সর্বংসহা নারী : ঈশিতা ভট্টাচার্য


 
" তুমি মা আমাকে 
পৃথিবীর এই আলো দেখিয়ে ছিলে ".
        কিশোর কুমারের কণ্ঠে এই বিখ্যাত গান শুনে আমরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হই যে , সন্তানকে পৃথিবীতে আনা থেকে শুরু করে  বিভিন্ন ঝড় ঝাপটার হাত  থেকে সন্তানকে আগলে রেখে  একটু একটু করে তাকে বড় করার যে বিরাট দায়িত্ব যে নিজের ঘাড়ে তুলে নেন , তিনি আর কেউ নন , তিনি আমাদের সকলের " মা "। ভালোবাসা , মায়া , মমতা দিয়ে আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখেন তিনি। মা তো মা-ই। তাঁকে যে নামেই ডাকা হোক না কেনো , সর্বত্রই তাঁর ভূমিকা এক-ই।  পরিবার তথা সন্তানকে সবদিক থেকে রক্ষা করাই মায়ের কাজ। 

        যে মা আমাদের ছোট থেকে বিভিন্ন শিক্ষাদানের মাধ্যমে তিল তিল করে বড় করে ,  নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয় , আমাদের উচিৎ সব কিছুকে সরিয়ে রেখে সবসময় সেই মায়ের পাশে থাকা । কিন্তু সব ক্ষেত্রে আমরা কি সত্যিই তা করি , না তা করার কথা ভাবি ? উল্টে যে কোনোকিছুর জন্য মা কে দায়ী করা থেকে শুরু করে মা কে রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে আসা , কোনোকিছুই আমরা বাদ রাখি না। 

    'মা' কিন্তু মা-ই হয়। তার কাছে , সন্তান সে, যেরকম ই হোক না কেনো , তাকে নিয়ে মার  সবসময় চিন্তা থাকে!  কি করে সন্তানকে ভালো রাখবে , এই চিন্তাই তাকে সবসময় ভাবিয়ে তোলে !  মুখে কিছু না বললেও অনেক মা নিজের  শারীরিক ও মানসিক কষ্টকে বুকে চেপে রাখেন সন্তানের মঙ্গলের জন্য। আর সেই সন্তান যখন বড় ও উপযুক্ত হয়ে মায়ের অস্তিত্ব নিয়ে,  মায়ের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ,  তখন সত্যিই মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। নিজের দেওয়া শিক্ষা নিয়ে মা  নিজেই নিজের কাছে জবাবদিহি চেয়ে বসে!

    'মা' সে শিক্ষিত হোক বা না হোক , রোজগেরে হোক বা না হোক সে তো মা- ই। মায়ের যোগ্যতা সে ' মা '। একজন মায়ের কাছে যখন একজন সন্তানের মূল্য শুধুই সে তার সন্তান , তবে একজন সন্তানের কাছে তার মায়ের মুল্য কেনো যোগ্যতা দিয়ে বিচার হবে ? এইখানেই মা আর সন্তানের পার্থক্য ! ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের মায়েদের এটাই চরিত্র। 

     আমাদের ই ঘরের মেয়ে দুর্গা বা উমা , যে নামেই ডাকা হোক না কেনো, মায়ের ভূমিকায় সেও এক ই। তাই তো প্রত্যেক বছর তার আসার অপেক্ষায় আমরা থাকি। সে এলেই আমরা সব সমস্যা থেকে মুক্তি পাবো , এই- ই সারাবছর ধরে আমরা ভাবতে থাকি। কারণ সে যে একাধারে  আমাদের ঘরের 'মেয়ে' আবার আমাদের 'মা'।  আজ যে মেয়ে , একটু একটু করে চোখের সামনে বড় হছে,  সেই তো একদিন মা হবে। সুতরাং আমাদের ঘরের মেয়েই তো আমাদের মা। তাই তো বলা হয় , আমরা মায়ের জাত। আমাদের অনেক বেশি সহনশীল , সহিষ্ণু পরায়ণ হতে হয়। 

       আমরা আমাদের মা দুর্গা কে এতো আবাহন করি , শ্রদ্ধা করি , কিন্তু তার সমপরিমাণ কি নিজেদের ঘরের মায়েদের করি ? এই প্রশ্নই  আজকের দিনে সবচেয়ে বড়ো করে দেখা দিয়েছে। আসলে আমাদের কাছে নিজের মা একরকম আর মা দুর্গা আরেকরকম। আসলে আমরা সবাই মা দুর্গার মতো করে নিজের মাকে কল্পনা করি। কিন্তু দুজনকে ভিন্ন নজরে দেখি। মায়েদের  বাইরের রূপ নয় , তাদের মানসিকতাই হলো আসল পরিচয়। সেখানে মা দুর্গা , আর আমাদের ঘরের মায়ের মধ্যে কোনোই তফাৎ নেই। তফাৎ শুধু  আমাদের চিন্তায়। মা , সে মা-ই। তার কোনো ভেদাভেদ  হয় না। আমরা যদি সবাই  এইভাবে ভাবি , তাহলেই কোনো সমস্যা হয় না। 

    আগেকার দিনে বলা হতো মেয়ে  যেন মা হওয়ার জন্যই জন্মায়। তর্কের খাতিরে যদি আমরা তা  নাও মানি, তবে আজকের মেয়েই যে কালকের মা এতো
 নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।

     মায়ের যে সর্বংসহা  রূপ আমরা দেখি , তা তো ভোলার নয়। হাজার ভিড়ের মধ্যেও আমরা আমাদের মাকে চিনে নিতে ভুলি না। তাই তো জন্মের পরে যে কোনো শিশু তার মাকেই প্রথম চিনে নেয়। কারণ মায়ের সাথে সন্তানের আত্মার সম্পর্ক। সে সম্পর্ক কখনও অস্বীকার করা যায় না। মাম্মি, মম , আম্মা বা মা, যে ভাষাতেই তাঁকে সম্বোধন করি না কেন , মা সে "মা-ই"। আমাদের চিন্তনে , মননে তার একটাই নাম , একটাই রূপ।

  মা দুর্গা যেমন অসুর বধ করে পুরো স্বর্গরাজ্য দেবতাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন , ঠিক তেমনি করেই মায়েরা সব বিপদ থেকে সংসারকে আগলে রাখেন। তাই তো বলা হয় মা ছাড়া সংসার অচল। মা নেই যে সংসারে , সেখানে ভয় বা বিপদ সদা জাগ্রত। মা সারদা যেমন করে জগতের সবার মা হয়ে জগৎসংসার কে আগলে রেখেছিলেন,  আমাদের ঘরের মা-ও দশভূজা হয়ে মা দুর্গার মতো সংসারকে আগলে রাখে। 

            আজকের নারী সে একাধারে প্লেন-ও চালায় , যুদ্ধজাহাজও চালায় আবার কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাকে তৈরি করে স্কুলে পাঠিয়ে বাড়ির সবার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে নিজেরটা গুছিয়ে কর্মস্থলে রওনা দেয়। পথে ঘাটে বিপদে সে আবার অসুর দলোনি দুর্গার রূপ ও ধারণ করে। নারী মানে 'মেয়ে' মানে 'মা' সে পারেনা এমন কোনো কাজ নেই। তাই তো সে ' নারী ', তাই তো সে ' মা ' আর সবে মিলে হলো 'মহামায়া দুর্গা ' ।



Post a Comment

Previous Post Next Post