মাতৃরূপেণ : সৌমি বোস


 

-'কি! কি বললে তুমি তোমার পক্ষে আমায় বিয়ে করাটা সম্ভব নয়?'


- 'না, আমার বাড়ির লোক তোমায় মেনে নিলেও তোমার ওই পাগল ছেলেকে কিছুতেই আমাদের ফ্যামিলিতে অ্যালাউ করবে না। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড অরু আমার সাথে থাকতে গেলে ডোডোকে তোমায় কোন অরফানেজে রেখে আসতেই হবে।'


- 'অসম্ভব। তুমিতো আমায় একদিন বলেছিলে ডোডোকে ছাড়া আমাদের ফ্যামিলি ইনকমপ্লিট হয়ে থাকবে।তাহলে আজ কেন এসব কথা বলছো?


- ' অরণ্যা প্লিজ ডোডো ডোডো করে কানের কাছে প্যানপ্যান করাটা বন্ধ করো। আমি তোমায় যা বলেছিলাম সেসব ভুলে যাও;ওটা কল্পনা আর এটা বাস্তব।'


দেখো অরু অন আ ভেরি সিরিয়াস নোট আমি আমার ফ্যামিলির এগেইনস্টে গিয়ে কোন কাজ করতে পারবো না। নাও দা চয়েস ইজ ইয়োরস।


- 'ও আচ্ছাআআআআ!


এখন আমি উঠি কৃষ্ণেন্দু। ডোডো বাড়িতে একা আছে। আমি আমার সিদ্ধান্ত তোমায় জানিয়ে দেবো।


আজকাল মার্চের দুপুরেও এমন ব্রহ্মতালু জ্বলানো গরম যে বোঝার উপায় নেই এটা মার্চ মাস না মে মাস। 'It's Break Time' কফিশপ থেকে বেরিয়েই সোজা স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করল অরণ্যা। রোজ এই রাস্তাটুকু ওড়না হেঁটেই যাতায়াত করে। অরণ্যার স্কুলের থেকে একটু দূরেই এই কফি শপটা।

বৃষ্টি বাদলার দিন হলে সে না হয় অন্য কথা নইলে শুধু শুধু এতগুলো টাকা রিকশা ভাড়া দিতে ওর বড্ড গায়ে লাগে। তার থেকে যাওয়া আসা মিলিয়ে যে ত্রিশ টা টাকা বাঁচে সেই দিয়ে ডোডোর জন্য দুটো দশ টাকার ডেইরি মিল্ক কিনেভ নেয়,আর বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার মোড়ে মিলন দার তেলেভাজার দোকান থেকে দুটো চপ কিনে নেয়; বাড়ি গিয়ে মুড়ি দিয়ে মেখে খাবে বলে। ডোডোটা একদম মুড়ি খেতে পারে না, নইলে তো মা ছেলে দুজনে একসাথে বসে চপ-মুড়ি খেতো।


সে বার তো ডোডোকে মুড়ি মাখা খাওয়াতে গিয়ে ওর গলায় শুকনো মুড়ি আটকে সে কি বিপদ। ছেলের চোখ উল্টে শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়; নেহাত সে যাত্রায় পাশের বাড়ির পরেশ কাকু,মানদা দিদি, রিঙ্কুর মা ওরা সবাই ঠিক সময়ে এসে গেছিলো বলে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিল,তার পর থেকে ডোডো যত বাই নাই করুক না কেন ওকে আর মুড়ি খাওয়ানো রিস্কটা নেয় না অরণ্যা।


অরণ্যা বেশ তাড়াতাড়ি বা চালাচ্ছে আর যে করেই হোক চারটে পঁয়তাল্লিশের রানাঘাট লোকাল টা  ধরতেই হবে এমনিতেই এই ট্রেনটায় ও খুব একটা যাতায়াত করে না ওর পছন্দ ৫টা ১৫র সুপার টা; সব জায়গায় দাঁড়ায়ওনা আর বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছেও যায়। তবে আজ ওর এক মুহূর্তও বাইরে থাকতে ইচ্ছে করছে না সবাই যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে, আর বলছে দুয়ো দুয়ো.........।


ট্রেনটা আসতেই অরণ্যা লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে গেল। আগে অবশ্য এত এই জেনারেল-লেডিস এইসব নিয়ে বাছবিচার ছিল না তবে ইদানিং যতই ভিড় থাকুক না কেন অরণ্যা লেডিস কম্পার্টমেন্টেই উঠবে। আসলে ইদানিং অফিস টাইমে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে কিছু মানুষ এত অসভ্যতা করে যে অরণ্যার মতোন মেয়েদের পক্ষে তিষ্ঠনোই মুশকিল হয়ে যায়। অরণ্যাও বেশ কয়েকদিন ব্যাপারটা ফেস করেছে,আর এরপর থেকেই তো ও এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। এই সময় ট্রেনটা বেশ ফাঁকাই থাকে, উঠেই ও জানলার ধারে একটা সিট পেয়ে গেল।


যাক বাবা একটা ভালো বসার জায়গা তো পেয়েছি-কথাটা বিড়বিড় করতে করতেই অরণ্যা  ওর শান্তিনিকেতনি রং চাটা ঝোলা ব্যাগটা ওর কোলের ওপর রেখে বসে পরলো। হাওয়ার দাপটে অরণ্যার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে  চুলগুলোকে হাত দিয়ে  সামলানোর চেষ্টা করছে ও। ট্রেনটা বেশ ঝড়ের গতিতেই এগোচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করলো ট্রেনটা ব্যারাকপুর পেরিয়ে পলতার দিকে ছুটছে। এই পলতা জায়গাটার সাথে অরণ্যার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। পরিতোষ আর ওর  ব্যাপারটা, মানে ওই ওদের সম্পর্কের ব্যাপারটা অরণ্যার বাড়িতে সকলে জেনে যাওয়ার পর থেকে তো বেশ কয়েকবার অরণ্যা সব্বাইকে লুকিয়ে এখানে এসে পরিতোষের সাথে দেখা করেছে। তারপর একদিন তো পলতার শ্রীপল্লি কালীমন্দিরে ওরা দুম করে বিয়েটা সেরে ফেলল।


প্রথমেই মেয়ের বাড়ির লোক মানেনি; ওই যা হয় আর কি। 


আসলে অরণ্যাটা পড়াশোনায় বড্ড ভালো ছিল তো, এইচএস-এ স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছিলো। শুধু কি তাই মেয়েটা যেমন ভাল নাচতো ঠিক তেমন সুন্দর ছিল দেখতেও। পাড়ার সব ফাংশনে অরণ্যার ডাক আসবেই আসবে। তাই ওর মা-বাবা ভাবতও কলেজ পাশ করে মেয়েটা নিশ্চয়ই কোন স্কুলে পড়াবে বা নাচ শেখাবে।


তখন আর কেইবা জানত সেকেন্ড ইয়ার করতে না করতেই ওই অঘটনটা ঘটিয়ে বসবে।


পাড়ার লোকে বলেছিলো-'সুন্দরী শিক্ষিত মেয়েদের ডানা সময় থাকতেই ছেঁটে দিতে হয়; নাও  ঠেলা সামলাও এখন।'


আসলে এই ঠেলাঠেলির মূলে যে কারা তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল ওর বাবা-মা।


পরিতোষ ছেলে হিসেবে মন্দের ভালো। ইট, বালি, পাথর, সিমেন্ট ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, পয়সা আছে ঠিকই তবে অরণ্যার যোগ্য নয়। পড়াশোনা টাও খুব বেশি দূর করেনি; তবে ব্যবসায়িক বুদ্ধি বেজায় পাকা, পৈতৃক ব্যবসা সামলানোর জন্য ওটুকুই যথেষ্ট।

অরণ্যা যে এইরকম হুট করে পরিতোষ কে বিয়ে করে ফেলবে এটা ওর বন্ধুরাও ভাবেনি; আসলে পরিতোষ আর অরণ্যের মধ্যে কখনো কোনো সম্পর্কও যে গড়ে ওঠা সম্ভব সেটাই ওরা কখনো ভাবেনি। শুধু কি তাই? অরণ্যা নিজেও এইসব ভেবেছিল নাকি কখনো! হুটপাট কোথা থেকে কি করে যেসব হয়ে গেলো বোঝাই গেলনা। সবই ওই বয়সের দোষ আর কি.....।

ওই যে কথায় আছে না ***************।' ও যদিও প্রথম এই কথাটা শুনে ছিল ওর বন্ধুদের কাছ থেকেই, ও যদিও তখন কথাটার মানেটা বোঝেনি তবে এখন মানেটা হাড়ে হাড়ে টের পায়।


আসলেই ওই বয়সটা ঐরকম; যা কিছু করা  নিষিদ্ধ তা গোপনে করার মজাটাই আলাদা, এই যেমন খারাপ কথা বলবে না, গালাগালি দেবে না, বাজে জিনিস দেখবেও না আবার শুনবেও না অথচ এই সমস্ত কিছুই বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে করে প্রায় সকলেই। 


অরণ্যা এখন আর খুব একটা গালাগালি দেয়না, মেয়েটা আগের থেকে বদলে গিয়েছে অনেকটা। আসলে ডোডো হওয়ার পর থেকেই ওর জীবনের আসল লড়াইটা শুরু হয়ে গেছিলো। ও যেদিন জানতে পেরেছিল যে ডোডো আর পাঁচটা বাচ্চার মতোন সাধারন নয়; স্পেশাল চাইল্ড, সেদিন একটা মুহূর্তের জন্যেও ঘাবড়ে গিয়ে ভয় পায়নি ও। বরং ডাক্তার কি বলেছিল- "কয়েকটা ক্রোমোজোমের হের ফেরে একটা মানুষকে কখনো সাধারণ অসাধারনের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না।"


ভেবেছিলো পরিতোষ ওর পাশে থাকবে, কিন্তু সেটা আর হয়নি। শুধু পরিতোষ কেন, ওর শ্বশুরবাড়ির কেউই ডোডোকে একসেপ্ট করেনি। বরং বছর কাটতে না কাটতেই বংশের নতুন প্রদীপ চাইতে শুরু করলো পরিতোষ। প্রথমে ব্যাপারটা আবদারে আটকে থাকলেও পরের দিকে এই ব্যাপারটাই জোরাজুরিতে পৌঁছালো। এদিকে অরণ্যাও নিজের সিদ্ধান্তে অনড়, ডোডো ছাড়া আর সেই মুহূর্তে আরো কোন কিছু নিয়েই ভাবার সময় নেই ওর কাছে। নিজের ছেলেকে ছাড়া তখন আর কোন কিছুই গুরুত্ব নেই ওর কাছে। তবে প্রথম থেকেই যে ও এরকম করেছে তা নয়, প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার বুঝিয়েছিলো কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।


এরপর একদিন বউকে খাওয়াতে খাওয়াতে হঠাৎ ওর শাশুড়ি এসে ঢুকে ওর কোন থেকে কার্যত ছিনিয়ে নিতে যাচ্ছিলো আর কী! ঠিক সেই সময়ই ডোডোর কাঁসার বাটি টা শ্বাশুড়ির মাথায় দিলো ঠুঁকে। মায়ের চিৎকার শুনে পরিতোষ আর ওর বাবা  পড়ি-মরি করে ছুট এলো। পাড়ার লোকেরা ও তখন যে যার বাড়ির জানলা দিয়ে উঁকি দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। এইরকম লাইভ মহিষাসুরমর্দিনী দেখার সুযোগ পাড়ার লোকেরাই বা হাতছাড়া করবে কেন?


ডোডো কে কোলে নিয়ে অরণ্যা সেদিন বলেছিল- "খবরদার! যদি তোমরা কেউ আমার থেকে ওকে আলাদা করার চেষ্টা করেছো তবে তোমাদের একদিন কি আমার একদিন, হাত-পা গুড়িয়ে রেখে দেবো বলে এই রাখলাম।"


অরণ্যা বেশ ভালই বুঝে ছিল এরপর আর ওর ওবাড়িতে কোন জায়গাযই হবে না। তাই ডোডোকে কোলে নিয়ে সেই দিন এক কাপড়ে শ্বশুর বাড়ি ছেড়েছিলো, সোজা গিয়ে উঠেছিল বাবার বাড়িতে।


মেয়েকে এই অবস্থায় দেখলে কোন বাবা-মার আর  মনের অবস্থা ঠিক থাকে; যদিও ওরা আর জোর করেনি অরণ্যা ঐ বাড়িতে ফিরে যাবার জন্য। বরং যেদিন ওরা জানতে পারলো অরণ্যা ডোডোকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেদিন ওরা বলেছিলো-"নিজের বাড়ি ছেড়ে, বাবা-মাকে ছেড়ে, শেষমেশ দাদুভাইকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে গিয়ে থাকবি মা?"


ও বলেছিল চিন্তা করো না মাঝেমধ্যে আমরা আসবো এখানে। তোমরা যখন খুশি তখন না হয় বাড়িতে গিয়ে আমাদের দেখে এসো, এরপর অবশ্য   আর ওরা জোরাজুরি করেনি।


মেয়েটা ঐ ছ-সাতটা মাস পাগলের মতোন খেটেছিলো: পার্টির মিটিং মিছিলে লোক জোগাড় করা থেকে শুরু করে দেওয়ার লেখা সবেতেই দিন রাত জেগে পরিশ্রম করে তবেই গিয়ে শিয়ালদায় ওই স্কুলের চাকরিটা জোগার করতে পেরেছে। অরণ্যা এই স্কুলের একজন নন টিচিং স্টাফ। মাইনে যে পায় তাতে মা-ছেলে দুজনেরই চলে যায় টেনেটুনে। ডোডোর ট্রিটমেন্টের সমস্ত খরচাপাতি  তো একা হাতেই সামলায়। ও স্বপ্ন দেখে ডোডোটা একদিন অনেক বড় হবে; আবার মাঝেমধ্যে ভাবে ছেলেটার যদি একটা বিয়ে দেওয়া যেতো তাহলে ব্যাপারটা দারুন হতো। আসলে সেই ছোট্টবেলা থেকেই ওর বড় সাধ ছিলো ও একজন ভালো শ্বাশুড়ি হবে। সত্যি বলতে কি স্বপ্ন দেখার মধ্যে একটা শান্তি আছে; তা সে স্বপ্ন যতই বাস্তব হোক কিংবা অবাস্তব।


" পরবর্তী স্টেশন রানাঘাট জংশন। শিয়ালদা-রানাঘাট রুটের এটি অন্তিম স্টেশন"-এই কথাটা তেই হঠাৎ ওর হুশ ফিরলো। এতটা রাস্তা কিভাবে টুক করে পার হয়ে গেলো যেন বোঝাই গেলো না।


উফ্ফ্ফ্ কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো আবার মাথায় আসছে, গলাটা কেমন জানি কান্নায় বুজে যাচ্ছে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই ডোডোর মুখটা আবার অরণ্যার চোখের সামনে ভেসে উঠলো; মুহূর্তেই সব মন খারাপের আর কান্না কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল।


সত্যি তো এই মুখটার দিকে তাকিয়েই আজ অবধি কত কঠিন লড়াই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছে ও; তাহলে আজই বা কেন হেরে যাবে? কৃষ্ণেন্দুকে জবাব দেবার উত্তরটা অরণ্যা খুঁজে পেয়ে গেছে, এবার অপেক্ষা শুধু সময়ের।



Post a Comment

Previous Post Next Post