একমাত্র ছেলে রনিকে সংসারী দেখার ইচ্ছায় পঙ্কজ বাবু ও বিমলা দেবী পাল্টিঘরে ছেলের বিয়ে দিলেন। শুরুটা বেশ ভালোই হয়েছিল! আর হবে নাই বা কেনো ? বৌমা অমৃতা রূপে লক্ষী গুণে সরস্বতী। তাই তো খুব সহজেই শ্বশুরবাড়িকে আপন করে নিতে পেরেছিলো। শাশুড়িও আহ্লাদে আটখানা। কিন্তু বাদ সাধলো অমৃতার একটা আচরণে। অমৃতা শিক্ষিত। সে শাশুড়ির অন্ধ কু সংস্কারের বিরোধিতা করে বললো , মা, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে নিজের নিয়মে ঘোরে। এই ঘোরার সময়ে নিয়ম মতো সূর্য কখনো পৃথিবী ও চাঁদের মাঝখানে আবার চাঁদ কখনো পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে আসে , তাই তখন আমরা তাকে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ বলি । এর সঙ্গে রাহু কেতুর কোনো সম্পর্ক ও নেই , আবার না খাওয়ারও সম্পর্ক নেই। ভূগোল নিয়ে স্নাতকোত্তর করা অমৃতার মুখে তো এমন কথাই শোভা পায়। এদিকে বিমলা দেবী ভাবতেই পারেন না যে , কেউ কোনোদিন তার মুখের ওপরে জবাব দেবে । অন্যদিকে অমৃতাও ভেবে উঠতে পারলো না যে সে কি ভুল বললো ? সে তো শাশুড়ি মাকে সঠিক টা বোঝাতে চাইলো! এতে তিনি এত রেগে গেলেন কেন ? আসলে দুই যুগের দুই নারী দুই ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
এতদিন ধরে শাশুড়িমার কথাই ছিল এ বাড়িতে শেষ কথা। রনি এবং তার বাবা তাই মেনে নিতে বাধ্য ছিল। এই প্রথম কেউ বাড়িতে এলো যে তার কথার প্রতিবাদ করলো ! এই অমোঘ সত্যটা মেনে নেওয়া বিমলা দেবীর পক্ষে সত্যি ই দুস্কর ছিল। তাই তো ছেলে বাড়ি ফিরলেই এর একটা বিহিত করতেই হবে , এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিমলা দেবী বসে রইলেন। আসলে এ হলো ব্যক্তিত্বের লড়াই। এতদিনের ঘুণ ধরা নিয়ম নিয়ে চলতেই শাশুড়িমা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যুগের সঙ্গে নিজেকে তাল মেলাতে তিনি যে মোটেই অভ্যস্ত হতে চান না। তাই তো বৌমার সঙ্গে এতো মতবিরোধ ! বৌমাও শিক্ষিত মেয়ে , সেও নিজের অবস্থান থেকে সরতে নারাজ। তার অন্যায় টা কোথায় সেটাই সে বুঝে উঠতে পারে না! সে আবার বদ্ধপরিকর এই ভেবে যে রনি ফিরে নিশ্চয়ই তার যুক্তিই মানবে। কিন্তু হায় ! এবাড়ির কেউ ই তো বিমলাদেবীর ওপরে কথা বলে না ফলতঃ অমৃতার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ সে মূহুর্তে ছিল না । মনে মনে বৌমার প্রশংসা করলেও পঙ্কজবাবুও মুখে কিছু বলতে পারলেন না। এই সামান্য ব্যাপার থেকে শুরু হয়ে গেলো শাশুড়ি - বৌ এর দ্বন্দ্ব। দিন কাটতে লাগলো আস্তে আস্তে অমৃতার সব কিছুই বিমলাদেবীর অপছন্দ হতে লাগলো। বৌমার খালি মনে হতে লাগলো সে তো শুধু সত্যি ঘটনাটা তুলে ধরতে চেয়েছে! তাহলে সত্যি বলা কি এই সংসারে অন্যায় ? নিজের স্বামীকেও সে পাশে পাবে না , এটা সত্যি প্রথমটায় তার বিশ্বাস হয় নি , পরবর্তীতে অবশ্য সব ই সহ্য হয়ে যায় তার।
তার তখন ছোটবেলায় পড়া আশাপূর্ণা দেবী রচিত " সুবর্ণলতা উপন্যাসের" কথা মনে পড়ে যায়। সেখানেও তো সুবর্ণর সত্যবাদী স্বভাব নিয়ে তার শাশুড়িমার সমস্যা দেখা
দিয়েছিল। শেষে অবশ্য ' সুবর্ণর ই জয় হয়েছিল। সুতরাং একদিন তারও জয় হবে, এই আশা নিয়ে অমৃতাও দিন কাটাতে লাগলো।
আসলে অমৃতা মনে হয় জানে না যে , সংসার হলো অচলায়তন । এখানে যে বা যারা সেই নিয়মভঙ্গ করতে চাইবে , তারাই রোষের মুখে পড়বে। এই শাশুড়িমা যখন নতুন বৌমা ছিলেন , তখন তিনিও তার সত্যবাদী স্বভাবের জন্য তার শাশুড়িমার রোষের মুখে পড়েছিলেন। নিজে যে ব্যবহার পেয়েছিলেন, তার কোনোরকম অন্যথা না করে নিজের বৌমার সঙ্গে এক ই অসঙ্গতি মূলক আচরণ বিমলা দেবী করেছেন। অর্থাৎ নিজে উনি যা পান নি , বৌমাকেও তা পেতে দেবেন না। এই সংসারের নিয়ম ই হলো , অনেক অন্যায় দেখলেও চুপ করে থাকতে হবে। কথায় বলে না , 'বোবার শত্রু নেই।' কতকটা তাই। কিন্তু পাশাপাশি যে মেয়েটি বৌমা হয়ে আসছে , সেও কিছু শিক্ষা নিয়ে আসছে এটা কিন্তু ধরে নিতেই হবে। তাকে কিন্তু সেই শিক্ষার নিরিখেই বিচার করতে হবে। সংসারের অচলায়তন ভেঙে সেই মেয়েটি যদি শাশুড়িকেও তার থেকে বের করে আনতে চায় অমৃতার মতো। তাতে ক্ষতি কি ? আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন , আমরাও যদি এক ই ধারা বহন করে চলি , তবে সমাজের উন্নতি হবে কি করে ? এটাই অমৃতা সেদিন তার শাশুড়ি মা কে বোঝাতে চেয়েছিল। যত দিন এগোল বিমলা দেবী নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরে অমৃতা কে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। শেষ জীবনে পৌঁছে অমৃতার শাশুড়ি যা বুঝতে পেরেছিলেন , আমাদের প্রত্যেকের ঘরের সবাই যদি এমনি করে সবকিছু
বুঝে নিতে পারেন , তবেই আমাদের মনের উন্নতি হবে , সংসারেরও মঙ্গল হবে। মনে রাখতে হবে বউ হয়ে যে মেয়েটি সংসারে এসেছে , সেও এই বাড়ির ই একজন সদস্য এবং তারও এই সংসারে কথা বলার অধিকার আছে। পুরনো ধ্যান - ধারণাকে পাল্টে নতুন কে জায়গা দিতে গিয়ে বৌমা যেনো পুরো সংসারকে রসাতলে না পাঠায় , সেটাও শাশুড়িমাকেই দেখতে হবে। সংসারে আসা নতুন মানুষটির সবসময়ে সমালোচনা না করে তার ভালো দিকগুলোর দিকেও আলোকপাত করতে হবে। তাকে এই বাড়ির যোগ্য করে তুলতে হবে এবং সর্বোপরি তার শিক্ষাকে মূল্য দিতে হবে। বৌমার বয়ে আনা মূল্যবোধকে যুক্তি দিয়ে বিচার করে গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি বৌমাদের ও অমৃতার মতোই শাশুড়িমার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি বজায় রেখে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বাড়ি তথা সমাজের উন্নতি করতে হবে। মনে রাখতে হবে সত্য সে চিরকাল ই সত্য। সুতরাং তার জয় হবেই। শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তবে ব্যতিক্রম সবেতেই আছে। তাই ধৈর্য্য ধরতেই হবে।
