অন্ধকারটা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে আসছে। কে একটা যেন দাঁড়িয়ে? হাতটা বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করতে যেতেই অবয়বটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।... চিৎকার করে উঠে বসলো বর্ষা। সারা গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। জলের গ্লাসের জন্য হাত বাড়াতেই দেখলো পাশে আদিত্য নেই। উঠে লাইটটা জ্বালাতে গিয়েও জ্বালালো না বর্ষা। কি হবে আর আলো দিয়ে। ঝলমলে আলোর মাঝেও যে নিকষ কালো একটা ভ্রুকুটি ওকে তারা করে বেড়ায় সর্বক্ষণ। শরীরে দমবন্ধ করা অস্বস্তি অনুভব করলেও সে আদিত্যকে ডাকলো না।
"কি হবে ওকে ডেকে। ওর করুনা পেতে আর ইচ্ছা করেনা। মানুষটা যে আমার বড্ড চেনা। আজ দুই বছর হলো ওই বারান্দা আর ব্যালকনি ওর রাতের ঠিকানা। আমার কাছে আসে আর কোথায় ! হয়তো এটাই আমার পাওনা ছিল। একদিকে সারাদিন সংসারের চাপা অশান্তি অন্যদিকে রাত্রে সেই অবয়বের হাতছানি... কিভাবে বাঁচবো আমি !"
ক্লান্ত মনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে ঘরের বন্ধ জানলাগুলো খুলে দিল বর্ষা। রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো এসে পড়লো ওর বিছানার উপর। এক চিলতে টিমটিমে আলোর দিকে তাকাতে তাকাতে বর্ষা ফিরে গেল তার ছোটবেলায়, যখন খেলা, খুঁনসুটি, ঝগড়া সবকিছুর সঙ্গী ছিল তার মাত্র দুই বছরের বড়ো দিদি বৃষ্টি।
শৈশব থেকে স্কুলজীবন অব্দি দিদির ছায়াসঙ্গী ছিল বর্ষা। মায়ের থেকে দিদিভাইয়ের প্রভাব অধিক ছিল তার জীবনে। কিন্তু বড়ো হওয়ার সাথে সাথে প্রাণাধিক প্ৰিয় দিদি কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করলো। বয়ঃসন্ধিকাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই বর্ষা লক্ষ্য করলো দিদির চেহারায় যেন আমূল পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে । শ্যামবর্ণা বৃষ্টির কাজলকালো আঁখি, একঢালা চুল সবাইকে আকৃষ্ট করতো। অমায়িক, মিতভাষী বড়ো মেয়েকে চোখে হারাতেন তার বাবা। সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা.. সবকিছুতে এগিয়ে থাকা বড়ো মেয়ের সাথে ছোটমেয়ের সর্বক্ষণ তুলনা করেই চলতেন ওদের মা।নিজেরই দুই সন্তানের মধ্যে বাবা মায়ের প্রতিনিয়ত বিশেষণের ব্যবহার বর্ষার মনে জন্ম দিল হীনমন্যতার। ক্রমে প্ৰিয় দিদি বর্ষার কাছে চরম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল।তবে দিদির সাথে সে কোনো প্রতিযোগিতা করেনি। কারণ, সে যে দিদির থেকে সর্বাংশে পিছিয়ে এটাই বর্ষা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। বলা ভালো করানো হয়েছিল।
এরই মধ্যে একদিন বৃষ্টি বর্ষাকে জানালা যে সে একটি ছেলেকে ভালোবাসে এবং ছেলেটিও তাকে। খুব শিগগিরই বাবা মাকে সে জানাবে। নাহ, আর সহ্য হলো না বর্ষার। দেখতে খারাপ বলে কোনো ছেলেই যে ওকে পছন্দ করে না সেটা বর্ষা ভালোই জানে। আর আজ ওরই চোখের সামনে দিয়ে দিদি ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করবে এটা যে সে কিছুতেই মানবে না। এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই বৃষ্টি আর আদিত্যর বিয়ে ঠিক হলো। দুই পরিবারের সবাই খুব খুশি। শুধু খুশি না বর্ষা। দিদির বিয়ের খবরে অন্তরে তার অসম্ভব জ্বালা শুরু হলো। দহন জ্বালা ঠান্ডা করার জন্য অবশেষে সে এক ফন্দি আঁটলো। বিয়ের আগের দিন..
" দিদি, তোর সাথে খুব দরকারি কথা আছে। তোকে জানানো খুব জরুরী। "
" কি হয়েছে বর্ষা? "
" দিদি, আদিত্যদা কিন্তু ভালো ছেলে নয়। ও তোকে ভালোবাসে না। "
" ধুর, কি যে বলছিস আবোল তাবোল। আদিত্য আমাকে ওর প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসে। "
" না রে.. আসলে আদিত্যদা আমাকে পছন্দ করে।কিন্তু আমি তো জানতাম তু্ই আদিত্যদাকে কতটা ভালোবাসিস। তাই যেদিন আমাকে ওর মনের কথাটা বলল, সেদিন আমি ওকে মুখের উপর না করে দিয়েছিলাম। সেই রাগে তোকে বিয়ে করার জন্য এতো তোড়জোড় করছে। আসলে এটা পুরোটাই নাটক। আমার কাছে আসার ছলনা মাত্র।"
ভালোবাসার এহেন প্রতারণা সহ্য করতে পারলো না বৃষ্টি। বিয়ের দিন ভোরবেলা বৃষ্টির নিথর দেহ পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় খালি একটা ঘুমের ওষুধের শিশি। পুরো ঘটনাটা একটা ধোঁয়াশার মতো ঠেকলো আদিত্যর কাছে। এমনটা হওয়ার যে কথা ছিল না। ক্রমশঃ নিজেকে একঘরে করে নিল আদিত্য। এদিকে বড়ো মেয়ের মৃত্যু শোক সহ্য করতে না পেরে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন বাবা। সংসারের ভার এসে পড়লো বর্ষার কাঁধে। অবস্থার পরিবর্তন যে এমন সাংঘাতিক হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেনি বর্ষা। আসলে কল্পনা এবং পরিকল্পনা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেনিয়মে চলে সে কথা আমরা মনেই রাখিনা। ঈর্ষা বা হিংসা গোটা একটা জীবনকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
বছর ঘুরলো। বর্ষার বাবার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হতে শুরু করলো। বৃষ্টির পরিবারের এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে আদিত্য ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। এমতাবস্থায় বর্ষার বাবা আদিত্যকে বর্ষাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। অনুনয় বিনয় করলেন ছোটো মেয়েকে গ্রহণ করার জন্য। কিছুটা দয়া করেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেল আদিত্য। বর্ষা যেন হাতে চাঁদ পেলো। এতদিনে বুঝি সে দিদিকে হারাতে পারলো।
ফুলশয্যার রাতে আদিত্য বর্ষাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে তার মনে স্ত্রীয়ের মর্যাদা শুধুমাত্র একজনই পাবে সে হলো বৃষ্টি। কর্তব্যের বাইরে বর্ষার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।
নিজের দিদিকে মৃত্যবরণ করতে বাধ্য করলেও বর্ষার মনে সর্বক্ষণ জয়ী হবার অহংকার কাজ করতো। কিন্তু এখন সে প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারছে যে আদতে চূড়ান্ত হারটা তারই হয়েছে।খুন করার অপরাধবোধ এখন সর্বত্র তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় । আয়নায় তাকালে মনে হয় উল্টো দিকে তার দিদিরই প্রতিবিম্ব। যে প্রশ্ন করে, "কি রে, শান্তিতে আছিস তো ! "
