"তালাটা ঠিকমতো দিয়েছো তো? একবার টেনে দেখে নাও।"- শুরু হল মিস্টার সেনের বাতিক... সেন গিন্নি মুখটা বেঁকিয়ে তালা ধরে মারলেন জোর একটা টান- "হয়েছে? শান্তি? জ্বালানো-পোড়ানোর যম একটা..." গজগজ করতে করতে রিক্সায় উঠতে গিয়েই আবার বাতিক চাড়া দিল মাথায়। না না... এবার আর কর্তার মাথায় না। গিন্নির মাথায়- "সিলিন্ডারের নবটা বোধহয় খোলা..." রিক্সা দাঁড় করিয়ে চারটে তালা খুলে সবে রান্নাঘরে ঢুকেছেন, পেছন পেছন কর্তাও এসে হাজির- "এলাম... তোমাকে তো বিশ্বাস নেই... সিলিন্ডারের নব ঠিক করতে এসে দেখা যাবে তিনটে লাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে আসবে..." সেন গিন্নির আগুন চাহুনিকে অগ্রাহ্য করেই আবার বলা শুরু করলেন কর্তা- "না মানে তিনদিন ধরে তিনটে লাইট জ্বললে আমারও লাইট জ্বলে যাবে... লাল লাইট..." বাতিকের জেরে আর একটু হলেই দীঘার বাসটাও মিস হয়ে যাচ্ছিল। রায়বাবুর অনেক অনুনয়-বিনয়ে ওনার বাতিকগ্রস্ত বন্ধুর জন্য বাসটা দশ মিনিট অপেক্ষা করল বলে...
লেট করার জন্য পেনাল্টি পেয়ে সেনবাবু তো দারুণ খুশি... এমন পেনাল্টি পেলে কে না খুশি হন? গানের প্রতি বরাবরই ভীষণ ঝোঁক... বাসের ভরা সভায় সেই গান গাওয়ারই সুযোগ পেয়ে মিস্টার সেন আনন্দে একেবারে আত্মহারা। ধরেও ফেললেন গান... "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে... " - কিছুটা গেয়ে থেমেও গেলেন- "আবার প্রথম থেকে গাইতে হবে।" মিসেস রায়ের গলায় বিস্ময়- "সে কি! প্রথম থেকে গাইতে হবে কেন? থেমেই বা গেলেন কেন?" "ঐ আর কি... তালটা কেটে কেটে যাচ্ছে। লয়টাও ঝুলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আমি আবার নতুন করে শুরু করছি..." - সত্যিই নতুন করে গান ধরলেন মিস্টার সেন। ওনার কাণ্ডে সহযাত্রীদের মুখ টিপে হাসতে দেখে গা জ্বলতে শুরু করল সেন গিন্নির। মনে হল বুড়োটার গলা টিপে ধরে গানটা থামিয়ে দেন... পনেরো বারের চেষ্টায় গান সম্পূর্ণ এবং সম্পন্ন হল। শ্রোতাদের মধ্যে যাঁরা সাবাশ দিলেন, কোলাঘাটে বাস পৌঁছতেই তাঁরা পেলেন একলেয়ারস্...
কোলাঘাট থেকে বাসটা সবে ছেড়েছে... আর বিশেষ কিছু করার না পেয়ে সেন গিন্নি শুরু করলেন আত্মকাহন। ওনার ঠিক পেছনের সিটের যাত্রীটি বলেছিলেন -"চুলটা একটু বেঁধে রাখুন না... আপনার চুলগুলো তো আমার চোখেমুখে এসে পড়ছে…" কে একজন আবার বিড়বিড় করে বললেন- "এই বয়সে সাজের কি ধুম রে বাবা..." মিসেস সেন দ্বিতীয় ইন্দ্রিয় অর্থাৎ শ্রবণেন্দ্রিয় বরাবরই একটু বেশী সজাগ। বিড়বিড় করে কথা বলা মহিলার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলেন- "আজ্ঞে বলছিলাম বয়স বাড়লেই সাজগোজটা একটু বেশী করে করতে হয়। না হলে, যৌবনে তো কাকও সুন্দরী। এমন কম কাক তো দেখলাম না চোখে..." বাকী কথাগুলো বলা শুরু করলেন মিসেস রায়ের দিকে ঘুরে- "জানো তো মিত্রা, আমি না সাজলেই মামন রেগে যায়। সবসময় বলে, মা নিজেকে প্রপারলি মেইনটেইন করো। এই তো ঘুরতে আসব বলে হাবিবস্ থেকে চুল কাটিয়ে আনল। এত টাকা দিয়ে চুলটা কাটলাম গুটিয়ে রাখব বলে তো না... আমাকে সানস্ক্রিন লোশনও কিনে দিয়েছে জামাই। তোমার লাগলে আমার থেকে নিয়ে ইউস কোরো..."
বাস দীঘা পৌঁছতে অনেকেই বেশ লম্বা একটা শ্বাস নিলেন... বিশেষ করে যাঁরা সেন দম্পতির কাছাকাছি বসেছিলেন। শুধু শ্বাস নিতে পারলেন না মিসেস রায়... যে পাল্লায় পড়েছেন! গিন্নির চোখমুখ দেখে মিস্টার রায় প্রমাদ গুনতে শুরু করলেন। এমন বন্ধু আর বন্ধুপত্নীকে সফরসঙ্গী বানানোর অপরাধে ওনার গর্দানটা না গিন্নির হাতে চলে যায়! সমুদ্রস্নানে যাওয়ার আগে কেউ যে এত সাজে, মিসেস রায় এই প্রথম দেখলেন। আই-লাইনার, কাজল, লিপস্টিক কিছুই যে বাদ যাচ্ছে না। "কয়েকটা ছবি-টবি তো তুলব বলো? তাই একটু সাজলাম আর কি। তোমার কিছু লাগবে? তুমিও একটু মেকআপ করে নাও না..." সেনগিন্নির কথা শুনে মিসেস রায়ের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। কোন উত্তর না করে হাঁটা লাগালেন। মিস্টার সেনের স্নান তো মাথায় উঠল। বৌ-এর বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে তুলতেই চোখের নিমেষে সময় চলে গেল।
সেন দম্পতির নানাপ্রকার বাতিকের কারণে ঘোরার আনন্দটাই নষ্ট হওয়ার উপক্রম। জলখাবারে লুচি-তরকারি বলে রায়বাবুর সে যে কি সঙ্গীন অবস্থা। বন্ধু এবং বন্ধুপত্নী কনস্টিপেশনের কারণে লুচি ছুঁয়েও দেখলেন না। ওনারা না কি ময়দার কিছুই খান না। দুপুরেও মটনের বদলে ছিবড়ে চিকেন খেতে হল। রায়গিন্নি আবার চিকেন একদম পছন্দ করেন না... রায়বাবুর এক যাত্রায় পৃথক ফল কোনদিনই পছন্দ নয়। তাই অগত্যা... বিকেলে অমরাবতীতে পৌঁছতেও দেরী হয়ে গেল। ঐ যে সেনবাবুর ইয়ে আটকে গেছিল... ইয়ে হল... তারপর না বেরোনো হল।
রাতে সবে খেতে বসা হয়েছে, মিসেস সেনের মেয়ের ফোন... পাড়ায় না কি খুব চুরি হচ্ছে। গতকাল রাতেই না কি দুটো বাড়িতে বিরাট চুরি হয়েছে। বলা হয়নি... মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পাশের পাড়াতেই... "বলিস কি? সকালে যখন বেরোলাম, কিছুই তো শুনলাম না। শুনলে তো এখানে আসতামই না। তোর বাবাকে কবে থেকে বলছি একটা লকার অ্যারেঞ্জ করতে। করলে তো! আমার সব গয়নাই তো ঘরে!" - মিসেস সেনের হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। মিস্টার সেন ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন- "শোন, জামাইকে বল একটু আমাদের বাড়িতে যেতে। আজকের রাতটা বাড়িটা যদি একটু পাহারা দেয়। আমরা কাল ভোরেই রওয়ানা দিচ্ছি।" "জামাই কি বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দেবে? চাবি তো আমাদের কাছে।"- সেন গিন্নি গজগজ করতে লাগলেন। ফাঁপরে পড়ল মেয়ে। কেন যে খবরটা দিতে গেল- " ও তো আজ সকালেই দিল্লি বেরিয়ে গেছে। তাছাড়া চাবিও তো দিয়ে যাওনি। চাবি থাকলে না হয় আমিই গিয়ে থাকতাম।" মিস্টার সেন তাও বলে চললেন- "তোদের বাড়ির কাজের ছেলেটাকে বল যেতে। তালা ভেঙে ঢুকে যেতে বল। বাইরে থেকে পাহারা দিয়ে কোন লাভ নেই। এতগুলো এন্ট্রান্স বাড়িতে... আমরা ভোরেই রওয়ানা দেব। গাড়ি বুক করে নিচ্ছি।
যেমন কথা তেমন কাজ... কাকভোরেই রওয়ানা দিয়ে দিলেন সেন দম্পতি। এসেছিলেন তিনদিনের জন্য। একদিনের বেশী থাকা হল না। বাড়িতে লক্ষ লক্ষ টাকার গয়না... পাড়ায় একবার যখন চোর ঢুকেছে... আর চোরেদের কাছে সব খবরই থাকে। বাড়ি পৌঁছতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন... বাড়ির সামনে প্রচুর লোক। পুলিশও আছে। গয়নাগুলো তাহলে রক্ষা করা গেল না! মিসেস সেন গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলেন। মিস্টার সেন ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন। মেয়ের বাড়ির কাজের ছেলেটাকে স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে। গতকাল রাতে ছেলেটাকে তালা ভাঙতে দেখে পাড়ার ছেলেরা বেধরক পিটিয়েছে। ছেলেটার অবস্থা এখন যায় যায়। ইন্সপেক্টর বসুও ছেলেটাকে চোর বলেই ধরে নিয়েছিলেন। গোটাটা জানার পর প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন। বাতিক যে কি সাংঘাতিক একটা রোগ তা বোধহয় সেন দম্পতিও এখন বুঝেছেন। জীবনের এতগুলো বছর যে বাতিকগুলোর সাথে সহবাস করেছেন তাদের তো এত সহজে ঝেড়েও ফেলতে পারবেন না। অগত্যা... একজন সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করবেন বলে ঠিক করেছেন... দেখা যাক কি হয়।
