মাতৃরূপিনী : তপতী সাহা



"মা, এই শাড়িটা পরে আজকে অষ্টমীপুজোর অঞ্জলি দিতে যাবেন।"

অরুণা স্নান সেরে এসে ভিজে চুলে সুজয়ের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। বৌমারা আগেই ছবিটায় মালা পরিয়ে গেছে। পাশে ধূপদানিতে ধূপ জ্বলছিল। তৃষার কথায় পেছন ফিরে তাকালেন। তাঁর এই নতুন বৌমাটির কথায় মাঝে মাধ‍্যে এক প্রচ্ছন্ন শাসন লুকিয়ে থাকে। অরুণা অবশ্য এসব উপভোগই করেন। তৃষার কোন কথাই তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। শাশুড়ির সঙ্গে এই ছোট বৌমাটির সম্পর্ক নিয়ে বাড়ির অন্যদের মধ্যে বেশ কানাকানি হয়। বলে, মায়ের তো ওই একটিমাত্র বৌমা। আমরা তো আর কেউ নই।


কিন্তু আজ তিনি তৃষার অনুরোধ রাখতে অপারগ। 

সুজয় চলে যাওয়ার পর যদিও শক্ত হাতে এ বাড়ির হাল ধরেছেন তিনি। সুজয়ের ফেলে যাওয়া সমস্ত কর্তব‍্যকর্ম, ছেলেমেয়েদের যথাসাধ্য মানুষ করা, এ সবকিছুই নিষ্ঠা সহকারে পালন করেছেন তিনি। কিন্তু এই দিনটি... কালের নিয়মে সবাই হয়তো শোকতাপ ভুলেছে। কিন্তু তিনি আর ভুলতে পারলেন কই?

অরুণা পেছন না ফিরেই বললেন,"না বাছা, তোমরা যাও। আমায় আজ ছেড়ে দাও।"

"তাই বললে হয় মা। সবাই পুজোর মন্ডপে আনন্দ করবে। আর আপনি ঘরে বসে চোখের জল ফেলবেন; এ আমি হতে দেবো না।"

"লক্ষ্মী মা আমার। আমায় জোর কোরোনা।" 

তৃষা শাড়ির প‍্যাকেটটা বিছানায় রেখে শাশুড়ির দিকে এগোল। তার ইচ্ছে আজ জোর করে শাশুড়িমাকে পুজোর মন্ডপে নিয়ে যাবে। পেছন থেকে সৃজন এসে ওর হাতটা ধরে ফেললো; ইশারায় বারণ করে ওকে বাইরে টেনে নিয়ে এল।

"মাকে জোর কোরো না। মা যখন চাইছে না..." 

"কেন তোমরা মাকে এভাবে কষ্ট পেতে দাও।"

"মাকে আজ একটু একা থাকতে দাও তৃষা। সেই কোন ছোটবেলা থেকে দেখছি। এই দিনটিতে মা কারো সাথে কথা বলতে চায়না। একাই বাবার ছবির সামনে বসে থাকে। আমরা মাকে তাই বিরক্ত করতে চাই নি।"

"তাই বলে..."

"উহু আর কোন কথা নয়। চলো, তুমি অঞ্জলি দেবে বলছিলে না?"

তৃষা তবু যেতে যেতে মায়ের ঘরের দিকে পেছন ফিরে চাইতে থাকে। জন্মদাত্রী মায়ের কথা তার মনে নেই। এ বাড়িতে এসে তার শাশুড়ি মায়ের মাঝে এক নতুন মাকে খুঁজে পেয়েছে। অরুণাও তাকে মেয়ের মতোই কাছে টেনে নিয়েছেন। তৃষা মনে মনে বলে, তোমাকে আর একা একা কষ্ট পেতে দেবো না মা। তুমি দেখে নিও।


বাড়ির সবাই পুজো মন্ডপে বেরিয়ে গেলে অরুণা কান্নায় ভেঙে পড়ে। 

"কেন যাব আমি তোমার কাছে? এই দিনেই তো আমার সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছে বদমাইশগুলো। ওরা যখন মানুষটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছিল তখন কোথায় ছিলে তুমি? কী অপরাধ ছিল ওর? ও তো  তোমার মর্যাদা রক্ষা করতেই চেয়েছিল। এটাই কি অপরাধ! কই তুমি তো ওদের শাস্তি দিলে না। কোনও শাস্তিই তো হলোনা ওদের। বরং ওরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়। এসব আমি ভুলবো কী করে? এতবছর হয়ে গেল; তবুও স্মৃতিগুলো যে এখনও টাটকা। তুমি নিষ্ঠুর, নিষ্প্রাণ, পাথর; কিছুই দেখতে পাও না। মিছেই তোমার সবাই আরাধনা করে।"


কার্নিশে দুটো পায়রা ওড়াউড়ি করছিল। একটা কাক পাঁচিলের উপর থেকে অরুণাকে খানিকক্ষণ নজর করেই উড়ে গেল। অরুণা রাস্তার দিকে চাইলেন। একে একে সবাই পুজো দিতে যাচ্ছে। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা মায়ের হাত ধরে ঝুলোঝুলি করতে করতে আসছিল। নতুন জামা পরে ওরা পুজো দেখার আনন্দে খুশিতে ডগমগ। একটু যেতেই ওদের মা একজনকে কোলে তুলে নিলেন। অরুণার নিজের ছেলেমেয়েদের এই ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে গেল। ওরাও তো এইভাবেই... একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা থেকে সরে এলেন তিনি। উঠোন পেরিয়ে সদর দরজার ওপাশে কালী মন্দিরের দিকে তাকালেন একবার। তাঁর শ্বশুরমশায়েরও তিনপুরুষ আগের প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির। সুজয় চেয়েছিল এই মন্দিরে দূর্গাপুজোও  হোক। সে এক ইতিহাস রয়ে গেল।


বিছানায় তৃষার রেখে যাওয়া শাড়িটার দিকে দৃষ্টি পড়ল তাঁর। মেয়েটা আজ যেন তাঁর মনের ভিতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে। এমন করে জোরাজুরি করে! তিনি শাড়িটা হাতে তুলে নিলেন। 


সুজয়ের ছবির নীচে ধূপকাঠি গুলো ফুরিয়ে এসেছিল। তিনি আরো কয়েকটা ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রণাম করে বসলেন। কিন্তু আজ ধ‍্যানে বসে সুজয়ের মুখটা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে যে! সে জায়গায় তৃষা আর দুগ্গা ঠাকুরের মুখটা খালি ভেসে উঠছিল। সেই মূহুর্তে রাস্তা দিয়ে দুটো বুলেট গাড়ি পাড়া কাঁপিয়ে চলে গেল। অরুণার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল।


পুজো মন্ডপে অঞ্জলি দিতে গেলেও তৃষার মন পড়ে ছিল অরুণার কাছে। অঞ্জলি দেওয়া হয়ে গেলে তৃষা ঠাকুরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করল, মা, তুমি তো সবই জানো মা, সবই বোঝো,  আমার মায়ের মন থেকে সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দাও ঠাকুর। মা যেন সবসময় হাসিখুশি থাকে।


পুজো মন্ডপের আশেপাশে এর মধ্যেই মেলা বসে গেছে। নানারকম মনোহারি দোকান, চিনামাটির বাসনপত্র, বিভিন্ন ব্রতকথার বই, তৈজসপত্র, খেলনা, ঘর গেরস্থালির খুঁটিনাটি জিনিসপত্র কী নেই সেখানে। সবাই এটা ওটা জিনিস কিনতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ল। ছেলেপুলেরা বেলুন কিনবে বলে বায়না জুড়লো। তারা এখনই বাড়ি ফিরতে রাজি নয়। তৃষা পুজো শেষে প্রসাদ সংগ্রহ করেই বাড়ি ফিরতে চাইছিল।

"ঠিক আছে তোমায় আমি এগিয়ে দিয়ে আসি।"

এই বলে সৃজন তৃষাকে সঙ্গে নিয়ে মন্ডপ থেকে বেরিয়ে এল। দুজনেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিল।  আর খানিকটা এগোলেই বাড়ি। হঠাৎ কয়েকটা ছেলে মোটরবাইকে যেতে যেতেই কিছু অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে দিল। সৃজন বলল,"দিনে দুপুরে কেমন সাহস হয়েছে দেখো বদমাইশগুলোর?"

মোটরবাইকগুলোকে আবার ফিরে আসতে দেখে তৃষা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ওরা সৃজনের সামনাসামনি হল। 

"এই কী বললি আবার বল?"

"তার আগে বল, তুই কী বলছিলি?"

"সে তো বলবই, দাঁড়া তোর বৌটাকে আগে..."

কথা শেষ না হতেই সৃজন এক ঠাস করে চড় মারল ছেলেটাকে।"

"আরেব্বাস! এ তো দারুণ তেজ! এই ধরতো..."


"খবরদার! আর এক পা এগিয়েছো কী হাতদুটো কেটে নামিয়ে দেবো!"

যেন এক বজ্রপাতের মতো শব্দে ওরা সবাই চমকে তাকাল। অরুণার হাতে কালী মায়ের খাঁড়াটা ঝলসে উঠছিল। তাঁর ভাঁটার মতো জলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে ছেলেগুলো যেন চলৎশক্তি রহিত হয়ে গেল। কাছে এসে অরুণা ছেলেটির চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে মন্দিরের দিকে নিয়ে যেতে চাইলেন। খানিকক্ষণের জন্য সৃজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিল। সেও একটা ছেলের হাতদুটো ধরে পিছমোড়া করে নিল। অবস্থা বেগতিক  দেখে বাকি ছেলেরা মোটরবাইকে উঠেই চম্পট দিল।

অরুণার হাতের মুঠির মধ্যে ছেলেটা যেন কঁকিয়ে উঠল। "আমাদের ফেলে যাসনি ভাই।" অরুণার উদ্দেশ্যে কাতর কন্ঠে বলে উঠল,"মা আপনি যেই হোন, আমাদের ছেড়ে দিন। ভুল হয়ে গেছে। এমন কাজ আর কখনও করবো না।"

"শয়তান! তোদের আজ মায়ের পায়ের কাছে এনে ফেলা না অব্দি আমার শান্তি নেই।"

মায়ের এমন মূর্তি দেখে সৃজন ও তৃষা দুজনেই অবাক হয়ে গেল। এতো মনের জোর আর শক্তি মা কোথা থেকে পেলেন! এতোদিনের জমানো রাগ আর অভিমান কি মায়ের মধ‍্যে স্ফুলিঙ্গ হয়ে ধরা দিল? নাকি অন্য কিছু। তৃষার সামনে মন্ডপের মায়ের মুখ আর এই মায়ের মুখ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। মা যেন আজ শক্তি স্বরূপিনী হয়ে উঠেছেন। দেবী দূর্গা, দূর্গতিনাশিনী মা যেন সত্যিই সত্যিই নেমে এসেছেন ভুঁইয়ে। 

আশেপাশে তখন অনেক লোকজন জমে গেছিল। অরুণার এমন সাহস দেখে মেয়েরাও এগিয়ে আসতে লাগল।

সবাই বলল,"হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, ওদের মন্ডপেই নিয়ে যাওয়া হোক। সেখানেই ওদের বিচার হবে।"

কেউ বলল,"ওদের পুলিশে দেএয়া উচিত। ইদানিং এরা এই এলাকার মেয়েদের বড্ড উত‍্যক্ত করছিল।"


অথচ এরাই খানিক আগে গুন্ডামি দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। কেউ কেউ আবার ভয় পেয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল। অরুণা হাসল।

সেদিনও কেউ বিপদে এগিয়ে আসেনি। সাহায্য চাইতে গেলে ঝপাঝপ দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেদিন যদি কেউ একটু সাহস দেখাতে পারতো, মানুষটা হয়তো বেঁচে যেত। অরুণা ওদের হাতে ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। এতোক্ষন যা যা হলো ভেবে তিনি নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। কিভাবে মন্দিরে কালী মায়ের হাতে থেকে খাঁড়াটা তুলে নিয়েছিলেন। আর কিভাবেই বা ছেলেগুলোর সম্মুখীন হলেন। এ কি তিনি নিজে করেছেন! না তাঁর ভেতর থেকে অন্য কেউ করিয়ে নিয়েছে! তবে ওদের শাস্তি দিতে পেরে এতদিন পরে হলেও তাঁর মন খানিকটা তৃপ্ত হয়েছে। 

"মা, আমাদের ছেড়ে দিন মা। বলছি তো আর কখনও এমনটি করবো না। ওদেরকেও বলব এসব যেন না করে। মা দয়া করুন মা।"

"সত্যি বলছিস?"

"হ‍্যাঁ মা, আপনার পা ছুঁয়ে বলছি।"

অরুণা এক মূহুর্ত কী যেন ভাবলেন। 

"ঠিক আছে যা। মনে থাকে যেন।"

"সত্যিই আপনি জগজ্জননী মা। মন্দিরের দূর্গা মায়ের প্রাণ আছে কিনা আমরা জানি না। তবে আপনার মাঝে আজ আমরা দেবী মাকে প্রত‍্যক্ষ করলাম। আশির্বাদ করুন, আমরা যেন ভালো মানুষ হয়ে উঠি।"

"ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার তোরা আয়।"


"আপনি ওদের ছেড়ে দিলেন? জানেন ওরা কত খতরনাক ছেলেপুলে?"

"দেখুন সময়ে যেমন প্রতিবাদ করা উচিত, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমা করে দেওয়াও উচিত। আমাদের প্রতিবাদ তো খারাপের বিরুদ্ধে। ওদের ভিতর থেকে যদি খারাপটাই চলে যায়। তাহলে শাস্তির দরকারটা কি? মানসিকতার পরিবর্তনটাই তো আগে দরকার তাই না?"

আজ তৃষা ও সৃজন মাকে যত দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। ওরা কাছে আসতেই অরুণা বললেন, "মন্দিরের কাছেই তো চলে এসেছি; চলো মাকে একটিবার প্রণাম করে যাই।" 

তৃষা মাকে জড়িয়ে ধরল। "তাই চলো মা।"


তৃষার খুব ভালো লাগছিল। সে শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। আজ মাকে কত হাসিখুশি লাগছে। সত্যি সত্যিই মা আজ নতুন শাড়ি পরে মন্দিরের পথে চলেছেন। সব রাগ, দুঃখ, মান অভিমান সব ধুয়ে মুছে যাক। মা যেন শান্তি পান।


মন্দিরে মন্দিরে তখন ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হয়তো সন্ধিপূজার সময় হয়ে এল।




 

Post a Comment

Previous Post Next Post