সেনগুপ্ত বাড়িতে আজ মহা ধুমধাম। এ বাড়ির একমাত্র ছেলে অঙ্কুরের বিয়ে উপলক্ষে সমস্ত আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি সব্বার নেমন্তন্ন। সুবিমলবাবু সমানে হাঁকডাক করে ব্যস্তসমস্ত পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।বিম্ববতীদেবীও সমান ব্যস্ত। আর এ বাড়ির প্রথম সন্তান কাজললতা তার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে প্রায় মাসখানেক ধরে এ বাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে। বিয়ে একদিনের, কিন্তু আনন্দধারা বয়ে চলেছে একমাস ধরেই।
অষ্টমঙ্গলা কাটিয়ে রনিতা যখন শ্বশুরবাড়িতে ফিরে অঙ্কুরের সঙ্গে একটু থিতু হল, ততদিনে আত্মীয়স্বজনেরা সকলেই যে যার বাড়িতে ফিরে গেছে। কেবল কাজললতা রয়ে গেছে তার ছোট্ট মেয়ে তিতলিকে নিয়ে। রনিতার এবার বাড়ির লোকদের আপন করে নেবার পালা। রনিতাকে অবশ্য কোনো চেষ্টাই করতে হল না। কাজললতা তো ভাইবউ বলতে অজ্ঞান। সুবিমলবাবু ও বিম্ববতীদেবী রনিতাকে বউমা ভাবার তুলনায় তাঁদের ছোটমেয়ে ভাবতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন। আর তিতলিকে তো তার নতুন মামীর আঁচল ধরেই সর্বক্ষণ দেখা যায়। এককথায় ' সুখী গৃহকোণ, বাজে গ্রামোফোন ' বিজ্ঞাপনের নিদর্শন। সকলে মিলে হইহই করে কেটে যায় বেশ কদিন। কাজললতার নিজের বাড়ি ফেরার দিন এগিয়ে আসে।যাওয়ার আগে মাকে সে বোঝায়, "ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে, একটু স্পেস্ দিও ওদের।" বিম্ববতীদেবী হেসে ফেলেন," আমাকে কি তোর অত্যাচারী শাশুড়ি মনে হয়?" হাসতে হাসতে কাজললতা যায় রনিতার কাছে," কটা দিন তোর সঙ্গে, সবার সঙ্গে কি ভালই না কাটল। তুই আমার ছোট বোন। কোনো অসুবিধে হলে বাবা মাকে জানাতে কুণ্ঠাবোধ করিস না। আর আমি তো আছিই। সমস্যা হলে সবসময় আমাকে তোর পাশে পাবি।" রনিতা আনন্দে ননদকে জড়িয়ে ধরে।
কাজললতা ফিরে যাবার পর রনিতার মনটা একটু একটু বিষণ্ণ হয়। তিতলিটা সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থাকত।খুব ওর কথা মনে পড়ে।
দিন কেটে যায়। অঙ্কুর তো বউ বলতে অজ্ঞান। সুবিমলবাবু আজকাল চা টা রনিতার হাতে ছাড়া খেতেই চান না। বিম্ববতীদেবী রনিতার শখ লক্ষ্য করে নানারকম রান্না শেখান তাকে। সকলের এত ভালোবাসা পেয়ে রনিতা আজকাল বাপেরবাড়িও খুব একটা যেতে চায় না। গেলেও দু এক দিন থেকেই পালিয়ে আসে শ্বশুরবাড়ি। সকলে তাকে বলে, "শ্বশুরবাড়ি কি যাদু করল তোকে!" সত্যিই, শ্বশুরবাড়িতে সকলের চোখের মণি সে।বিম্ববতীদেবী দূরদর্শী মানুষ। কদিন পরেই সংসারের চাবি তুলে দেন রনিতার হাতে। বলেন," মা, এখন এ তোমার সংসার। তুমি যেভাবে চালাবে সেভাবেই চলবে।" রান্নাঘরও ছেড়ে দেন রনিতার হাতে। তিনি জানেন, এই রান্নাঘরের অধিকার নিয়ে দড়ি টানাটানিতেই কত সংসার ভেঙে যায়। রনিতা ভালোমন্দ যাই রেঁধেবেড়ে দেয় সকলেই সোনামুখে খেয়ে নেয়। যখন খুশি স্বামীর সঙ্গে সে বেড়াতে যায় সংসারের ভার শাশুড়ির কাঁধে ফেলে। মাঝে মাঝে সে শাশুড়ির সঙ্গেও ঘুরতে যায়।কিন্তু সেখানে চপ খেয়ে তার পেটখারাপ হলে অঙ্কুরের কাছে বকা খান বিম্ববতীদেবী! কারণ তাঁরই বারণ করা উচিত ছিল, রনিতা কি বোঝে! বিম্ববতীদেবীও কাঁচুমাচু মুখে মেনে নেন নিজের গর্হিত অপরাধ। প্রায় দিনই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায় রনিতার। আলুসেদ্ধ ভাত খেয়ে অফিসে ছোটে অঙ্কুর। যাওয়ার সময় বকাবকি করে মাকে, " তুমি ডেকে না দিলে ও উঠতে পারে?" মা ও কবুল করেন নিজের দোষ। যত দিন যায় রনিতার গুণগুলি সব রনিতার, আর তার দোষগুলির সব দায়িত্ব বর্তায় বিম্ববতীদেবীর ঘাড়ে।
এভাবেই কেটে যায় বেশ কটি বছর। আত্মীয়স্বজনেরা কানাকানি করে, এ সংসারে নতুন সদস্যের দেখা পাওয়া যাবে কবে? কাজললতা আসরে নামে।ডাক্তারবদ্যি, চিকিৎসা সব দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ফলস্বরূপ, বিয়ের আট বছর পর রনিতার কোল আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে ছেলে। যথেষ্ট আধুনিকমনস্কা হলেও বংশের বাতি দেওয়ার প্রশ্নটিও বিম্ববতীদেবীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নাতির জন্ম তাঁকে আনন্দে আত্মহারা করে দেয়। রনিতার আদর এ সংসারে বেড়ে যায় আরও শতগুণ।কাজললতা অলক্ষ্যে নিজের চোখের জলটা মুছে নেয় নিজের মায়ের এই অজানা মনটার হঠাৎ হদিস পেয়ে । সে অনুভব করে তার দিকের পাল্লাটা মায়ের কাছে ভাইয়ের তুলনায় একটু হলেও হালকাই। তবে এসব ভুলে যেতেও সময় নেয় না সে।খুশি মনে ছোট্ট ভাইপোকে আদরে যত্নে ভরিয়ে রাখে কটা দিন। কাজললতা ফিরে যাবার পর একমাত্র নাতির সব ভার বিম্ববতীদেবী তুলে নেন নিজের কাঁধে। অবস্থা এমন হয় যে ন্যাপি পাল্টাতে হলেও রনিতা 'মা মা' বলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে। আর বিম্ববতীদেবীও পড়িমরি করে যেমন অবস্থায় যে কাজেই থাকুন না কেন, সব ছেড়ে দৌড়ে আসেন। রনিতার দিন কাটে ভারি আরামে।
এভাবেই কেটে যায় আরও কটি বছর। ইতিমধ্যে সুবিমলবাবু গত হয়েছেন। বিম্ববতীদেবীও বয়সের ভারে বেশ খানিকটা জবুথবু হয়েছেন। কিন্তু তাও বসে থাকেন না তিনি। নাতি রঙ্গনের সঙ্গে খেলাধুলো, টুকটাক দোকানপাট, রনিতাকে সাহায্য করা সবই করেন তিনি। রঙ্গনও ঠাম্মা বলতে অজ্ঞান। ঠাম্মাই তার বেস্ট ফ্রেণ্ড। তার ছোট্ট জীবনের সমস্ত সমস্যা একমাত্র ঠাম্মাকেই সে বলতে পারে। ঠাম্মা তার গল্পের দোসর, খেলার সাথী, মনখারাপেরও সঙ্গী। আজকাল একটুতেই হাঁপ ধরে যায় বিম্ববতীদেবীর। সেদিন নাতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হঠাৎই পড়ে গিয়ে কোমরে ভালোমত চোট পান তিনি। অঙ্কুর ছেলেকে প্রচণ্ড মারধোর করে, মায়ের এই দুর্ঘটনার জন্য রঙ্গনকেই দায়ী করে। বিম্ববতীদেবীর শত বারণ, চোখের জলও রঙ্গনকে বাঁচাতে পারে না বাবার হাতে অমন মার খাওয়া থেকে। হতচকিত ছোট্ট রঙ্গনের মনের কোন গভীরে গিয়ে আঘাত করে ঠাম্মার জন্য বাবার কাছে প্রথম মার খাওয়ার ঘটনাটি, কে জানে! কিন্তু মাস তিনেক শয্যাশায়ী থাকার পর বিম্ববতীদেবী যখন লাঠি নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেন, তখন দেখা যায়, তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর নাতি নয়, ঐ লাঠিই হয়েছে। যে নাতির ঠাম্মা ছাড়া এক মুহূর্তও চলত না, সেই নাতি ঠাম্মার ঘরে একবার উঁকি দিয়েও দেখে না। ঠাম্মার কাছে আসা তো দূরঅস্ত, সে ঠাম্মার সঙ্গে কথাই বলে না। বিম্ববতীদেবী অনেক চেষ্টা করেন নাতির মান ভাঙানোর, কিন্তু সে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। সে এখন আর ঠাম্মাকে যেন চিনতেই পারে না। রনিতা শাশুড়িকে বলে, " ছেলেমানুষ, কখন কি মতি হয়, ও ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া রঙ্গন বড় হচ্ছে, পড়াশোনাও বাড়ছে। এখন কি আর সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করার সময় পাবে! তুমি বরং এই দূরত্বটা মেনে নিতে শেখ।" স্তব্ধ হয়ে যান বিম্ববতীদেবী। আজ এতদিন পর হঠাৎ তাঁর মনে হতে থাকে, এই ছেলে, এই নাতি, এই বাড়ি-কিছুই যেন আর তাঁর নিজের নয়।
আজকাল বিম্ববতীদেবী কোনো কাজই আর করে উঠতে পারেন না। লাঠি হাতে টুকটুক করে হাঁটেন আর নিজেরটুকু কোনমতে সারেন।মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গেলে রনিতা মুখঝামটা দেয়," উঃ! মা, তুমি কাজের সময় এখানে ঘুরঘুর কোর না তো। কখন উল্টে পড়বে, তখন আবার আমারই জ্বালা!" আজকাল সন্ধ্যেবেলার চা জলখাবারটাও রনিতা তাঁর ঘরে দিয়ে যায়। বিম্ববতীদেবীর খুব ইচ্ছে হয় বসার ঘরে সকলের সঙ্গে গল্প করতে করতে জলখাবারটা তিনি খাবেন। কিন্তু কি এক অস্বস্তি তাঁকে বসার ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে দেয় না। একদিন মনের জোর করে গিয়েওছিলেন। তখন সকলে হইহই করে খেতে খেতে গল্প করছিল। তাঁকে দেখেই সকলে চুপ করে গেল। অঙ্কুর বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, আঃ! মা! তুমি আবার এখানে এলে কেন? তুমি তো এসব খাও না। নিজের ঘরেই থাকতে পারতে। অত বেশি হাঁটাচলা করলে তো তুমি পড়েও যেতে পার!" এখানে একটি তথ্য দেওয়া জরুরি। সুবিমলবাবুর মৃত্যুর পর থেকে বিম্ববতীদেবী আমিষ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। না, নিজের ইচ্ছেয় নয়, ছেলের ইচ্ছেয়। জোর করে মুখে হাসি এনে তিনি তাও সবার মাঝে বসেছিলেন। কিন্তু আড্ডাটা তারপর আর জমেনি।একটু পরে রনিতা কাজের বাহানা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। অঙ্কুর অফিসের কাজের অজুহাতে ঘরে চলে গেল। আর রঙ্গন মন দিয়ে টিভিতে কার্টুন দেখতে লাগল। বিম্ববতীদেবী অনেক চেষ্টা করলেন সেই আগের মতো নাতির সঙ্গে গল্প করার। কিন্তু সেই রঙ্গন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। একমাত্র নাতির এমন উদাসীনতা তাঁকে একাকীত্বের যন্ত্রণাটা গভীরভাবে মনে করিয়ে দিল।
অনেক দিন পর কাজললতা এসেছে তার বাপেরবাড়ি। মাকে দেখে সে আঁতকে উঠল। এ কি চেহারা হয়েছে মায়ের! আর মুখখানা গভীর বিষাদে মাখামাখি! রাতে একান্তে সে মায়ের কাছে সব জানতে চাইল।বিম্ববতীদেবী কিছুতেই মুখ খুলতে না চাইলেও মেয়ের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন। সব জেনে কাজললতা অবাক হয়ে গেল।
এও বুঝতে পারল ছেলের হাজার দোষ তিনি এখনও ক্ষমার চোখেই দেখছেন। কারণ সে যে তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান। কিন্তু এভাবে চললে বিম্ববতীদেবীকে যে আর বেশিদিন বাঁচানো যাবে না, সে কথা কাজললতা খুব ভালো করেই বুঝতে পারল। সারারাত সে ভাবল। অনেক ভেবে বুঝল, ভাইয়ের সঙ্গে অশান্তি সে কোনোভাবেই করতে পারবে না। কিন্তু মা তো তারও।তাঁকে ভালো রাখার দায়িত্ব ও অধিকার মেয়ে হিসেবে তার উপরও বর্তায়। একটি ছেলে যদি নিজের মাকে ভালো রাখতে না পারে, শুধু মেয়ে বলেই সে মাকে দেখাশোনা করতে পারবে না! না, এটা হতে পারে না। সে মাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবে। নাতির অবহেলা নাতনি ভালবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেবে। মাকে সে সুস্থ করবেই। বিম্ববতীদেবী তার মনের কথা জানতে পেরে আঁতকে উঠলেন। ছেলে থাকতে মেয়ের কাছে গিয়ে তাঁকে থাকতে হবে! এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো। এত উন্নতমনস্কা মায়ের মনে যে সমাজসৃষ্ট অদ্ভুত নিয়ম এত দৃঢ়ভাবে গেঁথে রয়েছে তা জেনে কাজললতা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। অনেক চোখের জল, অনেক তর্কবিতর্কের পর অনেক কষ্টে মাকে সে বোঝাতে সক্ষম হল।
পরদিন কাজললতা নিজের সিদ্ধান্ত জানায় অঙ্কুর ও রনিতাকে। কেউই খুব একটা আপত্তি করে না। যেটুকু দ্বিধা দ্বন্দ্ব বিম্ববতীদেবীর মনে ছিল, প্রিয়তম মানুষগুলির উদাসীনতায় সেটুকু থেকে তিনি মুক্ত হলেন। মুক্তমনে তিনি মেয়ের হাত ধরলেন।