প্রতিবাদ : সায়ন্তনী দাস ধর


 

        - " ও লক্ষ্মী, লক্ষ্মী....বলি কোথায় গেলি? আমাকে যে এবার কাজে বেরোতে হবে। তোকে খাইয়ে তবে তো যেতে পারব। আয় মা, আয়।" মায়ার হাঁকডাক শুনে খাটের তলা থেকে একগাল হাসি নিয়ে উঁকি দেয় লক্ষ্মী, " মা, আমি এখানে...." 

মায়া নীচু হয়ে মেয়ের হাত ধরে টানে। কিন্তু লক্ষ্মী কিছুতেই বেরোতে চায় না। তার এখন মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলার ইচ্ছে হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ টানাটানির পর হাল ছেড়ে দেয় মায়া, " আমি কি এত টানা হ্যাঁচড়া করতে পারি তোর সাথে? ঠিক আছে, আমি কাজে যাব না। কাজের বাড়ির বৌদি আমায় মারুক ..."

তাড়াতাড়ি খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আসে লক্ষ্মী, " না মা, এই যে আমি...তুমি কাজে যাও।" 

        মায়ার পনেরো বছরের মেয়ে লক্ষ্মী, শরীরের বয়স বাড়লেও মন তার শিশুকালেই আটকে রয়েছে। মানসিক প্রতিবন্ধী এই মেয়ে নিয়েই তার সংসার। লক্ষ্মীর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যত তার এই অক্ষমতা প্রকাশ হচ্ছিল , ততই তার বাবা রতনের ভয়ও বাড়ছিল। প্রথম প্রথম মৃদুস্বরে, ক্রমশঃ জোর গলায় সে মায়াকে পরামর্শ দিয়েছিল, " এ মেয়ে নিয়ে আমরা কি করব? বিয়ে দিতে পারব না, কখন কি বিপদ আসবে...তার থেকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসি।" 

মায়া রুখে দাঁড়িয়েছিল, " লজ্জা করে না তোমার? তুমি না ওর বাবা? কেমন বাবা তুমি, মেয়েকে বিসর্জন দিতে চাইছ?" 

মায়ার জেদের কাছে হেরে গিয়েছিল রতন। কিন্তু মায়া আর লক্ষ্মীকে ফেলে একদিন সে উধাও হয়ে গিয়েছিল। প্রথমটায় মায়া দিশেহারা হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে মেয়েকে একাই মানুষ করার ব্রত নিয়েছিল। পাশের বাড়ির দিদি তাকে লোকের বাড়িতে কাজ জোগাড় করে দিয়েছিল। সেই প্রথম তার বাড়ির বাইরে রোজগারের তাগিদে পা রাখা। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হত, কষ্ট হত। কিন্তু লক্ষ্মীর মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন জীবনের সঙ্গে  হাসিমুখে মানিয়ে নিয়েছিল সে। মানসিক প্রতিবন্ধী অসহায় মেয়েটাকে কি সে ফেলে দিতে পারে? সে যে মা! মেয়েটাকে সুস্থ করতেও তো হবে। লোকের বাড়িতে কাজ করে একটু একটু করে সে টাকা জমাচ্ছে, বড় ডাক্তার দেখিয়ে মেয়েকে একদিন ঠিক সুস্থ করে তুলবে।

       -" দিদি, মেয়েটা রইল, একটু দেখ।" পাশের বাড়ির দিদিকে ডেকে বলে মায়া। এভাবেই চলছে। কাজ থেকে ফিরে রান্না করে মা মেয়েতে খাওয়াদাওয়া করে, গল্প করে। মায়া ইস্কুলে চার ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। সেই জ্ঞান দিয়েই চেষ্টা করে মেয়েকে অক্ষর চেনাতে। লক্ষ্মীর ধৈর্য কম, সে পেনসিল দিয়ে লেখার চেয়ে সেটি চিবোতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু মায়ার ধৈর্য অসীম। সে হাল ছাড়ে না। 

-" শোন মায়া, আজ তো লক্ষ্মীকে দেখে রাখব। আমার ননদের বিয়ে পরশু। কাল আমরা সবাই শ্বশুরবাড়িতে চলে যাব সাতদিনের জন্য। কাল থেকে ওকে কোথায় রাখবি দেখ..." 

দিদির কথা শুনে মায়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, " ও মা! কি হবে গো! লক্ষ্মীকে কোথায় রেখে কাজে যাব। এ বস্তির কেউ তো ওকে রাখবে না!" 

-" এক কাজ করতে পারিস, সঙ্গে করে কাজে নিয়ে যা।" 

দিদির কথাটা মন্দ  নয়, অসুবিধা হবে খুবই, কিন্তু এ ছাড়া উপায় কি? 

        পরদিন মেয়েকে অনেক বোঝাল মায়া, "কাজের বাড়িতে কিন্তু একদম দুষ্টুমি করবে না, একজায়গায় চুপটি করে বসে থাকবে। ওখানে সবার কথা শুনবে।" একরাশ অস্বস্তি নিয়ে লক্ষ্মীর হাত ধরে কাজের বাড়িতে গেল সে। লক্ষ্মীকে দেখেই ঘোষগিন্নি অসন্তুষ্ট হয়ে বলে ওঠেন, " ও কি রে মায়া! ঐ পাগল মেয়ে নিয়ে কাজে এসেছিস? কাজ করবি না মেয়ে সামলাবি? দেখিস, আমার ছেলেমেয়েদের মারে না যেন..." 

চোখের জল চেপে মায়া বলে, " তোমার কোন অসুবিধা হবে না বৌদি, ও কিচ্ছুটি করবে না। একপাশে বসে থাকবে।" 

লক্ষ্মী চুপ করে থাকল বটে কিন্তু ও বাড়ির দুই দস্যি ছেলে মেয়ে তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে লাগল। মায়া সব দেখেও কিচ্ছুটি বলতে পারল না, পাছে তার কাজ চলে যায়! লক্ষ্মী আর সহ্য করতে না পেরে যখন তাদের তাড়া করল, ছেলেমেয়ে দুটি তাদের মাকে নালিশ করল, " মা দেখ, পাগলিটা আমাদের মারছে।" 

ঘোষগিন্নির রাগত দৃষ্টিতে ভয় পেয়ে মায়া লক্ষ্মীর পিঠে খান দুই কিল বসিয়ে দিল। তারস্বরে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল লক্ষ্মী। এমনসময় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ঘোষবাবু, " কেন বেচারিকে মারছ মায়া? আয় লক্ষ্মী, আমার ঘরে এসে বস।" 

-" যত্তসব আদিখ্যেতা!" রেগেমেগে রান্নাঘরে চলে যান ঘোষগিন্নি। মায়া কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকায় ঘোষবাবুর দিকে। 

               এরপর থেকে আর মায়ার চিন্তা থাকে না। লক্ষ্মী ঘোষবাবুর ঘরে বসে ছবির বই দেখে, লজেন্স খায়, বকর বকর করে। মায়া নিশ্চিন্তে কাজ করে। কদিনের মধ্যেই ঘোষগিন্নিরও একটু একটু দয়া হয় লক্ষ্মীর প্রতি। সেদিন যথারীতি ঘোষগিন্নি রান্নায় ব্যস্ত, মায়া বাসন মাজছে। এমনসময় ঘোষগিন্নি একবাটি পায়েস নিয়ে মায়াকে ডাকেন, " যা তো, লক্ষ্মীকে পায়েসটা খাইয়ে আয়।" 

মায়ার মুখে যেন আলো ঝলমলিয়ে ওঠে। সে পায়েস নিয়ে দোতলায় ঘোষবাবুর ঘরে যায়। ঘরের পর্দা সরিয়ে হাসিমুখে ঢুকেই যে দৃশ্য দেখে, তাতে তার হাত থেকে পায়েস বাটি মেঝেতে পড়ে যায়।  লক্ষ্মী বসে রয়েছে ঘোষবাবুর কোলে, আর ঘোষবাবুর নোংরা হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে তার শরীরের আনাচে কানাচে! মায়াকে দেখে ঘোষবাবু তাড়াতাড়ি লক্ষ্মীকে ঠেলে সরিয়ে দেন। লক্ষ্মী অবাক হয়ে বলে ওঠে, " মা, তুমি বলেছিলে সবার কথা শুনতে, আমি ঘোষজেঠু যা বলেছে সব শুনেছি তো!" 

হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে মায়া। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মেঝে থেকে বাটিটা তুলে সে ছুঁড়ে মারে ঘোষবাবুর দিকে। শোরগোল শুনে ঘোষগিন্নি উপরে উঠে আসেন। গিন্নিকে দেখে ঘোষবাবু মায়া ও লক্ষ্মীর নামে দোষারোপ করতে থাকেন। মায়া পাগলের মত মারতে থাকে ঘোষবাবুকে, " আমার মেয়ের এত বড় ক্ষতি করছিস তুই, তোকে আজ মেরেই ফেলব।" 

ঘোষগিন্নি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলেন। মায়া বলে, " আমি থানায় অভিযোগ জানাতে যাব। তোর মত শয়তানের শাস্তি যাতে হয়, সে ব্যবস্থা আমি করবই।" সে লক্ষ্মীর হাত ধরে দৃপ্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে যায়। সামনে অনেক কাজ তার...কিছুতেই অন্যায়ের সামনে মাথা নোয়াবে না সে।




Post a Comment

Previous Post Next Post