অনেকক্ষণ ধরে চেম্বারে বসে এক এক করে রুগী দেখে যাচ্ছিলেন অনিমেষবাবু। যদিও সপ্তাহান্তে কয়েকঘন্টার জন্য তিনি গ্রামে ফ্রি সার্ভিস দিতে আসেন। তবে সকাল থেকে কয়েকটি চেম্বার সেরেই আসতে হয় তাকে। এই দিনগুলোতে অবশ্য হসপিটাল ডিউটি থাকেনা তাই বাঁচোয়া।
গ্রামের বেশিরভাগই গরিবগুর্বো খেটে খাওয়া মানুষ। অনিমেষবাবুর কল্যাণে ওরা তাও একটু চিকিৎসার সুযোগ পায়। শুধু এ গ্রাম কেন, আশেপাশের গ্রাম থেকেও অনেকে এসে ভিড় করে। প্রায় সন্ধ্যের মুখে একজন ক্ষয়াটে চেহারার লোক ছেলেকে নিয়ে ঢুকলেন।
"বসুন, কী হয়েছে?"
"এই যে ছেলের কয়দিন ধরে জ্বর ছাড়চেনা ডাক্তারবাবু।"
অনিমেষ ছেলেটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে নিলেন। রোগাটে চেহারা কিন্তু চোখদুটো ভীষণ উজ্জ্বল।
"তোমার নাম?"
"কানাই।"
পরীক্ষা করতে করতেই জিজ্ঞেস করলেন,'পড়াশোনা করো?"
"ডাক্তারবাবু ওইটেই তো দুশ্চিন্তার কারণ।"
অনিমেষবাবু কানাইয়ের বাবার কথায় ভারি আশ্চর্য হয়ে বললেন,"কেন!"
"ছেলের আমার ছোট থেকেই পড়াশোনার খুব ঝোঁক। গরিব মানুষ, দিন আনি দিন খাই। আর কত পারব বলেন তো। ছেলে এবার ইস্কুল পাশ দিইচে কী সব লেটার ফেটার নিইয়ে। এর পরেও পড়তে চায়। বললাম বেশ তো কলেজে ভর্তি হ। সে বলে ইঞ্জিরিং পড়বে। আমি কি অতোসত বুঝি? সে পড়তে হলে নাকি বাইরে যেতে হবে খরচও হবে মেলা। বলেচি আমার পক্ষে সম্ভব না। ছেলের জেদ, সবসময় মনমরা হইয়ে বসে আচে। এই করেই তো অসুখটা বাঁধাইচে।"
অনিমেষবাবু কানাইয়ের কাছে সব খুঁটিয়ে জেনে নিলেন। বুঝলেন, ওর মধ্যে সম্ভাবনা আছে প্রচুর। যা কানাইয়ের বাবা বুঝতে পারছেন না। কিংবা বুঝেও কিছু করার নেই হয়তো। মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগের কথা। এ যে তাঁরই প্রতিচ্ছবি!
************
"এই পিকলু, ওখানে কী করছিস!"
স্যারকে দেখে কাচুমাচু মুখে সামনে এসে দাঁড়াল পিকলু।
কমলেশবাবু বললেন,"তোকে এখানে এভাবে দেখব কল্পনাও করতে পারিনি! ভর্তি হয়েছিস?"
পিকলু মাথা নাড়ায়।
"বুঝেছি। চল দেখি তোর বাবাকে এখন বাড়িতে পাওয়া যায় কিনা।"
"বাবা হয়তো এতোক্ষন পানের বরজ থেকে এসে পড়েছেন। স্যার দয়া করে বাবাকে এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না।"
"কী বলব না বলব সে তোকে বলে দিতে হবে না। এখন চল।"
"বাদল... বাদল..."
হন্তদন্ত হয়ে বাদল বাইরে আসেন। হেডস্যারকে পিকলুর সঙ্গে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান।
"স্যার আপনি আবার কষ্ট করে... খবর পাঠালেই তো হতো।"
কমলেশবাবু সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ রে বাদল তোর যে খারাপ অবস্থা জানি। তাই বলে ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি না করে দর্জির কাজ শেখাবি?"
বাদল যেন আকাশ থেকে পড়ল। "দর্জির কাজ! স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি সেটা ঠিক। কিন্তু...! কিরে পিকলু?"
পিকলু কোনো কথা না বলে অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইল। দুচোখ বেয়ে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়তে থাকল। বাদল সবই বুঝলেন। বললেন,"ছেলে আমার খুবই চাপা। ভর্তি করতে পারিনি। তাতেও কিছু বলেনি। চুপচাপ বসে না থেকে সংসারের প্রয়োজনে দুটো রোজগারের আশায় নিজেই..."
"দেখ কোনো কাজই ছোট নয়। তবে পিকলুর মতো ছেলেদের এসব কাজ মানায় না। বলি কী তুই কষ্ট করে হলেও ওকে ভর্তি করে দে। বাকি বইপত্রের ব্যাপারগুলো আমি দেখছি।"
ফলে পিকলুর পড়াশোনা আবার শুরু হলো। কমলেশবাবুর সাহচর্যে ও সহযোগিতায় মাধ্যমিকের তুলনায় উচ্চমাধ্যমিকে আরো ভালো রেজাল্ট করল সে। কিন্তু তারপর? পিকলু ও তার ভাইবোন মিলে বাড়িতে অনেকগুলোই মুখ। পানের বরজে কাজ করে কতই বা আয় হয়।
এই পরিস্থিতিতে পিকলুকে বাইরে রেখে পড়াশোনা করানো বিলাসিতারই নামান্তর। তাছাড়া কমলেশবাবুই একমাত্র পথ দেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো অসুস্থ। ফলে পিকলু বাবার সঙ্গে পানের বরজে যাওয়া শুরু করল। পাশাপাশি দুএকটা করে টিউশনিও ধরল।
কিন্তু কমলেশবাবু মানুষটাই অন্যরকম। মাঝেমধ্যে সবার বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর করা তাঁর চাইই। একটু সুস্থ হতেই হঠাৎ একদিন পিকলুদের বাড়ি এসে হাজির হলেন।
"পিকলু... পিকলু..."
হাঁকডাক শুনে সবাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল।
"এই যে পড়াশোনা শিকেয় তুলে দিয়ে ভালোই মজায় আছিস। এই নে ধর।"
"এটা কী স্যার?"
"এটা জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফর্ম। আমার ভাই তার ছেলের জন্য এনেছিল। সে তো পাশ করতে পারেনি। ফর্মটা শুধু শুধু নষ্ট হবে তুই ফিলাপ কর। তারপর কপাল ঠুকেই দেখনা কী হয়।"
পিকলু ফর্ম পূরণ করে কমলেশ স্যারের সঙ্গে গিয়ে পরীক্ষাও দিয়ে এসেছিল। তবে ওই পর্যন্তই। বাড়ির যা পরিস্থিতি, পড়াশোনাটা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এই সারসত্তটা বুঝে গিয়েছিল। তাছাড়া সে কি আর সুযোগ পাবে? তাই এসব নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি।
কিসে সংসারে একটু সুরাহা হবে সেই চেষ্টাতেই থাকত সে। কিন্তু ভগবান হয়তো তার জন্য অন্যকিছুই ভেবে রেখেছিলেন। সেদিন সে বাবার সঙ্গে পানের বরজে পান তুলতে তুলতে হঠাৎ কমলেশ স্যারের বাজখাঁই গলার আওয়াজে চমকে উঠল।
"বাদল এখানেই আছিস নাকি? তোর বাড়িতে গেলাম। ওরা বলল, বসুন বাবাকে ডেকে আনছি। কিন্তু আমি তো আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। হা করে তাকিয়ে আছিস কীরে! মিষ্টি খাওয়া! পিকলু যে পাশ করেছে। ওর সামনে এখন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। শুধু লুটে নেওয়ার অপেক্ষা।"
বাদল ও পিকলু দুজনেই হা হয়ে যায়। বাদল খুব খুশি হলেও পরক্ষণে সব শুনে মুষড়ে পড়েন।
"মাষ্টারমশাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পিকলুর আরও ভাইবোন আছে, তাদের দিকটাও দেখতে হবে। ডাক্তারি পড়ানো যা খরচ আর সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সংসারটাকে আর টানতে পারব না। সব না খেতে পেয়ে মারা যাবে স্যার। গরিবের এতো স্বপ্ন দেখা ভালো নয়।"
"বাজে বকিস না। এই গ্রামে তোর ছেলের মতোন কেউ আর এই সুযোগ পেয়েছে বলতো? দেখ জীবনে সুযোগ বারবার আসেনা। একটু কষ্ট হবে ঠিকই। পরে ও সব পুষিয়ে দেবে। আমি তো চিনি তোর ছেলেকে।"
ফলে পিকলু আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। পড়াশোনায় ভালো হলেও বাড়ির অবস্থার দিকে তাকিয়ে তার স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে পারছিল না। বাদল পিকলুর মার সঙ্গে পরামর্শ করে ঘরের পেছনের কাঠালগাছটা বিক্রি করে দিলেন। কিন্তু পাড়াপড়শী ও আত্মীয়স্বজন বাদলকে সাহায্য ও সদুপদেশ দেওয়া তো দূরের কথা টোন টিটকারি শুরু করে দিল।
"হ্যাঁ রে বাদলা তোর ছেলে বলে ডাক্তার হবে, একথা কি সত্যি?"
"হ্যাঁ দাদা আপনাদের আশির্বাদে..."
"দ্যাখ বাদলা কথাটা আবার খারাপ ভাবে নিস নি।
ডাক্তার হওয়া কি মুখের কথা রে! তার খরচাপাতি আছে, তুই পারবি? আচ্ছা সে না হয় হলো। তোর ছেলে আবার শেষ পর্যন্ত পারবে তো? শেষে আবার একুল ওকুল দুকুলই না যায়।"
কেউ ঈর্ষায় হোক, কিংবা দায়িত্ব নেওয়ার ভয়েই হোক বাদলকে দেখলেই দুটো কথা শোনাতে ছাড়ত না। অবশ্য এসব কথা শুনে বাদলের এখন খারাপ লাগলেও তার জেদ আরও বেড়ে যায়। মনে হয় ছেলে যদি পারে সেও প্রাণপণ চেষ্টা করে যাবে। দরকার হলে একে একে সব বন্ধক দেবে। কে বলতে পারে এই ছেলেই হয়তো অনেক কিছু বদলে দেবে। দেখিয়ে দেবে সবাইকে আমরাও পারি।
পিকলু সত্যিই পেরেছে তার সমস্ত অধ্যাবসায় দিয়ে বাবার পরিশ্রম, বাড়ির আর সবার আত্মত্যাগের মূল্য দিতে। আর সবার ওপরে কমলেশস্যারের মুখরক্ষা করতে। আজ সে শহরের একজন নামী ডাক্তার।
কিন্তু পথটা মোটেও মসৃণ ছিলনা। হোষ্টেলের আর সবাই যখন ক্যান্টিনে চা এর আড্ডায় হাসি গল্পে মশগুল হয়ে থাকত সে বইয়ের পাতায় মুখ গুজে থেকেছে। সেজন্য তাকে কম টিটকারী সহ্য করতে হয় নি। তারা আর কী করে বুঝবে ক্যান্টিনের ঐ দামি খাবারের বিলাসিতা তার সাধ্যের বাইরে। শুকনো মুড়ি কিংবা কোনোদিন পেটে কিল মেরে সব ভুলে বইয়ের পাতায় মুখ গুজে থেকে অপেক্ষা করেছে দুপুর ও রাত্রিবেলার আহারের। শত কষ্ট হলেও বাবাকে সে বলেনি। বাবা যা পাঠিয়েছে তাই দিয়েই চালানোর চেষ্টা করেছে। অবশ্য একসময় এসে সবাই ওকে ভালবেসেছে। বাদলও বুঝতে পারতেন আরও কিছু পাঠালে ছেলের সুবিধা হয়। কিন্তু কী করবেন। এদিকে এক এক করে যে ঘরের টিন, মায়ের সামান্য গয়না, সংসারের আরও টুকিটাকি জিনিস বন্ধক দিতে দিতে চলে যাচ্ছে মহাজনের ঘরে।
"ডাক্তারবাবু আমরা তাইলে আসি।"
অনিমেষ চমকে তাকালেন। বললেন,"ওষুধগুলো ঠিকমতো খাবে। চিন্তা নেই। ঠিক হয়ে যাবে। একটু দাঁড়াও..." এই বলে আজ সকাল থেকে রোজগারের সমস্ত টাকা কানাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। একটা চেকও লিখে দিলেন। বললেন,"দরকার মতো তুলে নিও। এতে নিশ্চয় অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।"
কানাইয়ের দুচোখ খুশিতে চকচক করে উঠল। কানাইয়ের বাবা অবাক হয়ে বললেন,"এতো টাকা ক্যান দিলেন ডাক্তারবাবু? কিভাবে শুধব আমরা?"
"মনে করুন না আমি কারও ঋণ শোধ করলাম। এবার ছেলেকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিন।"
ওরা কিছু না বুঝতে পেরে হা হয়ে থাকল।
"আর কানাই নিজের স্বপ্নপূরণের পাশাপাশি বাবার স্বপ্নগুলো পূরণ কোরো। ভবিষ্যতে কাউকে যদি এরকম দেখো এইভাবে সাহায্য করার চেষ্টা কোরো কেমন? তাহলেই জানবে আমারও ঋণ শোধ হয়ে গেছে।"
অনিমেষের কথা শুনে কানাই হয়তো এবার কিছুটা আন্দাজ করলো। প্রণাম করে বলল,"আপনি খুব ভালো ডাক্তারবাবু! আমি অবশ্যই চেষ্টা করব।"
অনিমেষ উদাস হয়ে বললেন,"জানো কানাই আমার স্যার বলতেন বুদ্ধি, মন যাই বলিস না কেন সবকিছুরই উৎকর্ষতা বাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। কখনও থেমে যেতে নেই।"
আজ কমলেশস্যারের সদাহাস্য মুখটা খুব মনে পড়ছে পিকলু ওরফে অনিমেষবাবুর। জীবনে অনেককিছু পেলেও তিনি আজকের মতো তৃপ্তি ও আনন্দ কখনও পাননি। আজ যে কিছুটা হলেও তিনি গুরুর ঋণ শোধ করতে পেরেছেন। ওই মানুষটির সান্নিধ্যে ছিলেন বলেই তো আজ তিনি এইজায়গায়।
