"ঠাম্মা, চল না, আমার সঙ্গে খেলবে। আজ পুতুল খেলবে?" "ঠাম্মা, চল না, ফুল তুলব। তুমি আমাকে ফুলের গয়না তৈরি করে দেবে।" "ও ঠাম্মা, তুমি কিন্তু খাইয়ে দেবে আমায়।" " ঠাম্মা, চল না, আমরা ভূত সাজি! তারপর সব্বাইকে ভয় পাইয়ে দেব।" মৃণালিনীদেবীর ছেলেটিও কম নয়। " মা, ইলিশের সেই বিশেষ পদটা রান্না কর না, ছোটবেলার সেই স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে।" তাঁর বউমাও আব্দারে পিছিয়ে নেই। তাঁর গলা জড়িয়ে অভিমান করে বলত, "মা, তুমি কেবল তোমার ছেলে আর নাতিকেই ভালোবাস, আমি তো পরের বাড়ির মেয়ে।" এতদিন মৃণালিনীদেবীর দম ফেলার অবকাশ ছিল না। সকাল থেকে রাত সারা বাড়িটা হইহই করত, আনন্দের ঝর্ণা বয়েই চলত। কি করে যে সারাটা দিন রাত কেটে যেত, তিনি টেরই পেতেন না।
গতকাল ওরা সবাই ফিরে গেছে বিদেশে। আজ থেকে এত বড় বাড়িতে মৃণালিনীদেবী আবার একা। সময় তো নয়, মনে হয় যেন যুগ, কাটতেই চায় না। সমস্ত হইচই আজ স্তব্ধ। থমথমে বাড়িটায় ঘন নৈঃশব্দের মেঘ ঘিরে রেখেছে মৃণালিনীদেবীকে। দিন দিন অধৈর্য, অস্থির হয়ে উঠতে লাগলেন তিনি। কিছুই ভাললাগে না, কিছুই করতে উৎসাহ পান না। বয়স হচ্ছে তো, সন্তানকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে, বাকি জীবনটা তাদের সংস্পর্শেই কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে তো অবাস্তব ভাবনা। এই উন্নত জীবনযাত্রার কথা ভেবেই তো এত কষ্ট করে পড়াশোনা শিখিয়েছেন ছেলেকে। তাঁর চেষ্টা সফল করে আজ সেই ছেলে সফলতার চূড়ায়! অত দূরে থেকেও কিন্তু ছেলে তাঁর সমস্ত খেয়াল রাখে। বছরে একবার নিয়মিত আসে, তাঁকেও তো সেখানে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ বয়সে শিকড় ছাড়া হতে চাননি তিনি। আর কি চাই তাঁর! না, না! এভাবে মনখারাপের ফাঁদে পা দিতে মোটেও রাজি নন তিনি।
মৃণালিনীদেবীর পাশের বাড়িতে তনয়া ও মলয় তাদের তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে তিতলিকে নিয়ে থাকে। ওরা দুজনেই চাকরি করে। তিতলি থাকে আয়ামাসির কাছে। একদিন ওদের বাড়িতে তিতলির প্রচণ্ড কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে দোনামনা করতে করতেও শেষ পর্যন্ত মৃণালিনীদেবী চলেও গেলেন ওদের বাড়িতে । তিতলি দুধ খাচ্ছিল না, খালি বায়না করছিল বলে আয়ামাসি বিরক্ত হয়ে এমন চড় মেরেছে যে ঐটুকু শিশুর নরম গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। আর কোন কথা না শুনে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তিতলিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। তাকে আদর করে শান্ত করলেন, গল্প করে খাওয়ালেন, তারপর ওর সঙ্গে কতরকম বকমবকম করতে করতে কিভাবে যে গোটা দিনটা কেটে গেল ,বুঝতেই পারলেন না। সন্ধ্যে হল। তনয়া, মলয় ফিরে এসে সব শুনে তো থ। তিতলি তো কান্নাকাটি শুরু করে দিল, আয়ামাসির কাছে সে কিছুতেই থাকবে না। তনয়ারা তো খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি কি ব্যবস্থা করা যাবে! এই সময়ে মৃণালিনীদেবী সমস্যার সমাধান করলেন, "আমি তো একাই থাকি, তিতলি সারাদিন আমার সঙ্গে থাকলে আমার খুব ভালো লাগবে।" সঙ্কোচ ও দ্বিধা থাকলেও নিরুপায় হয়ে তনয়াদের এই ব্যবস্থাতেই রাজি হতে হল। এরপর মৃণালিনীদেবীর অর্থহীন দিনগুলো তাঁর কাছে এক নতুন আলোর সন্ধান এনে দিল। তিতলিকে রূপকথা শোনানো, গান, কবিতা শেখানো, তার সঙ্গে গল্প করা- এক নতুন জীবন পেলেন মৃণালিনীদেবী। আর তিতলি পেল ঠাম্মার স্নেহ, যত্ন। একদিন তনয়াই প্রসঙ্গটি তুলল মৃণালিনীদেবীর কাছে, " মাসিমা, জানেন, এ পাড়ায় অনেক বাড়িতেই এক সমস্যা- চাকুরিরত বাবা মায়ের বাচ্চারা আয়ামাসির কাছে মানুষ হচ্ছে। ওরা আমাকে বলে, ওদের বাচ্চারাও যদি তিতলির মত সুযোগ পেত....দিদা ঠাম্মার ভালবাসা পেত!! " শেষপর্যন্ত অনেক দোনামনা করে তনয়ার উৎসাহে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেন মৃণালিনীদেবী। নিজের বাড়িতেই বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে বাচ্চাদের থাকার ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাবা মায়েরা নিশ্চিন্ত আর বাচ্চারাও ঠাম্মা পেয়ে আনন্দে ডগমগ। আর মৃণালিনীদেবী? সারাদিন ঐ দুষ্টুমিষ্টি বাচ্চাগুলোর সঙ্গে গল্পে, গানে, আনন্দে কি করে যে সময় কেটে যায়, বুঝতেই পারেন না! ধীরে ধীরে মৃণালিনীদেবীর এই নতুন পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আরও অনেক বাচ্চারা তাঁর স্নেহছায়ায় আশ্রয় পায়।
এভাবেই কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। আজকাল মৃণালিনীদেবীর দম ফেলার অবকাশ থাকে না। এত বাচ্চাকে একা সামলাতেও পারেন না তিনি। কয়েকটি গরিব পরিবারের মেয়েকে রেখেছেন সাহায্য করার জন্য। ভদ্রস্থ কাজ পেয়ে তারাও বেঁচে গেছে। নইলে তো অভাবের তাড়নায় কবেই বুড়ো আধবুড়ো লোকের সঙ্গে তাদের বিয়ে দিয়ে দিত তাদের পরিবার! মৃণালিনীদেবী তাদের নৈশকলেজেও ভর্তি করে দিয়েছেন। ঐ অঞ্চলে মৃণালিনীদেবীর মতোই আরও অনেক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বসবাস। তাঁদেরকেও তিনি টেনে এনেছেন তাঁর কর্মযজ্ঞে। তাঁরা রোজ আসেন, বাচ্চাদের সঙ্গ দেন, নিজেদের একাকীত্বের ভার লাঘব করেন।
আজ মৃণালিনীদেবীর ছেলেও গর্বিত মায়ের জন্য। তিনি এই বয়সে পৌঁছে শুধু যে নিজস্ব জগত গড়ে নিয়েছেন, তা তো নয়, একাধারে যেমন তিনি ছোট ছোট বাচ্চাদের সন্ধান দিয়েছেন দাদু দিদা ঠাম্মার অনাবিল স্নেহ মমতার ভাণ্ডারের, তেমনি বয়স্করাও তাঁর হাত ধরে পৌঁছে গিয়েছেন নাতি নাতনির আব্দারের জগতে। আবার কিছু মানুষের রোজগারের ব্যবস্থাও তিনি করছেন।
ভালো থাকুন মৃণালিনীদেবী, তরতরিয়ে এগিয়ে চলুক তাঁর আনন্দ সংসার।
