধ্যে সদ্ভাব ছিল না তাই সোয়েটারের ডিজাইন কেউ দেখাতেও চাইতো না। মা নিজে নিজে নতুন নতুন ডিজাইন তৈরী করে সোয়েটার বোনা শেষ করতেন। তখন কাকিমারা শিখতে চাইলে মা তাদেরও শিখিয়ে দিতেন। ব্যপারটা অনুক্তার ঠিক পছন্দ হতোনা। মা বলতেন,-"আমিও যদি তাদের মতন হই তাহলে আমার আর তাদের মধ্যে তফাৎটা কোথায় থাকবে!" আজ মাকে ডিজাইন খুঁজতে হয়রান হতে হয়না, অনুক্তা একটা ভালো ফোন উপহার দিয়েছে, তাতেই নেট সার্চ করে ঘরে বসে বহু তথ্য পেয়ে যান। প্রায়ই বলেন,-"জানিস অনু, এই ফোনটাই এখন আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু! যতো না পাওয়া খিদেগুলো একে জিগ্যেস করলেই মেটাতে পারি।" মায়ের খুশী দেখে চতুর্গুণ খুশী হয় সে। কখনও বা মা খাতা কলম নিয়ে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখতে বসেতেন...কতো বই ঘেঁটে অজানা তথ্যগুলো জানার চেষ্টা করতেন। অনুক্তা জানে মা সেই ছোটবেলা থেকে লিখতে ভালোবাসেন। মায়ের মুখে শুনেছিল মায়ের ছেলেবেলা থেকে মনের ইচ্ছে ছিল বেড়া বেয়ে ওঠা লতানে জুঁই গাছের পাশে খড়ের ছাউনির দেওয়া মাটির কুটিরে বসে মা প্রাণ ভরে লিখতে চান। অনুক্তা আজও ভাবে অধিকাংশ লেখকেরা হয়তো এমন পরিবেশেই লিখতে ভালোবাসেন। মায়ের আরও একটা শখের কথা জানে অনুক্তা, ছোট্ট ফুলের বাগানে কৃষ্ণচূরা,বকুল আর কদম গাছ থাকবে। সেই কদম গাছে ঝুলোনা বেঁধে তাতে রাধা-কৃষ্ণকে দোলাতে চান সৃজনী।
এখন আর মায়ের সে সাধ নেই।মা বলেন, -"জীবনের অনেকটা সময় পার করে এসেছি এখন শুধু সৃষ্টি করে আনন্দ পেতে চাই তাই টবের গাছে ফুল ফোটাই, ফল ধরাই, সেলাই করি,লেখালেখি করি।"
ঠাম্মা-দাদুর মৃত্যুর পর যখন তাদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, তখন দাদুর বাড়িতেই সকলের রান্নাঘর আলাদা হলো। অনুক্তা দেখলো মা কাজের পিসি আর তার মেয়েকে দুবেলা পড়তে বসাচ্ছেন। মায়ের কাছে পড়তে অনুক্তারও ভালো লাগতো। সে সময় উঁচু ক্লাসের পড়া বলে সৃজনী অনুক্তাকে শুধু ইতিহাস,বাংলা আর ভূগোল পড়তে সাহায্য করতো। এবারে হাতে সময় পেয়ে সৃজনী কয়েকটা ছাত্র পড়ানো শুরু করলো। এই বাড়িতে ছাত্রদের বসিয়ে পড়ানোতে অসুবিধা থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে পড়াতে হতো। অনুক্তা জানতো মা বাংলা, ইতিহাস আর ভূগোল পড়ান। একদিন সৃজনী তার কাছে একটা এ্যালজেব্রার অঙ্ক বুঝতে এলে চমকে উঠেছিল অনুক্তা! সৃজনী বলেছিল,-" কি করি বলতো! কিছু স্টুডেন্টের মায়েদের আব্দার আমি যেন তাদের ছেলে -মেয়েদের একটু ইংরেজি আর অঙ্কটাও দেখিয়ে দি। জানিস তো, ছাত্রীজীবনে আমি বাংলায় হায়েস্ট মার্কস পেলেও ব্যকারণে ভালো ছিলাম না। ইংরাজির সেকেন্ড পেপারে লেটার আর এশে লিখে কোন প্রকারে পাশ মার্কসটা তুলতাম। অঙ্কের পাটিগণিত আর জ্যামিতিতে নাম্বার তুলতাম ত্রিকোনোমিতি একটু আধটু পারতাম কিন্তু বীজগণিতে তথৈবচ অবস্থা ছিল। ফিজিক্সটা একটু পারলেও কেমেস্ট্রিতে ভরসা ছিল না। জীবন বিজ্ঞান ভালো লাগতো। আর রইলো ইতিহাস ভূগোল!ইতিহাসে পর পর সাল অনুযায়ী ঘটনা মনে রাখতাম আর ভূগোলের বেলায় গোল পৃথিবীর ম্যাপটা মাথায় গেঁথে রেখেছিলাম আর সেই অনুযায়ী জলবায়ু, উৎপাদন বেড়িয়ে আসতো। দে-না বাবা, একটু বুঝিয়ে। সেদিন গুলোর মতন আজ প্রাইভেট শিক্ষক বা একটু দেখিয়ে দেওয়ার মানুষের সমস্যা যখন আর নেই তখন না হয় সেদিনের না পারা সমস্যা গুলোর সমাধান করতে পেরে আরও একটু খুশী হই।" মায়ের এতো কথার পরে হেসে ফেলতো অনুক্তা। সৃজনীর মাথাটা শিশু সন্তানের মতন বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুম্বন করতো সে। মনে পরতো দাদু বলেছিলেন,-"আমি তো তেমন যত্ন করতে পারিনি,তোরা কিন্তু দেখিস,পারলে যত্ন করিস।"
খুশীতে ডগমগ অনুক্তা মায়ের হাত থেকে জামাটা নিল। বললো,দাাঁড়াও ট্রায়াল দি।"
মেয়ে সন্ধ্যে বেলা যাবে। জামাই আসবে নিতে। অনুক্তা বললো,-"আজ কিন্তু রান্না ঘরে ঢুকবে না।সারারাত জেগেছো। আমি খাবার অর্ডার করে দেবো তুমি শুধু আইটেমস্ গুলো বলে দাও।" সৃজনী যেন আকাশ থেকে পরলো,-" কি যে বলিস।পূজোর কটাদিন তো বাইরে কাটাবি, বাইরের খাবি। আজ কয়েকটা আইটেমস রান্নার প্ল্যান আছে।" অনুক্তা বুঝলো মাকে এভাবে বোঝানো যাবেনা। বললো,
-" সেইজন্যেই তো বলছি আজ এতো খেটোনা।পূজোর সময় এ বছর কলকাতায় থেকেও তোমাকে কাছে পাবোনা তাই তোমার আর বাবার সাথে একটু কাছাকাছি বসে গল্প করবো।" সৃজনী বললো,
--"তুই বাবাকে নিয়ে এখানে বসিস আর আমিও রান্না করতে করতে গল্প করবো।" অনুক্তা মায়ের হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,-"আমি থাকবো না আর সে সময় যদি তোমার শরীর খারাপ করে! তখন আমি কি করবো?" মেয়ের চোখের কোলের জল মুছিয়ে দিয়ে সৃজনী বললো,তোরা থাকতে আমার কিচ্ছু হবেনা মা।আমার যে এখনো অনেক কিছু করার আছে।" সৃজনী ফিক করে হেসে ফেললো। সেদিনের সেই স্বপ্নের কথা মাকে বলা হয়নি।আজ বাবার সামনে বলবে। সৃজনী বললো,-"হাসলি কেনো?"
--"তুমি যদি বসো তো বলবো।" সৃজনী খাটের ধারে বসলো।
-"নাঃ ভালো করে পা তুলে,বালিশে ঠেসান দিয়ে বসো।" সৃজনী বাধ্য মেয়ের মতো মেয়ের কথা মতন বসলো।
--"দাঁড়াও বাবাকে ডাকি।"
-"বাবা বাজারে গেছেন। আমাকে বল,তারপর আবার যখন বাবাকে বলবি আমি নতুন করে শুনবো নাহয়।"
অনুক্তা বললো,-"সেদিন স্বপ্ন দেখলাম প্রচন্ড ঝড়ে ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে পরছে, আনাচে কানাচে ইলেকট্রিক থেকে আগুন স্পার্ক করছে! তুমি বসে বসে কি একটা করছিলে, আমি তোমার হাত ধরে টানছি -"মা বাইরে চলো,এক্ষুনি বাড়ি ভেঙে পরবে!" তুমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলছো,-"আঃ!হাত ছাড়,আমায় কাজটা শেষ করতে দে।" হঠাৎ অনুক্তারবাবা বলে উঠলেন,-"হুম্! তোমার মাকে যম ডাকতে এলেও হাতের কাজ না সাড়া পযর্ন্ত তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখবেন।" সৃজনী খাট থেকে টপ্ করে নেমে এসে স্বামীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বললো,-"তুমি কখন এলে?" তারপর সৃজনীর দিকে চেয়ে বললেন,-"আমার কষ্টটা হয়তো তোরা বাইরে থেকে দেখবি কিন্তু তোরা এলে তোদের আদর যত্ন করলে আমার যে তৃপ্তিটা হয় সেটা দেখতে পাস না!" অনুক্তা মাকে তাঁর অন্তরের তৃপ্তি পাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পারলো না। সৃজনী বাজারের ব্যাগ হাতে রান্নাঘরে চলে গেল।
****************************************
কাজের মেয়ে শিবানী আর তার মেয়ে রুমকি ষষ্ঠীর দিন সকালে তার হাতে সেলাই করা জামা গায় চলে এলো। শিবানী সৃজনীকে প্রণাম করে মেয়েকে ডাকলো। রুমকি মাথা নিচু করে সৃজনীকে প্রণাম করতে গেলে সে তার কাঁধ ধরে বললো,
-"সারা বছর ভালো পড়াশোনা করেছিস তাই তোর আর তোর মায়ের আমার নিজের হাতে তৈরী জামা দুটো স্পেশাল গিফ্ট। মনে রাখিস।" শিবানীকে নতুন চুরিদারে বেশ লাগছিল, চুড়িদারের রঙটাও খুব সুন্দর। রুমকি বারকয়েক বন বন করে ঘুরে বললো,-"দেখো দিদা, জামাটা কেমন ঘুরছে।" সৃজনী বললো,-"পছন্দ হয়েছে?"
--"খুউউব।"রুমকি তখনও ঘুরছে।
শিবিনী বললো,-"জেঠিমা,কখনো সাধ থাকলেও দর্জির কাছে জামা সেলাই করার সাধ্য হয়নি। তোমার মায়ের মন তাই আমাদের লেখাপড়াও শেখাচ্ছো আবার জামাকাপড়ও দিচ্ছো। তার ওপর স্পেশাল গিফ্ট বলে আমাদের দুজনকে তোমার নিজের হাতে সেলাই করে আরো একটা করে জামা দিলে। আমার বর বলে তুমি নাকি আসলে আমার মা। আমার বর বলেছে তোমার কাছে যেন কিছু না লুকাই।"
-"কি হলো হঠাৎ তোর! কি লুকিয়েছিস আমার থেকে? কি বলবি বল?" সৃজনী বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো।
-"দাঁড়াও আমার বরকে ডাকি।" শিবানী রুমকিকে বললো,-"যা তো মা, পূজোর প্যান্ডেলে বাবা আছে,এখানে আসতে বল আর তুই ওখানেই থাকিস, বাবাকে এখুনি তোর কাছে পাঠিয়ে দেবো।'
-"দিদা আসছি।" বলে রুমকি চলে যেতে সৃজনী জিজ্ঞেস করলো,
-"তোর বর আর মদ খায়?"
-"না জেঠিমা,তুমি আমাকে যে দিন থেকে পড়াচ্ছো সেদিন থেকে ও সন্ধ্যেবেলা আমাদের সাথে পড়তে বসে। তোমার দেওয়া লেখা পড়া ও আলাদা খাতায় করে। একদিন নিয়ে এসে দেখাবো।"
শিবানীর বর এসে সৃজনীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
সৃজনী বাঁধা দেওয়ার সুযোগ পেলো না। বললো,,
-"বলো কি বলবে।"
-বড়মা,আমাকে মাফ করে দিও। শিবানী সত্যি খুব ভালো মেয়ে ছিল তবু আমি শিবানীকে ফেলে অঞ্জনার সাথে ঘর করছিলাম । তখন শিবানী লোকের বাড়ি কাজ করতে বেরোয়। অঞ্জনার কোলে মেয়ে আসে। ছেলে হয়নি বলে মেয়ে ফেলে পালালো সে। আমি মেয়ে নিয়ে শিবানীর দোরে রেখে আড়ালে ছিলাম। শিবানী দেখেছিল আমাকে তবু কিছু নাবলে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। আর পুরনো বস্তি ছেড়ে এই নতুন বস্তিতে ভাড়া নিয়েছিল। রুমকি আসলে রঞ্জনার মেয়ে। নতুন বস্তিতে সকলে ভাবে ও শিবানীর মেয়ে। ওই রুমকিও জানে শিবানী ওর আসল মা। আজ তোমাকে বললাম। কেন বললাম জানো! তোমার কাছে এসে শিবানী চোপা নাড়া ছেড়েছে। আগে মুখে মুখে বড্ড চোপা করতো। রুমকিকে ঘরে নিলেও শিবানী আমাকে ঘরের ভেতর ঢুকতে দিতো না তাছাড়া আমারও সাহস হতো না। যেদিন থেকে রুমকি আর শিবানী তোমার কাছে পড়াশুনো করতে লাগে সেদিন আমাকে একটা খাতা দিয়ে বলেছিল,-'লেখাপড়া করবে তো তুমি ঘরে ঢুকতে পারবে না হলে নয়। সত্যি বলছি বড়মা আমার রুমকি শিবানীর মতন খাঁটি মা না পেলে কবে এই মাতাল বাপের কাছে মরেই যেতো। আমি আজ নিয়ে তিন বছর মদ ছুঁইনি। তোমার সব পড়া করেছি। এখন আমি শিবানীর সাথে আর রুমকির সাথে ভালো আছি। তুমি আমাদের একটু দেখো।আমাদের রুমকিকে দেখো। ও যেন রঞ্জনার মতন না হয়, যে দুধের বাচ্চাকে ফেলে পালায় সে মা হওয়ার যুগ্যি নয়। আমি চাই ও যেন ওর এই মায়ের মতন হয়। আর চিরজীবন শিবানীকেই মা বলে জানে। আমাদের আশীর্বাদ করো বড়মা।"
সৃজনী মন দিয়ে শিবানীর বরের কথাগুলো শুনলো তারপর শিবানীকে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত রেখে বললো,-"তোর মধ্যে যে এতো সহনশীলতা আছে জানতাম না। তুই তো নারী জাতীর সন্মান!জন্ম না দিয়েও রুমকির আসল মা তুই। স্বামীর উপযুক্ত স্ত্রী। তুই তো শিবের শিবানী! তোরা ভালো থাকিস, সুখে থাকিস। আমি তোদের পাশে আছি আর থাকবো।"
****************************************
পূজোর সময় সৃজনী এক অষ্টমীর অঞ্জলী দেওয়ার সময় ছাড়া কখনো ঠাকুর দেখতে বেরোয় না। নবমী আর দশমীতে ঘরে নতুন নতুন মিষ্টি তৈরী করে। তবে দশমীর দিন পাড়ার প্যান্ডেলে মাদুর্গাকে বরণ করে বিজয়া উৎসবে যোগ দেয়।
আজ বিজয়া। অনুক্তারা দ্বাদশীতে কলকাতায় ফিরবে। অনুক্তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে সৃজনী প্যান্ডেলে বরণডালা হাতে মহামায়া দুর্গাকে বরণ করতে গেলো। আজ মাকে সামনের বছর আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আসবে। প্যান্ডেলে চেনা অচেনা সকল সধবার সিঁথি আর নোয়ায় সিন্দুর ছোঁয়িনোর পর্ব চলাকালে দেবী প্রতিমাকে লড়িতে তোলার প্রস্তুতি চলছিল। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা দেবীর হাতের অস্ত্র আর বাহনদের হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করছিল, দেবদেবীর পদ স্পর্শ করে মাথায় ছোঁয়াচ্ছিল। কেউবা দেবতার পায়ের ফুল সংগ্রহ করছিল। বছর পাঁচেকের একটা ছেলের লক্ষ্য ছিল কার্তিকের ময়ূরের ওপর। হয়তোবা ভাবছিল এই রকম ময়ূরের পিঠে যদি চাপতে পারতাম। সৃজনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব দৃশ্য দেখছিল আর ফিরে ফিরে নিজের ছেলেবেলাকার ভাবুক মনটাতে উঁকি মেরে আসছিল। একসময় সৃজনী কার্তিকের দিকে চেয়ে থাকা ছেলেটার কাছে গিয়ে কানে কানে বললো,-"তোর নাম কি কার্তিক?"ছেলেটা ওই দিকেই চোখ রেখে উত্তর দিল,-"না, দেবপ্রতিম।"
-"অমন একটা ময়ূরের পিঠে চাপার কি খুব ইচ্ছে হচ্ছে?"
--"কেনো, তোমার কাছে কি ময়ূর আছে?"ছেলেটা জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকালো।
-"নেই, তবে মহামায়াকে বলে দেখতে পারি।"
-"জানো, আমি দেখছি ওই তীর-ধনুকটা। ওটা থেকে কি সত্যি তীর ছোঁড়া যায়?
-"আমি তোকে তীর ধনুক দেবো।"
-"অত্ত বড় তীর ধনুক দেবে? আজই?' সৃজনী হ্যাঁসূচক মাথা নাড়তে ছেলেটার চোখদুটো খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
-" আজই চাই? দাঁড়া মহামায়া দুর্গাকে বলে দেখি। কোন বাড়িতে থাকিস তুই?" দেবপ্রতিম আঙুল তুলে সামনের হলুদ রঙের বাড়িটা দেখালো। সৃজনী দেখলো পাড়ায় অনেক নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে।বললো,-"যা এখন বাড়ি যা,আমি মহামায়া দুর্গাকে বলে আসি যে দেবপ্রতিমকে যেন আজই কার্তিকের মতন একটা তীর-ধনুক পাঠিয়ে দেন।" সে হাতজোড় করে দেবী প্রণাম সারলো।
সৃজনী বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি পুরনো ঝুলঝাড়ার সরু লাঠি থেকে সরু কঞ্চি কাটলো তারপর সেটা বেঁকিয়ে মোটা সুতো দিয়ে বেঁধে ধনুক বানালো। একটা পিচবোর্ডকে তিনকোণা কেটে সরু সর কঞ্চির ডগা ফাঁক করে আটকে গুটিকয়েক তীর বানালো। বাড়িতে রঙবেরঙের রাঙতা ছিল। বাচ্ছা ছেলের হাতে কঞ্চির চোঁচ না ফুটে যায় সেদিকে খেয়াল রেখে যত্ন করে সেগুলো রাঙতায় মুড়ে দিল। সৃজনী সেই তীর-ধনুক হাতে নিয়ে যখন পথে বেড়োলো দেব-দেবীর মূর্তি নিয়ে ব্যান্ড,বাজনা,আলো সহযোগে বিসর্জনের শোভাযাত্রা ওপাড়ার পদ্মপুকুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। পাড়ার মুখে আসতেই একটি বৌ কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে ছুটে এলো,-"সবাই বললো আপনার সঙ্গে আমার ছেলে কথা বলছিল...আমার ছেলে কোথায় বলুন, আমার ছেলে কোথায়....কোথায় নিয়ে গেছেন ওকে?"
সৃজনী অবাক হয়ে বললো,-"ওই হলুদ বাড়িটার ছেলে? দেবপ্রতিম নাম তার?'
-"হ্যাঁ-হ্যাঁ,দেবুকে কোথায় রেখে এসেছেন?"
বৌটি সৃজনীর কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করলো। চারিদিকে পাড়ার বৌ,মহিলা ভীড় করছে। সৃজনী বললো,-"ছেলেটা আজই একটা তীর-ধনুক চেয়েছিল,আমি দেবো বলেছিলাম । তাকে দেবো বলে এই এটা তৈরী করে আনলাম।" সে তার হাতে ধরা তীর -ধনুকটা দেখালো।-"এমনকি ছেলেটা আমাকে ওর বাড়িটাও চিনিয়ে ছিল। আমি বললাম 'বাড়ি যা' আর আপনারা বলছেন তাকে পাচ্ছেন না!"
.
একটি বৌ বললো,-"দেবু ? তাকে তো প্রসেশানের সঙ্গে যেতে দেখলাম।"এবার দেবপ্রতিমের মা সৃজনীর পায়ের কাছে আছড়ে পরল।-"মাসিমা আমার কি হবে!দেবুটার এই তিথিতে জলে ফাঁরা আছে বলে আমরা পূজোতে পুরী যাওয়ার টিকিট ক্যানসেল করলাম আর ছেলেটা সেই জলেই গেল!"সৃজনী তাকে টেনে হিঁচরে দাঁড় করিয়ে বললো,-"কি বলছো কি!"
-"দুর্গার ভাসান তো জলেই হবে, মা এমন মায়াবী যে আমার ছেলেকে সাথে করে নিয়ে গেল!"
সৃজনী এক ধমক দিয়ে বললো,-"ছেলেকে সামলে রাখতে পারোনি,সেই বিকেল থেকে একলা প্যান্ডেলে ছিল , একবারও খোঁজ নাওনি! এখন মহামায়ার দোষ দেখছো। সরো, রাস্তা ছাড়ো,আমি কথা দিয়েছিলাম মহামায়া দুর্গা আজই তাকে তীর-ধনুক দেবেন...মহামায়া কখনই মায়ায় ভুলিয়ে কারও প্রতি অন্যায় বা অনিষ্টের কাজ করবেন না বা হতে দেবেন না। আমি যাচ্ছি..." তীর-ধনুক হাতে ষাটোর্ধ সৃজনী তীর বেগ প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা যে পথে গেছে সেইদিকে ছুটলো। বেশীদূর পথ নয়, দুটো পাড়ার পর পদ্মপুকুর,ওখানেই মহামায়া দুর্গার বিসর্জন দেওয়া হবে। একটা পাড়া পেরোতেই সৃজনী দেখলো দেবপ্রতিম কার্তিক,গনেশ যে লড়িতে আছে তার পেছন পেছন হাঁটছে। সৃজনী তার কাছে গিয়ে তার হাতে তীর-ধনুকটা ধরিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,-" এতদূরে এলে কেন? মহামায়া দূর্গা তো আমার কাছে তোমার তীর-ধনুকটা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমি, তোমার মা-বাবা কতক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।"
-" মহামায়াও কি আমাকে খুঁজছিল?" বালক প্রশ্ন করলো। দেবপ্রতিমের মা আর বাবা ততক্ষণে সেখানে এসে পৌঁছলো। দেবু সৃজনীর কোল থেকে নামার চেষ্টাও করলো না। এতোক্ষণ অনেক হেঁটেছে সে। তীরধনুক হাতে শোভাযাত্রা র দিকে হাতজোড় করে নমষ্কার করে বললো,-" থ্যাঙ্ক ইউ মহামায়া দুর্গা।"
পেছনে তার বাবা মা দুজনেই মহামায়া দুর্গাকে প্রণাম নিবেদন করলো।
