এখনও ভোর হয়নি। ছাদে আরামকেদারায় আধ শোয়া অবস্থায় চোখ বুজে রয়েছে রঞ্জনা। সারা রাত তার ছাদেই কেটেছে।মনটা তেতো হয়ে রয়েছে। সবে ঘুম ভাঙছে পাখপাখালির।তারা নতুন উদ্যমে শুরু করছে একটা নতুন দিন। কিন্তু রঞ্জনার মনে হচ্ছে তার সামনে কেবলই অন্ধকার। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। চোখ বুজে সে মনে করছিল বিগত বছরগুলোর কথা।
মিষ্টি দুই যমজ মেয়ে তার, সিঞ্জিনী ও সঞ্জনা। ছোট থেকেই সিঞ্জিনী ছটফটে, দুষ্টু আর সঞ্জনা চুপচাপ, শান্ত, একটু মা-ন্যাওটা। সব কিছুতেই তার মাকে চাই।ছোট থেকে বড় হওয়ার দিনগুলোতে সিঞ্জিনী পেল অনেক বন্ধুবান্ধব। তাদের সঙ্গেই তার যত প্রাণের কথা।কিন্তু সঞ্জনার তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। মা-ই তার বেস্ট ফ্রেণ্ড। মনের আনন্দ, বেদনা সবকিছুই সে ভাগ করে নেয় মায়ের সঙ্গে। সিঞ্জিনী পড়াশোনায় তুখোড় কিন্তু সঞ্জনা তেমন চৌখস নয়। বুদ্ধি যে তার কিছু কম, তা কিন্তু মোটেই নয়। তার পড়তে ভালো লাগে না। যখন যে বিষয় তার ভালো লেগে যায়, সেটাই সে ভালোবেসে ভালো করে পড়ে। বাকি অপছন্দের বিষয়গুলো কোনমতে পড়ে। ফলস্বরূপ, রেজাল্ট খারাপ। দুই বোন একই ইস্কুলে একই ক্লাসে পড়াশোনা করলেও প্রতি বছর দুজনের জন্য দুরকম মতামত দেন ক্লাস-টিচার। প্রতি বছরই সিঞ্জিনীর প্রশংসা শুনে গর্বিত রঞ্জনা সঞ্জনার জন্য মুখ কালো করে বাড়ি ফেরে। অথচ সঞ্জনার কত গুণ! মায়ের মন বুঝতে তার জুড়ি মেলা ভার। মায়ের কখন মনখারাপ, কখন শরীর খারাপ- মায়ের মুখ দেখেই সে বুঝতে পারে। সবসময় মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখে সে। মায়ের সঙ্গে গল্প করে, হাতে হাতে কাজ করে দেয়, এমনকি মায়ের মনের কথাও সে পড়তে পারে। রঞ্জনারও তার এই মেয়েটির মনের সব খবর নখদর্পণে। শুধু ঐ! পড়াশোনাটা যদি একটু মন দিয়ে করত! রঞ্জনা খুব চিন্তায় থাকত তার এই মেয়েটির ভবিষ্যত নিয়ে। চিন্তা ছিল রঞ্জনার সিঞ্জিনীকে নিয়েও। তার মনের খবর তার বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানত না। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইহল্লা করা, ঘুরতে যাওয়া- এসব ছাড়া সে বাঁচতেই পারত না। কিছু বলতে গেলেই প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করত মা বাবার সঙ্গে। একটাই অস্ত্র ছিল তার হাতে, " আমি তো পড়াশোনায় ফাঁকি দিই না। আমার রেজাল্ট তো দারুণ হয়। তবে কেন তোমরা আমায় বকবে?" রঞ্জনা মেয়েকে বোঝাতেই পারত না, শুধু ভালো রেজাল্ট করলেই হয় না, চরিত্রগঠন বলেও একটা ব্যাপার আছে। পুরো ইস্কুল জীবন দুই মেয়ের দুরকম সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকত রঞ্জনা।
গতকাল মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। সিঞ্জিনী জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। আর সঞ্জনা কোনরকমে ফার্স্ট ডিভিসন। তারপরই রঞ্জনার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। সিঞ্জিনী যে আনন্দ এনে দিয়েছে রঞ্জনার জীবনে, তা ম্লান হয়ে গেছে সঞ্জনার রেজাল্টে। সঞ্জনাকে কোথায় ভর্তি করবে, ভবিষ্যত কি হবে- এসব ভেবে ভেবে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি রঞ্জনা। ছাদেই আরামকেদারায় সারারাত কাটিয়েছে। সঞ্জনাও মুখ চুন করে থেকেছে সারাক্ষণ। সিঞ্জিনীও নিজের খুশিটা বাড়িতে ভালো করে উপভোগ করতে না পেরে বেরিয়ে গেছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করতে। জীবন থেমে থাকে না। রঞ্জনা ব্যস্ত হল সংসারের কাজে। সারাদিন কেটে গেল একরকম। সারাদিনে সঞ্জনার সঙ্গে কোনরকম কথাবার্তা বলল না রঞ্জনা। সন্ধ্যেবেলা সঞ্জনাকে কাছে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে রঞ্জনা," দেখেছিস তো, পড়াশোনা ঠিক করে না করলে কি হয়! এখন কোথায় তোকে ভর্তি করি?" সারাদিন মায়ের সঙ্গে কথা বলতে না পেরে নিজেকে কম অপরাধী মনে করেনি সঞ্জনা। মায়ের স্পর্শ পেয়ে সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো, " আমি কি করব, বল মা? কিছুতেই আমার পড়ায় মন বসে না। পড়াগুলো আমার একদম ইন্টারেস্টিং লাগেনা। ঐ জন্য মনও বসে না।" রঞ্জনা বলে," যা রেজাল্ট করেছিস, সায়েন্সে তো সুযোগই পাবি না তুই। আর সায়েন্স নিয়ে যদি না পড়িস, তোর তো কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতই হবে না। " দিন কেটে যায়। ইতিমধ্যে নিজের ইস্কুলেই সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে সিঞ্জিনী। মুশকিল হয়েছে সঞ্জনাকে নিয়ে। কোনো ইস্কুলেই সায়েন্সে সে সুযোগ পাচ্ছে না। রঞ্জনার প্রায় মাথা খারাপ হবার জোগাড়। শেষ পর্যন্ত নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালো সে। নিজেকে বোঝাল, স্থিতধী হল। এতদিন মেয়েটাকে কম গালমন্দ করেনি সে। এজন্য নিজেও কি সে কম কষ্ট পেয়েছে! সায়েন্স না পড়লেই কি আর জীবন শেষ? আজকাল পড়াশোনার কত দিক খুলে গেছে। আগেকার দিন তো নয়, যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলে জীবন বৃথা! না! না! রঞ্জনাকে নতুনভাবে ভাবতে হবে। মনকে শান্ত করে ভাবতে থাকে রঞ্জনা। সঞ্জনা কম্পিউটারে তুখোড়। কম্পিউটারের কত রকম কারিকুরি যে তার জানা! ম্যাজিকের মত কত অসাধারণ সব কাজ সে কম্পিউটারে করে থাকে! মাকেই একমাত্র সে দেখায় সেসব। রঞ্জনা অবাক হয়ে যায়! সিঞ্জিনীও এ ব্যাপারে তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারে না! এসব মনে পড়ে যাওয়ায় কিছুটা নিশ্চিন্তবোধ করে রঞ্জনা। সে সঞ্জনাকে তার নিজের ইস্কুলেই ভর্তি করে দেয় কম্পিউটার ও আরও কটি বিষয় নিয়ে।
দেখতে দেখতে দু-বছর কেটে যায়। উচ্চমাধ্যমিকে সিঞ্জিনী খুবই ভালো ফল করে, ডাক্তারিতেও সুযোগ পেয়ে যায়। নিজের পছন্দমত বিষয় নিয়ে পড়তে পেরে সঞ্জনাও মন দিয়ে পড়াশোনা করেছিল। সেও উচ্চমাধ্যমিকে খুবই ভালো ফল করে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। তাকে নিয়ে আর চিন্তা নেই রঞ্জনার। কিন্তু এবার তার চিন্তা শুরু হয় সিঞ্জিনীকে নিয়ে। পড়াশোনায় তুখোড় হলে কি হবে! তার উড়োনচণ্ডী স্বভাব রঞ্জনাকে খুবই চিন্তায় ফেলে দেয়। ডাক্তারিতে ভর্তি হবার পর সে বাড়িতে ঘোষণা করে, " এবার থেকে আমি কিন্তু হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করব।" আকাশ থেকে পড়ে রঞ্জনা, "বাড়ি থেকে তো তোমার কলেজ অতটা দূরেও নয় যে তোমায় হস্টেলে থাকতে হবে!" ব্যাস, চেঁচামেচি শুরু করে দেয় সিঞ্জিনী," সবসময় তোমরা আমাকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখতে চেষ্টা কর।ভুলে যাও যে আমারও নিজস্ব জগত আছে।আমি বড় হয়ে গেছি। হস্টেলে থাকতে না দিলে আমি কলেজেই ভর্তি হব না।" সিঞ্জিনীর জেদ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা আছে রঞ্জনার। তার কথা মেনে নিতে বাধ্য হয় সে। কদিন পর হস্টেলে চলে যায় সিঞ্জিনী। মুখে তার একরাশ আলো। এতদিনে স্বাধীন হল সে। নিজের মত করে জীবন কাটানোর অধিকার পেল সে। সঞ্জনার পড়াশোনা খুব ভালোভাবে চলছে। মনের মত বিষয় পেয়ে সে মনপ্রাণ দিয়ে পড়াশোনা করে। তার লক্ষ্য বিদেশে যাওয়া। সেভাবেই নিজেকে তৈরি করছে সে।ওদিকে নতুন লাভ করা স্বাধীনতা সিঞ্জিনীকে অধঃপতনের পথে ঠেলে দেয়। পড়াশোনায় অমনোযোগী হতে থাকে সে। একের পর এক পরীক্ষায় খারাপ ফল করতে থাকে। কোনমতে পাশ করে সে।
কেটে যায় কয়েক বছর। সঞ্জনা বিদেশের এক নামী ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পেয়ে বিদেশে। এক ভোরে কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে রঞ্জনার। "এত সকালে আবার কে এল!" ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে চমকে ওঠে রঞ্জনা। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত, ক্লান্ত সিঞ্জিনী। "কি হয়েছে তোর?" কোন কথা না বলে সিঞ্জিনী সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। রঞ্জনা মেয়েকে চেনে।সে তাকে আর বিরক্ত করল না। দুপুরে খাওয়ার জন্য বারবার ডেকেও তার সাড়া না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেল রঞ্জনা। বিকেলের দিকে আবার মেয়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয় সে। অনেক পরে দরজা খোলে সিঞ্জিনী। রঞ্জনা ধীরে ধীরে মেয়ের মাথায় হাত রাখে," কোনদিন তো আমায় বন্ধু ভাবতে পারলি না। আজ অন্ততঃ বল, কি হয়েছে তোর! তোর এ অবস্থা দেখে আমার মনে কি যে হচ্ছে, তুই কি বুঝিস না? সবসময় আমি তোর পাশে আছি, সে তুই আমায় ভরসা কর বা না কর। এটুকুই বলব, একবার ভরসা করে দেখতে পারিস। হয়তো তোর সমস্যার সমাধান আমি করতে পারব।" সিঞ্জিনী এবার ভেঙ্গে পড়ে। অঝোরে কাঁদতে থাকে মাকে জড়িয়ে, " মাগো, বড্ড ভুল করে ফেলেছি আমি। এতদিন তোমাদের ভালোবাসা, শাসনকে ভাবতাম তোমাদের অনধিকারচর্চা। তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিলাম আমি। তাই হস্টেলে চলে যাই। আমারই এক সহপাঠী রাহুল। ওকে ভালোবেসে ফেলি আমি। ওর প্রেমের উদ্দামতায় ভেসে যাই আমি। কতগুলো বছর আমরা একে অপরকে ভালবাসলাম। কিছুদিন আগে ও আমায় জানিয়েছে যে, ও আমায় বিয়ে করার কথা ভাবেইনি কোনদিন! আমার সঙ্গে ঘোরা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না! ওর বিয়ে নাকি ঠিক করা আছে! বিয়ের পরই শ্বশুরের অবদানে ওরা পাড়ি দেবে বিদেশে।" এই পর্যন্ত বলে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে সিঞ্জিনী, কাঁদতে কাঁদতেই বলে," আমার তো কেরিয়ারটা প্রায় শেষ হয়ে গেল। আমি এতই খারাপ? আমাকে বিয়ে করা যায় না?" স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রঞ্জনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে। চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে জল তারও। ধীরেধীরে নিজেকে সামলায় সে। আজ আরও একবার পরীক্ষার মুখোমুখি সে। এ পরীক্ষাটাও তাকে আগের মতোই সফলভাবে উত্তীর্ণ হতেই হবে। মেয়েকে কাঁদতে দেয় সে। অনেক পরে কান্না থামায় সিঞ্জিনী। তার মাথায় হাত বুলিয়ে রঞ্জনা বলে," বাবা, মা কখনও সন্তানের ক্ষতি চায় না। তারা যা করে, সন্তানের ভালো ভেবেই করে। কিন্তু সন্তান বেশিরভাগ সময়ই ভুল বোঝে বাবা, মাকে। বাবা, মা- ই সেই জায়গা যেখানে মন খুলে সব কথা বলা যায়। কারণ জীবনের সব সমস্যার সমাধান বাবা, মায়ের কাছেই থাকে। আজ এটা তুমি বুঝেছ। দেখবে, এরপর তোমার জীবন এক নতুন পথে শুরু হবে। যে ভুল তুমি করেছ, তা আজ তুমি বুঝতে পেরেছ। তাই এবার থেকে নতুনভাবে জীবনটা শুরু কর। পুরোনো কথা ভুলে যাও। আর পিছনে তাকিয়ো না। সামনের দিকে তাকাও। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। নিজের জীবনটাকে শুদ্ধভাবে সাজাও। ঠিক সময় ঠিক মানুষ তোমার জীবনেও আসবে। এখন শুধু মন দিয়ে নিজের ভবিষ্যত সুরক্ষিত কর।" মাকে জড়িয়ে ধরে বলে সিঞ্জিনী, "আমি আর হস্টেলে ফিরব না, মা। আমি তোমার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করব, ঠিক আগের মতো। দেখো মা, আমি আবার আগের মতো দারুণ রেজাল্ট করব।" রঞ্জনা মেয়েকে কাছে টেনে নেয়। মনে মনে ভাবে, আজ থেকে তার দুই মেয়েকে নিয়ে আর কোন দুর্ভাবনা রইল না। চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। না, কান্না নয়, এ আনন্দের প্রকাশ।
