ব্যক্তিসুখ : পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়


 

সানসোল, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, চিত্তরঞ্জন, ধানবাদ এলাকার অজয় নদের দুধারে  গড়ে উঠেছে বহু জনপদ, সর্পী, লাউদোহা, বালিজুড়ি,কেন্দুলি আর দিশেরগড়, সাকতোরিয়া, কোলিয়ারি এলাকা যেখানে খাদান থেকে কয়লা ওঠে । উন্মুক্ত প্রকৃতি, শাল, পিয়াল, মহুয়ার  জঙ্গল আর বিস্তীর্ণ প্রান্তর দিয়ে ঘেরা রাঢ়বঙ্গের এই খোলামেলা মালিন্যবর্জিত পরিবেশে বাস করে বেশ কিছু গরীব খেটে খাওয়া সাঁওতাল, মুন্ডা আদিবাসিরা, স্থানীয় বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম থেকে আসা কিছু মানুষ, যাদের বেশিরভাগ অশিক্ষিত কিন্তু পেটের টানে আসা আর হাতে গোনা কিছু শিক্ষিত মানুষ। এমনই একটি গ্রাম বালিজুড়ি। এই বালিজুড়িতে বাস নিবারণ ব্যানার্জী আর তাঁর পরিবারের। জ্ঞাতিগুষ্টি নিয়ে বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ পরিবার তাঁদের । নিজেদের কালীমন্দির আছে যেখানে নিত্যপুজো হয়। নিবারণবাবুর দুই ছেলে, সুরঞ্জন আর শুভাঞ্জন।নিবারণবাবু গ্রামের স্কুলের শিক্ষক কিন্তু চেষ্টা করছেন অন্য চাকরির। তাঁদের বর্ধিষ্ণু পরিবারে নিজেদের বসতবাটি, পঞ্চমুন্ডির আসন সম্বলিত কালীমন্দির, জমিজিরেত সহ ভদ্রাসনে সবাই শিক্ষিত পরিবারে, মায়ের মুখে শুনে বুদ্ধিমান ছেলেরা  সুন্দর করে আবৃত্তি করে "বীরপুরুষ", "খুকী ও কাঠবেড়ালি"। এমন সময় মাধইপুর কোলিয়ারিতে বেশ ভালো মাইনের চাকরি পেলেন নিবারণবাবু হিসাবরক্ষকের।সেখানে কোয়াটারও পেয়ে নিবারণবাবু সপরিবারে চলে এলেন।ছেলেরা তখন সুরো সাত আর শুভ দুই।সপ্তাহে  একবার করে বালিজুড়ি যাতায়াত রইল কারণ বাড়িতে বৃদ্ধ মাবাবা আছেন, ভাইয়েরাও খুব মান্য করেন নিবারণবাবুকে। 


কোলিয়ারির কোয়াটারে চলে আসার পরে সুরোকে ভর্তি করলেন স্থানীয় মিশনারি স্কুলে ক্লাস টুতে । শুভ তিন বছর হলে তাকেও সেখানে নার্সারীতে দিলেন। কিন্তু নিবারণবাবুর অন্য চিন্তা ছিল ছেলেদের নিয়ে, এরমধ্যে ছোট পুত্র দীপাঞ্জন বা দীপু হয়েছে । বড়োছেলের ক্লাস ফাইভ হতে তাকে ভর্তি করলেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কারণ কোলিয়ারি এলাকার পরিবেশ এবং শিল্পাঞ্চলের বাতাবরণ ভালো নয়, কাঁচা টাকা এখানে বাতাসে ওড়ে, তার নেশা যদি ছেলেদের ধরে তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এরমধ্যে তাদের বালিজুড়ি যাতায়াত রয়েছে বিশেষ করে  অমাবস্যায়, কালীপুজোর সময় যেতেই হয়, ছেলেরা  বেশ আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গিতে আবৃত্তি করে "লিচুচোর", " নকল গড় " কবিতা। ছেলেদের তিনি পাঠ্যবিষয়ের বাইরে অন্য অনেক বই পড়ার নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন।বালিজুড়ির মা অন্নপূর্ণা মন্দিরের ক্ষেপী মা সিদ্ধসাধিকা, বহু যোগবিভূতির অধিকারীণী তিনি। তিনি নিবারণবাবুর ছেলেদের বড়োই স্নেহ করেন, বলেছেন ছেলেরা নাকি মস্ত মানুষ হবে। নিবারণবাবুও সপরিবারে এই ক্ষেপীমাকে বড়ো শ্রদ্ধা করেন। 


সুরঞ্জন যে বছরে মাধ্যমিক দিল সে বোর্ডে তৃতীয় হল ।শুভ তখন সবে ভর্তি হয়েছে। দুই ভাইই মেধাবী, তবে সুরো অন্য ধাতুতে গড়া। উচ্চমাধ্যমিকেও সুরো ষ্টার পেয়েই পাশ করল ১৯৮৭ সালে, পেল ন্যাশনাল স্কলারশিপ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে ঢুকল প্রেসিডেন্সিতে। সেখানে মাস্টার ডিগ্রী করল, কিছুদিন মিডিয়াতে চাকরিও করল,  বসল কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় এবং প্রথমবারেই পাশ করে বসল হাওড়ার জেলাশাসক হয়ে। ক্রমে সে দুই চব্বিশপরগনারও জেলাশাসক হল এবং কলকাতার পুরসভারকমিশনারও হল, রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সে দক্ষ হাতে সামলাতে যখন ব্যস্ত,অতিরিক্ত মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, মুখ্যসচিব এবং রাজ্য ও কেন্দ্রের মন্ত্রী-সান্ত্রীদের, সে প্রেমে পড়ল এক বিখ্যাত লেখক ও বৈয়াকরণের মেয়ের এবং বিয়ে করল । তার বৌ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে ভাইস চান্সলার হলো। 


শুভও ভীষণ ভালো রেজাল্ট করে বেরোল নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ও প্রেসিডেন্সি থেকে বাংলায় মাস্টার্স করে এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটোতেই সেও ফার্স্ট ক্লাস পেল ।কিন্তু সে বেছে নিল জনসংযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রথমে কাগজ, পরে টিভিকে এবং আপন উপস্থাপনা ও উপস্থিতিতে হয়ে উঠলো একজন মিডিয়া আইকন। বেশ কিছু গণমাধ্যমের সে ছিল প্রধান এবং পরিচিত মুখ। 


বেশ কিছু বছর হলো ক্ষেপী মা দেহ রেখেছেন কিন্তু তাঁর ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেছে।দুইভাই দুজনেই আপন ক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্যের নিরিখে মস্ত মানুষই হয়েছে। তারা দুভাই আজও সময়ে অবসরে গিয়ে উপস্থিত হয় বাড়ির কালীপুজোতে বা কোনো অমাবস্যার পুজোতে কারণ বালিজুড়ি গেলে তারা ওপর থেকে সব কিছু দেখে না, হয়ে যায় সেই "লিচুচোর" আবৃত্তি করা সেই গাঁয়ের ছোট ছেলেটি যারা বড়োদের  আদর আপ্যায়ন, প্রশংসায় আজও আপ্লুত হয় আর নিজেদের শেকড়টা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করে।কিন্তু তাদের বৃত্তের মধ্যের মানুষ ছাড়া খুব কম লোকই জানে তারা আপন দুইভাই। জানলো যখন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা গেল শুভাঞ্জন আর সুরঞ্জন কলম ধরল ভাইয়ের স্মৃতিচারণে। মা থাকেন শুভাঞ্জনের পরিবারের সাথে, দীপাঞ্জন থাকে ব্যাঙ্গালোরে, সেও সেখানে বিশাল চাকরি করে। সুরঞ্জনের লেখায় উঠে এলো তাদের মফস্বলের জীবন। 


কিন্তু সুরঞ্জন ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করতে করতে ক্ষমতার অপব্যবহার নিজের ব্যক্তি স্বার্থে ভালোই করেছে।আটজন সিনিয়র অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আই এ এস -কে  টপকে চীফ সেক্রেটারী হয়েছেন ।কোনো  কলেজে কখনো না পড়িয়েই বউ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।রিটায়ার করার পর তিনবছর মাসে আড়াই লাখ টাকার উপদেষ্টা ।ছেলে পি এইচ ডি করার আগেই প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অর্থাৎ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ।ভাইয়ের দূর্ভাগ্য জনক মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীর ১,১০,০০০ টাকার সরকারি চাকরি।ভায়রাভাইকে পে কমিশন এর চেয়ারম্যান করেছেন  চার বছর মোটা টাকা মাইনে ও  বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছেন। সুরঞ্জনের ভায়রাভাইয়ের  স্ত্রী অর্থাৎ সুরঞ্জনের শালী বহু সিনিয়ারকে টপকে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছেন । সুরঞ্জনের গুণধর এক ভাইপো  আগে সি পি আই(এম)- এর MP ছিল। বালিশ চেটে দল পাল্টে এই মুহূর্তে শাসকদলে সুরঞ্জনেরই পরামর্শে ও বদান্যতায় । 


এইখানে তারা সাধারণ থেকে উত্তীর্ণ হলো অসাধারণত্বে, তাদের মেধার জোরে, পরিশ্রমের এবং বৃত্তির নিরিখে তাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে উত্তরণ ঘটলো অন্য এক আলোকবৃত্তে। কিন্তু সেই ঠাকুরের কথায় "শকুন যত উঁচুতেই উঠুক, নজর তার থাকে ভাগাড়ের দিকেই"। উপরমহলের ক্ষমতার সাথে সাথে বহু অপকীর্তিও তার রয়েছে। তাই আলোক বৃত্তে উত্তরণ হতে গিয়েও, অসাধারণ হতে গিয়েও সে সাধারণ, ক্ষমতালোভী আমলাই রয়ে গেল, মানব থেকে মহামানব আর হওয়া হলো না সমস্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ব্যক্তিসুখ আর পারিবারিক সুখকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে।

Post a Comment

Previous Post Next Post