কি গো আর কবে যাবে বলতো ? চম্পার কথায় অপূর্ব খাবার থেকে মুখ তুলে দেখলো চম্পা তখনও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায় ! অপূর্ব কিছু বলার আগেই চম্পা আরও জোরের সঙ্গে বলে উঠলো , এবার কি সত্যি পুজোর কেনাকাটা করবে না ? আর কদিন বাকি বলতো ? এবার যে আর কিছুই ভালো পাওয়া যাবে না ! অনেক্ষন একটানা কথাগুলো শোনার পরে অপূর্ব এবার মুখ খুললো। তুমি তো জানোই আমি এইসব করি না। আমি সেদিনই পুজোর কেনাকাটা করবো , যেদিন পুজোকে কেন্দ্র করে রাস্তার ছেলে- মেয়ে গুলোর মুখে হাসি ফোটাতে পারবো! তুমি কখন যাবে বল, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। এই কথা শোনার পর চম্পা সত্যিই রেগে গিয়ে বলে উঠলো , রাস্তার বাচ্চাদের কথা তোমার মনে হয় , ওদের আনন্দের কথা ভেবে মন খারাপ করে ! আর তোতন , তোমার নিজের ছেলের আনন্দের কথা ভেবে খারাপ লাগে না ? তিন বছর বয়স হলো ওর একবারও পুজোয় ও ওর বাবিকে পায় না , ওর মন খারাপ হয় না ? অফিস যাওয়ার সময় কি শুরু করলে বলো তো ? এই বলে রাগে গজগজ করতে করতে অপূর্ব খাবার ফেলেই অফিস এ বেরিয়ে গেলো। যাহ্ বাবা এমন কি বললাম যে রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে হল ? সারাদিন চম্পা এটাই ভাবতে লাগলো। এতে তার সংসারের কাজকর্মও মাথায় উঠলো।
এদিকে অফিসে পৌঁছেও অপূর্ব কোনো কাজে মনসংযোগ করতে পারলো না। ওর খালি মনে হতে লাগলো চম্পার কথা শুনে এতখানি রেগে না গেলেই হতো। মনে পড়ে গেলো অনেক কথা। যেদিন চম্পাকে প্রথম দেখেছিল , সেদিনটা আজও ভুলতে পারেনি সে। কত সোজা সরল ছিল মেয়েটা! চম্পার সরলতাই অপূর্বকে ওর কাছাকাছি এনে দেয়।প্রথম দেখাতেই ভালো লাগা এবং প্রেম কিন্তু কেউই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে নি প্রথমটায়। মনের ভাব প্রকাশ করতে কেটে গিয়েছিল অনেকগুলো বছর । আসলে দুজনের দেখা হওয়ার সুযোগ তো ছিল না। একজন কলকাতায়, আর আরেকজন উত্তরবঙ্গে। ক্রমশ দেখা হওয়া থেকে শুরু করে বিয়ের পিঁড়িতে বসা পর্যন্ত সময়টা অবশ্য হঠাৎই হয়ে গিয়েছিল। আজ এতবছর পরে এতকিছু মনে পড়ায় অপূর্ব খুবই নস্টালজিক হয়ে পড়লো। ওর এতকিছু মনে পড়ার একটাই কারণ হলো এই প্রথম সে চম্পার সঙ্গে এত রূঢ় আচরণ করে বসলো। আসলে ও স্ত্রীকে যে কথাটা কোনোদিন বলতেই পারেনি , তা হলো গরীব মানুষগুলোর কথা ভাবলে অপূর্ব সত্যি নিজেদের পুজোর আনন্দর কথা ভুলে যায়। আর ঠিক তখনই এই কেনাকাটা করা , ভালোমন্দ খাওয়া - দাওয়া করা অর্থাৎ পুজোকে কেন্দ্র করে এইসব বিলাসিতা ও একেবারেই মেনে নিতে পারে না। আসলে ছোট থেকেই এই গরীব মানুষগুলোর জন্য অপূর্বর মন খুবই কাঁদে। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে ও ছোটবেলায় মার থেকে নিয়ে পাড়ার গরীব মানুষদেরকে দিয়ে আসতো। ওর দেখাদেখি ওর বোনও একই কাজ করতো।
আজ দুই ভাই - বোন ই যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু অপূর্বর ওই মানুষগুলোর জন্য ভাবনা এখনও যায়নি। তাই তো পুজোকে কেন্দ্র করে চম্পার কেনাকাটা করতে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে অপূর্ব এত আপত্তি তোলে। চম্পা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না যে, কেনো অপূর্ব একটা সামান্য বিষয়ে এত রেগে গেলো ?
অপূর্ব সেদিন খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে চম্পাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে গেলো। রাতে সে স্ত্রীকে সব কথা খুলে বলাতে চম্পা প্রথমটায় অবাক হলেও পরে নিজের স্বামীর জন্য খুবই গর্ব হল।
দুজনে মিলে ঠিক করল যে , ওদের পাড়ার গরীব মানুষগুলোর জন্য কিছু না কিছু নতুন জিনিস কিনবে । যেমন কথা , তেমনই কাজ। সেই মানুষগুলো পুজোর সময় নতুন জিনিস পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো । ওই মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে পেরে সেদিন বাড়ি ফিরে ওরাও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো।
আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে, যারা অন্যকে আনন্দ দিয়ে নিজেরা আনন্দ পায়। অপূর্ব ও চম্পা হলো সেরকমই দুজন মানুষ। যারা শুধু নিজেদের আনন্দের কথা না ভেবে অন্যদের আনন্দের কথাও ভাবে এবং তার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনাও করে।
আসলে পুজো হলো সবার আনন্দ করার মিলনক্ষেত্র। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে কিছু মানুষ এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে , এটা কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না। যেমন মেনে নিতে পারেনি অপূর্ব। সে নিজেও যেমন করে ছোট থেকেই এইধরনের মানসিকতা পোষণ করতো , ঠিক এমনি করেই সে তার তিন বছরের ছেলের মধ্যেও এই ধরনের মানসিকতা সঞ্চারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যত ভালো ভালো ধ্যান - ধারণা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চার করতে পারবো, তত আমরা আমাদের প্রচলিত রীতিনীতিকে বহন করে নিয়ে যেতে পারবো।
পরিশেষে বলি , পুজোর আনন্দ উপভোগ করার অধিকার আমাদের সবার। আমাদের সবারই উচিৎ সেই আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, ভাগ করে দেওয়া । তার জন্য আমরা প্রত্যেকেই যদি পুজোর সময় অন্তত নিজেদের খরচ - খরচা বাঁচিয়ে এই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর জন্য কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারি , তাহলেই আমরা পারবো সমাজের সবার মুখে হাসি ফোটাতে। সবাইকে আনন্দে সামিল করতে।
