"টিংটং...টিংটং..."
"উঃ এখন আবার কে এলো!'
অনিকেত তিতিবিরক্ত। সবেমাত্র তিনি হাত ধুয়ে খাবার টেবিলে বসেছেন। সাতটা পনেরো বাজে, আটটার বাসটা তাকে ধরতেই হবে। সাড়ে সাতটায় ঘর থেকে না বেরোলে খুব মুশকিল হয়ে যায়। পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ, এটুকু রাস্তা তিনি হেঁটে গিয়েই বাস ধরেন। টোটো রিকশা অনেক আছে, কিন্তু অনিকেত মনে করেন শরীর স্বাস্থ্যের জন্য একটু হাঁটাচলা করা ভালো। তাই একটু আগেই বেরোন তিনি।
ওদিকে রান্নাঘরে রুষা খুবই ব্যস্ত, যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন তাকেই এসব দেখতে হয়। সেই বা কী করবে, কোন ভোরবেলায় উঠে, সমস্ত গুছিয়ে সকাল সকাল রান্নাটা সারতে হয় তাকে। এসব দেখতে গেলে সেই বা কী করে গুছিয়ে খাবারটা দেয়। অনিকেত উঠল। রুষা খাবারটা টেবিলে দিয়ে বললেন," তুমি শুরু করো, দেরী হয়ে যাবে, আমি দেখছি।"
ওপর থেকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,"কে...? কোনরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন। দেখলেন, পাড়ার কয়েকজন মাতব্বর গোছের লোক দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে উঠতি বয়সের ছেলে ছোকরারাও আছে। এদিকে অনিকেত অফিসে বেরোবে তাড়াহুড়ো, তাই ওপর থেকেই মুখ বাড়িয়ে বললেন,"হ্যাঁ, বলুন?"
নীচের ওনারা বোধহয় এইরকম বাক্যালাপে প্রস্তুত ছিলেন না বা অভ্যস্ত নয়।
"বলুন মানে! দেখতে পাচ্ছেন না, আমরা পাড়া থেকে আসছি! পুজোর চাঁদা সম্বন্ধে কথা বলার ছিল, নীচে আসুন।"
"এখন একটু তাড়া আছে, পরে এলে হয় না?"
"আশ্চর্য তো! পরে মানে?আমাদের চেনেন না নাকি আপনি?"
"আজ অব্দি আমাদের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে নি?"
"আজ তো রবিবার। ভাঁওতাবাজি করার জায়গা পান না নাকি?"
ওদের সকলের বাক্যবাণে রুষা বিরক্ত হয়ে গেলেন। ভাবলেন, ভারি জ্বালাতন তো! ব্যস্ত আছি বললাম, এর পরেও আবার ব্যাখ্যা করে বলতে হবে !
বললেন,"দেখুন, আপনারা একটু ভদ্রভাবে কথা বলুন, তাহলে আমিও সেভাবে কথা বলতে পারব।"
"আপনার সাহস দেখে তো আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি! এ বলে কী!"
অনিকেত তাড়াতাড়ি খেয়ে কোনোরকমে হাতটা ধুয়ে নীচে নামলেন। "কী হয়েছে?"
"কী হয়েছে মানে? আপনার স্ত্রী তো ভীষণ অভদ্র, বাইরের লোকজনের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানে না।"
"বাজে কথা না বলে আপনারা কী বলতে এসেছেন সেটা বলুন না।"
"আরে, এ যে স্বামী স্ত্রী দুজনেই দেখছি ..."
একথায় অনিকেতের মেজাজ গরম হবার উপক্রম হলে। তবুও যথাসম্ভব শান্তভাবে বললেন,"দেখুন, আমাকে বেরোতে হবে। কাজের কথায় আসলে ভালো হয়।"
"আপনি কি রবিবারেও অফিস দেখাচ্ছেন নাকি মশায়? আমরাও চাকরি বাকরি করি।"
অনিকেত কোনো কথা বললেন না। তিনি বুঝতেই পারছেন এদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে যাওয়া মানে কথায় কথা বাড়ানো।
"হ্যাঁ, যা বলছিলাম আর কি। এবারের পুজোর চাঁদা আমরা পাঁচ হাজার করেছি।"
অনিকেত শুনে চমকে উঠলেন।
"কী, পাঁচ হাজার! গতবার ছিল তিন হাজার, এবার একলাফে সেটা হয়ে গেল পাঁচ হাজার! আপনারা পেয়েছেন কি বলুন তো? আমি তিন হাজারের বেশি দিতে পারব না। আগের বছর যা দিয়েছি তাই , এর একপয়সা বেশি দিতে পারব না।"
"দেখুন, পুজোর চাঁদা আমরা ঠিক করি। আর সবাই তা মেনেও নেয়। কেউ কোনো কথা বলে না। আমরা যা ঠিক করেছি তার কম কিছুতেই হবে না।"
"তাছাড়া আমরা এখানে পুজোর চারদিন ধরে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করি। অন্যান্য খরচও প্রচুর।
আর আপনি যে কম দেবেন, তারপর প্যান্ডেলে খেতে যেতে লজ্জা করবে না।"
এদের অবিবেচনাপ্রস্রুত কথা শুনে অনিকেতের আরও মেজাজ গরম হয়ে গেল। কবছর হল এখানে এসেছে। পুজোর সময় তো এখানে থাকেই না। খেতে যাওয়া তো দূর অস্ত।
বরং প্রতিবার চাঁদাটা নিয়ে ওরাই তো ফুর্তি করে। এবার যদি সেকথা ওদের বলেন! তিনি সেসব কিছু না বলেই বললেন,"আমার যা কথা তাই। পছন্দ না হলে আপনারা আসতে পারেন।"
"আমাদের চটিয়ে পাড়ায় থাকতে পারবেন তো?"
"আচ্ছা, দেখে নেবো পাড়ায় কিভাবে বাস করেন। এই আয় তো তোরা সব।"
রুষাও এইসব কথাবার্তা শুনে নীচে নেমে এসেছিলেন। বললেন,"ওগো, কী হবে এবার, ওরা যেভাবে শাসিয়ে গেল।"
"থামো তো, ওদের দৌড় আমার জানা আছে।
তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও। ধুর, মেজাজটাই দিল খিঁচড়ে। কত দেরি হয়ে গেল। আজ আর হেঁটে গেলে চলবে না। আমাদের অফিসও হয়েছে তেমনি, রোববারেও যেতে হচ্ছে!"
সারাটা দিন রুষার মন খারাপের মধ্য দিয়ে কাটল। সন্ধ্যাবেলায় অফিস থেকে ফিরলে অনিকেত বললেন,"ওরা আর এসেছিলো।"
রুষা ঘাড় নাড়লেন। "কী হবে গো? এবার তো এখানেই পুজোটা কাটাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু এদের যা রকম সকম। এবার পুজোটাই নিরানন্দে কাটবে দেখছি।"
"তো কী করব? ওদের সঙ্গে এখন জো হুজুর করে কথা বলব? সেটি পারব না আমি। চাঁদা তো দেবো না বলিনি, ওদের না পোষালে আমি কি করব?
আর অতো চাঁদা নিয়ে যদি কোনো ভালো কাজ করতো, তাও না হয় কথা ছিল। চারদিন ধরে ভাল মন্দ চর্বচোষ্য খেয়ে নিজেরা পেটপুজো করে। আর পেটি পেটি বোম পটকা নিয়ে এসে প্যান্ডেলে রাখে, ছেলেপুলে সেগুলো কদিন ধরে ফাটিয়ে কান ঝালাপালা করে। এই তো ওদের পুজোর আনন্দ।"
"অথচ দেখো আমাদের গ্রামে অল্প পরিমাণে চাঁদা নিয়েও ওরা কী সুন্দর প্যান্ডেল ও প্রতিমা করে।
আর তুমি দেখেছো তো ওর মধ্যে থেকেই গরিব দুঃখীদের পুজোয় নতুন জামাকাপড় বিতরণ,
আবার সবাইকে একদিন পেট পুরে খাওয়া দাওয়ারও ব্যবস্থা করে। "
"তাই তো গো, এদের তো দেখছি একেবারে মস্তান মার্কা কথাবার্তা। কোথায় এসে যে বাড়ি করলাম। সারাটা জীবন এদের মধ্যে কিভাবে কাটাবো গো!" রুষার কন্ঠ বেয়ে আফশোষ ঝরে পড়ল।
দেখতে দেখতে এদিকে পুজো এসে গেল। রুষা মুখে কিছু না বললেও মনমরা হয়ে বসে থাকেন। অনিকেত সবই বুঝতে পারেন। ষষ্ঠীর দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রুষাকে বললেন, "চলো, জামাকাপড় পরে রেডি হয়ে নাও।"
"কোথায়?"
"আহা, চলোই না।"
ওরা দুজনে বেরিয়ে বাজার থেকে বেশ কতগুলো জামাকাপড় কিনলেন। তারপর বাসস্ট্যান্ড ও স্টেশনের ধারে ফুটপাতে যেসব নিরাশ্রয় মানুষেরা শুয়ে বসে থাকে, তাদের দেখিয়ে অনিকেত বললেন,"ওদের দাও এগুলো।"
রুষা হা করে অনিকেতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
"দেখো আমরা পুজোর সময় সবাই কম বেশি আনন্দ করি। এরাই বা কেন সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। এদের কেউ নেই, আমরা সবাই যদি আমাদের আনন্দের সামান্যতম ভাগ এদের দিই মা তাহলে খুশিই হবেন। মা তো কারো একার নয়। মাতৃ আরাধনা মানে তো মাকে খুশিই করা। আমরা না হয় এভাবেই মায়ের পুজো করলাম।"
অনিকেতের কথা শুনে রুষার দুচোখ জলে ভরে এল। এভাবে তো সে ভেবে দেখেনি। এখানকার পুজো প্যান্ডেলে মেয়েরা সবাই শাড়ি, গয়না, সাজগোজ এসব দেখাতেই ব্যস্ত। যাদের একটু বেশি আছে অহংকারে তারা মটমট করে। যাদের কম আছে তারা একটু মিইয়ে থাকে। যেন একটা প্রতিযোগিত, কার কী কী হলো এই দেখাতেই ব্যস্ত। রুষার যে এগুলো সবসময় ভালো লাগে তা নয়। তিনি ভাবলেন, সত্যিই তো আমরা চারপাশে একবার তাকিয়েও দেখি না।
সেদিন রাত্রিবেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা শুতে গেলেন।
রাত তখন কটা হবে, ১টা কি ২টো, অনবরত কলিং বেলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। এত রাতে কে আবার! রুষার ভয়ে বুকটা ধুকপুক করতে লাগল। অনিকেত উঠে খুলতেই যাচ্ছিলেন, রুষা বাধা দিয়ে বললেন,"ওগো যেওনা, আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।"
অনিকেতের চিরদিনই ভয়টা একটু কম, বললেন,
"দাঁড়াও না, দেখতে হবে না, ভয় করলে চলবে।"
"দরজাটা একটু খুলুন না।"
কতগুলি কাতর কন্ঠের আওয়াজ শুনে অনিকেত বললেন,"মনে হচ্ছে, নিশ্চয় কেউ বিপদে পড়েছে। কোনো ভয় নেই।" অনিকেত রুষাকে আশস্ত করে দরজাটা খুলতে গেলেন। দেখলেন, চাঁদা তুলতে যারা সেদিন এসেছিলেন তাদের কয়েকজন এদের মধ্যে আছেন।
"কী হয়েছে?"
"আর বলবেন না, এই ছেলেটি চোখমুখ পুড়ে গিয়েছে। এদিকে পুজোর সময় তাও আবার এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাই। নেমপ্লেটে আপনার নামের আগে ডক্টর লেখা দেখি, তাই ভাবলাম যদি আপনি কিছু সাহায্য করতে পারেন।"
অনিকেত এখন অন্য পেশায় থাকলেও তার পড়াশোনা চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়েই। সন্মানের সঙ্গে তিনি পাশও করেছেন। কেন যে তিনি অন্য পেশায় গেলেন সে কথা এখন না বললেও চলবে। যাইহোক কমবেশি ডাক্তারির সরঞ্জাম বাড়িতেই মজুত থাকে তাঁর। তাই দিয়ে ছেলেটির প্রাথমিক চিকিৎসা করতে লেগে পড়লেন। ছেলেটির শরীরের ওপর দিকটা অনেকখানিই পুড়ে গেছে। সব শেষে মলম লাগাতে লাগাতে জানতে চাইলেন,"কী করে হল?
ছেলেটি বলল,"বোমটা ফাটছিল না দেখে, কাছে গিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। আর সেই মুহুর্তে..."
"থাক আর কথা বলতে হবে না, বুঝে গিয়েছি। এরকম আর কখনও করবে না কেমন।"
"সত্যি আপনি না থাকলে কী যে হতো! আগের দিনের খারাপ ব্যবহারের জন্য আমরা মাফ চাইছি।"
"ক্ষমা চাইতে হবে না। আপনারা যে বুঝেছেন, এটাই যথেষ্ট।"
"আমাদের পুজো মন্ডপে অবশ্যই আপনারা যোগদান করুন। সত্যিই আমরা ভুল করেছি।"
"এবার তো হবে না। যদি সামনেবার মন চায় দেখবো। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না যে। আপনারা এবার আসুন।"
"হ্যাঁ, চলরে সব। রাত্রিবেলায় আপনাদের আবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম।"
"না না ঠিক আছে, মানুষের বিপদে সাহায্য করা তো কর্তব্য।"
"আপনি যদি মন্ডপে না যান, বুঝব আমাদের ক্ষমা করেননি।"
"বললাম তো দেখবো।"
ওরা চলে যেতেই রুষা বললেন,"বাবা এ যে দেখি ভূতের মুখে রামনাম।"
"হ্যাঁ, বিপদে পড়লে সবার জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। চলো, রাত তো শেষ হতে চলল। আরেকটু শুয়ে নিই।"
রুষা বলল,"কালকে আমাদের কী প্রোগ্রাম? আচ্ছা পুজোর কটাদিন ওই লোকগুলোকে রান্না করে খাওয়ালে কেমন হয়?
"এতো খুব ভালো কথা। কিন্তু তুমি কি পারবে?"
"বেশি না, আট দশ জনের রান্না তো, করে নিয়ে যেতে পারব। তুমি একটু হেল্প করে দেবে।"
"দেখো যাওয়া আসার পথে ঐ মানুষগুলোকে প্রায়দিনই দেখি। অনেক কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও সবসময় এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাইনি। আজকে হয়তো মা আমাদের সাহস যোগালেন। তুমি এমনি করে সবসময় আমার সাথে থাকবে তো রুষা?"
রুষা অনিকেতের কাঁধে একটা হাত রাখে।
সেই শুরু, গত কয়েকবছর ধরে তারা এভাবেই করে আসছে। পুজোর কটা দিনে ঐসব মানুষগুলোর পাশে থেকে মুখে একটু হাসি ফোটাতে পেরে ওদের মন একটা অন্যরকম ভালোলাগা ও তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। প্রথম দিকে ছেলেমেয়েরা বিরক্ত হলেও, এখন ওরাও সাথ দেয়। এখন তো কয়েকজন সহৃদয় মানুষও ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
