অঙ্গনা অনেক দূর থেকে দেখলো হৃষিকেশ এই দিকেই আসছে। থেমে গেল। ভাবছে অন্য পথ ধরবে কিনা। হঠাৎ বাঁ দিকে মোড় নিয়ে একপা বাড়াতেই চলন্ত মোটরসাইকেলটার সামনে পরলো আর ওর ধুপ্ করে পরার সাথে সাথেই মোটর সাইকেলটা ব্রেক কষে দাঁড়ালো। যখন চোখ মেললো, ঝাপসা চোখে দেখলো হৃষিকেশের কোলে মাথা দিয়ে ফুটপাতে সে শুয়ে আছে। হৃষিকেশ হাতে এক আজলা জল নিয়ে ওর চোখে মুখে ছিটোচ্ছে আর ওর পাশে জলের বোতল হাতে যে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে সে...সুমন্ত্র না! অঙ্গনা আবার কয়েক সকেন্ডের জন্য চোখ বুঁজলো। তারপরেই ঝট করে উঠে বসলো। হৃষিকেশ ওর কাঁধ ধরে বললো,-" দাঁড়াতে পারবে?" অঙ্গনা কোন উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভীড় কাটিয়ে চলে যেতে চাইছে দেখে হৃষিকেশ ওর হাত ধরে বললো,-"কেন ছেলেমানুষী করছো আঙন,ফিরে চলো।" সুমন্ত্রকে ওর পাশে এগিয়ে আসতে দেখে অঙ্গনা হৃষিকেশের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,-"চলো।" সুমন্ত্র বললো,-"সরি, এইভাবে দেখা হবে বুঝতে পারিনি....।" হ্যষিকেশ তেড়ে গেলো -"দেখে চালাতে জানেন না তো দু চাকা নিয়ে বেড়োন কেন? দুপায়ের ওপরেও কি ভরসা নেই? আবার বলছেন 'এইভাবে ধাক্কা লাগবে বুঝতে পারেননি!" অঙ্গনা বুঝলো হৃষিকেশ সুমন্ত্রর কথাটা বুঝতে ভুল করেছে তাই ওর হাত ধরে টান দিয়ে বললো,-"চলো হৃষি,আর কথা বাড়িও না।" সুমন্ত্র বলতে যাচ্ছিল,
-"আমার বাইকে ওঠো অঙ্গনা আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো।" কিন্তু বলতে পারলো না। সুমন্ত্র বুঝেছে ওই লোকটা আর অঙ্গনা পরষ্পরকে চেনে তাই বললো,
-" আপনারা আমার বাইকে ঊঠুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি।" কথাটা শুনেই অঙ্গনা একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে তাতে উঠতে উঠতে বললো,
--"হৃষি,তুমি যাবে?" হৃষিকেশ কথা না বাড়িয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসলো। হৃষিকেশ অঙ্গনার চোট লাগা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন ছিল ,বললো.-"কোথাও কেটেছে কিনা দেখে টিটেনাস নিতে হবে আর মারাত্মক কিছু চোট থাকলে ডাক্তার দেখাতে হবে।" অঙ্গনা হৃষির কথা শুনছিল কিনা বোঝা যাচ্ছিল না ওর চোখ ছিল আউট সাইট রেয়ার ভিউ মিররে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সুমন্ত্র পেছনে পছনে আসছে। একবার ভাবলো নিজে নেমে যায় ট্যাক্সি থেকে পর মুহূর্তে ভাবলো,'নাঃ ওকে বাড়িতে নামিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে যাবে সে।' বাড়ির সামনে গিয়ে অঙ্গনা বললো,-"নেমে যাও হৃষি, আমি এগোবো এবার।" হৃষিকেশ ওর হাত চেপে ধরলো,
--"কেন ছেলেমানুষী করছো আঙন, কোথায় যাবে তুমি?" অঙ্গনা মিররে আবার সুমন্ত্রকে দেখতে পেয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পরলো। হৃষিকেশ বাঁহাতের মুঠোতে অঙ্গনার ডান হাতের মাঝখানটা ধরে রেখে ডান হাতে ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিল।
ঘরে ঢুকে অঙ্গনা ঘরটাকে নতুন চোখে দেখলো। দীর্ঘ পাঁচ বছর এই ঘরটাতে কাটিয়ে পরশু যখন ঘরটাকে ছেড়েছিল তখন একবারের জন্যেও ভাবেনি আবার এখানে ফিরে আসবে। তার এইটুকু জীবনে মোট তিনবার ঘর ছেড়েছে সে। হৃষিকেশের সঙ্গে লিভ টুগেদার করার সিদ্ধান্তটা অঙ্গনারই ছিল। প্রথম যেদিন হৃষিকেশের সঙ্গে দেখা সেদিন গিটার হাতে হৃষি বসেছিল গঙ্গা পারের পিঠ ঠেসান দেওয়া বেঞ্চিতে। কোনো একটা গানের সুর তুলতে না পারার মনোকষ্ট নিয়ে। ওদিকে অঙ্গনা নদীর জলে পা ডুবিয়ে ভাবছিল 'সুযোগ পেলে এই নদীতে কিংবা কাছের ওই ওভার ব্রিজের চলন্ত ট্রেনের তলায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবে। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি। নিজের আত্মরক্ষার জন্য নয় হাতের গিটার রক্ষার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল হৃষিকেশ। চোখে পরলো গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা মেয়েটির ওপর। ডাকলো,-"শুনছেন,বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ওভাবে জলের ধারে বসে থাকবেন না উঠে আসুন...।" অঙ্গনা ভাবছে 'এই সুযোগে জলের মধ্যে ভেসে যাওয়াই যায়!' সামনে নদীর বুকে ঝরে পরা বৃষ্টির শব্দ আর কানের মধ্যে ঢুকে পরা ফাঁকা জায়গার বাতাসের তীব্র শোঁ শোঁ শব্দের ফলে হৃষিকেশের কোন ডাক তার কান পর্যন্ত পৌছায় নি। বরং সে বসে বসে পেছন ঘসে ঘসে জলে ভরা সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করে দিয়েছিল। গিটারের মায়া ছেড়ে হৃষিকেশ ছুটে গিয়ে বজ্রমুঠিতে তার কাঁধ দুটো চেপে ধরেছিল। উন্মত্তের মতো -"ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন" শব্দে নদীর পারে চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল অঙ্গনা। একসময় সে হষিকেশের বজ্রমুঠির আকর্ষণে তার দিকে ফিরে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। তার কন্ঠে তখন তীব্র গর্জন ,-"আপনি কে যে আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন?"
-"এটা যদি আপনার স্বাধীনতা হয় তাহলে আপনাকে বাঁধা দেওয়াটাও আমার স্বাধীনতার আওতায় পরে।"
-"আপনাকে এই অধিকার কে দিয়েছে?" হিস্ হিস্ করে বলেছিল অঙ্গনা।
-"আমার বিবেক আমার মনুষ্যত্ব।" এবার তীব্র গর্জনে ফেটে পরেছিল অঙ্গনা,
--"কি রকম সেই মনুষ্যত্ব বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ..."
-"আমার উপস্থিতিতে কেউ যদি নদীর জলে আত্মবিসর্জন করতে চায়, একজন মানুষের বিবেক বলে 'ওকে বাধা দাও'... আর মনুষ্যত্ব বলে 'ওকে রক্ষা করা তোমার কর্তব্য'। জাস্ট এইটুকুই।" মেয়েটাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখ হৃষিকেশ বলে -"আমি একজন মানুষ হয়েও কি আপনার এই অনৈতিক কাজে বাঁধা দেবোনা বলুন!" অঙ্গনা আর পারেনি হৃষিকেশের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরেছিল আর বলছিল,-"এবার আমার কি হবে...গঙ্গা তাঁর বুকে আমাকে জায়গা দিচ্ছিলেন আর আপনি আমাকে সেখানে যেতে দিলেন না, তাহলে এবার আমি কথায় যাবো বলে দিন।"
নিজের বুকের আলিঙ্গনকে আরও সবল করে হৃষিকেশ উত্তর দিয়েছিল -"সত্যি যদি আপনার কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে তাহলে আমার বাড়িতে আপনার থাকার কোনোই অসুবিধা হবে না।"
বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা হয়ে ভিজে গিটার সহ ওরা দুজনে এই বাড়িতে এসেছিল সেদিন। অঙ্গনার কাঁধের ডাকব্যাকের ব্যাগটার ভেতরে বেশি না হলেও জল ঢুকে ছিল, বুঝেছিল অঙ্গনা। এই বাড়িটা ছিল হৃষিকেশের দাদামশাইয়ের। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করলে দাদামশাই তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন। আজ দাদামশাই আর দিদিমা কেউ বেঁচে নেই। তবে তাঁদের স্মৃতি মিশে ছিল এই শান্ত বাড়ির পরিবেশে। সেই স্নেহ মাখানো স্মৃতিময় বাড়িতে ছিল আস্থা আর সন্মান। অঙ্গনার হৃষিকেশকে বিয়ে করার সন্মতি না থাকায় হৃষিকেশ বলেছিল '-"তোমার অতীতের বেদনা নিয়ে তুমি প্রাণ বিসর্জন করতে গিয়েছিলে। আমি তোমাকে রক্ষা করেছি,তাই,এখন তোমার নবজন্ম হয়েছে মনে করে তোমাকে সেই সমস্ত দুঃখময় অতীতকে ভুলতে হবে। সমাজের কাছে সন্মান নিয়ে বাঁচার জন্য আমাদের বিয়ে হোক বা না হোক এক বাড়িতেই যখন আমরা থাকবো তখন তোমার পরিচয় হবে তুমি আমার স্ত্রী। আজকাল সিঁদুর পরাটাকে কেউ প্রাধান্য দেয় না, তবে বিশেষ প্রয়োজনে কপাল আর সিঁথি তোমাকে অল্প হলেও রাঙাতে হবে। ব্যাস্, এইটুকু মিথ্যাচারকে আশ্রয় করে নিশ্চিন্তে তুমি এখানে থাকো।" অঙ্গনা রাজি হয়েছিল। ব্যাগের মধ্যে অল্প স্বল্প জল ঢুকলেও অঙ্গনার কাগজপত্র অক্ষত ছিল। কিছুদিনের মধ্যে রিসেপসনিস্টের একটা চাকরিও পেয়ে গিয়েছিল ।
তাদের দিনগুলো রান্না-বান্না করে, অফিস করে, বেড়িয়ে চেড়িয়ে, আড্ডা মেরে, রোগে শোকে পরস্পরের দেখভাল করে ভালোই কাটছিল। বিয়ে হয়নি বলে দুজনের কারো মধ্যে কোন আফসোস ছিল না। আফসোসটা অঙ্গনার মনে উঁকি মারলো যেদিন ওদের একসাথে থাকার পাঁচবছর পূর্ণ হলো সেদিন থেকে। সমাজের সামনে বছরপূর্তির দিনগুলো তারা তাদের বিবাহবার্ষিকী হিসাবে পালন করতো। এই বছর অঙ্গনার মনে হলো সে হৃষিকেশকে ভালো মানুষ পেয়ে ঠকাচ্ছে। মানুষটার যখন বিয়ে করে এই সংসারে বৌ নিয়ে সংসার করার কথা, সেই জায়গায় হৃষিকেশের মতন এক উপযুক্ত মানুষকে সত্যিকারের সংসার সুখের সুযোগ না দিয়ে সে নিজে তার বিপরীতের সেই মূল্যবান স্থানটা অপব্যয় করে রেখেছে। অঙ্গনার জীবনের সেই অতীতের দুর্ঘটনার কোনো কথা জানার আগ্রহ হৃষিকশ দেখায়নি কোনো দিন, কিন্তু অঙ্গনা নিজে জানে হৃষিকেশকে বিয়ে করা তার পক্ষে কেন সম্ভব নয়। সুতরাং এই মিথ্যা সংসার, এই নিশ্চিন্তের আশ্রয়ে থাকার প্রশ্রয়কে যদি সে না ছাড়ে হষিকেশকে চিরদিন অবিবাহিত হয়েই থাকতে হবে। তা সে কিছুতেই পারবে না। সেদিন তাই অঙ্গনা এই নিয়ে তৃতীয় বার ঘর ছেড়েছিল। ভেবেছিল ক'টা দিন লেডিস হোস্টেলে কাটিয়ে চলে যাবে অন্য কোথাও। সেইমতো অফিস যাওয়াও বন্ধ করেছিল। কিন্তু মনটা ব্যকুল হয়ে উঠছিল হৃষিকেশের জন্য। এতদিনের অভ্যস্ত জীবনে এতো কাছাকাছি থাকলে চিন্তা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কি খেলো,কখন জাগলো,তার জন্য হয়তো খুব চিন্তা করছে আর খুঁজে বেরাচ্ছে! এই সব নানান চিন্তা নিয়ে আজ সকালে বেড়িয়ে পরেছিল, আড়াল থেকে হৃষিকে একটু দেখার ইচ্ছায়। কিন্তু এই বিপত্তি অঙ্গনা আশা করেনি।
বাইক থামার শব্দ হতে চমকে উঠলো অঙ্গনা। নির্ঘাত সুমন্ত্র! সুমন্ত্রের সাথে বছর খানেক প্রেম করার পর সুমন্ত্র বলেছিল,-- ক'দিন বাবা-মা বাড়ি থাকবেন না,সেই ফাঁকে চলো আমরা রেজেস্ট্রি ম্যারেজটা সেড়ে ফেলি। এরপর তুমি আমাদের বাড়িতেই থাকবে তারপরে বাবা-মা বাড়িতে ফিরলে তাঁদের নতুন বৌমা দেখিয়ে চমকে দেবো।" অঙ্গনা আগ্রহভরে প্রশ্ন করেছিল, -"যেদিন রেজেস্ট্রি ম্যারেজ হবে সেই দিন আমাকে তুমি সিঁদুর পরাবে তো?" সেই অনুযায়ী বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ঘর ছেড়েছিল অঙ্গনা। দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো সন্তানের ইচ্ছাকে মেনে নিয়েছিলেন। অঙ্গনার বাবা রেজেস্ট্রির সময় উপস্থিত ছিলেন এবং রেজেস্ট্রি হওয়ার পর সুমন্ত্রের হাতে মেয়েকে সঁপে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরেছিলেন । বন্ধুর বাড়িতে রেজেস্ট্রির কাজ কর্ম শেষ করে সুমন্ত্রর হাত ধরে সুমন্ত্রের বাড়ি এসেছিল অঙ্গনা। কিছুক্ষণের মধ্যে তীব্র কলিং বেল বাজিয়ে সুমন্ত্রের বাবা এলেন। বাবা কঠোর স্বরে বললেন,-"খবর পেয়ে চলে এলাম। তুমি নাকি বিয়ে করেছো?"
-"কই না তো? কে বললো?" সুমন্ত্রের ঘরের পর্দার আড়াল থেকে ড্রইং রুমে বাপ-ছেলের কথপোকথন শুনছিলো অঙ্গনা।
--"তাহলে আজ কার বিয়ের রেজেস্ট্রি হলো?" সুমন্ত্রের বাবার গুরুগম্ভীর প্রশ্নের উত্তর সুমন্ত্রর মুখে শোনার জন্য অঙ্গনা দুরুদুরু বক্ষে কান পাতলো।
-"ওঃ! ও আমার এক বন্ধু তারও নাম সুমন্ত্র...তা তোমাকে এ কথা কে বললো? ম্যা..."
-"হ্যাঁ,ম্যারেজ রেজিস্টারার মানিকবাবু ফোন করে বললেন। আমি জানতাম কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। সুশোভনের মেয়ে সঙ্গীতার সঙ্গে তোমার বিবাহের পাকা কথা হয়ে গেছে,আর তুমি কখনই এমন কাজ করতেই পারোনা। আমার তোমার ওপর এই বিশ্বাস আর ভরসা দুটোই ছিল। চলো নিচে,তোমার মাকে লিফ্টের সামনে দাঁড়াতে বলে আমি আগে উঠে এসেছি। এতক্ষণে হয়তো লাগেজ নামাতে শুরু করে দিয়েছেন। চলো নিচে যাই।" লজ্জা আর অপমানে অঙ্গনার শরীর টলোমলো করছিল। এতো মিথ্যা বলতে পারে সুমন্ত্র! সে বিছানার ওপর থেকে ওর ব্যাগটা কাঁধে তুলে সিঁড়ি দিয়ে যখন নিচে নেমে এসেছিল ততক্ষণে সবে লিফট্ ওপরে উঠছে। রাস্তায় বেড়িয়ে সে সোজা বাস টার্মিনাসে পৌঁছেছিল।
হৃষিকেশ দরজা খুলতেই কিছু বলার আগে সুমন্ত্র ঘরে ঢুকে পরে অঙ্গনাক বললো,-"জানি তোমার বেশি লাগেনি। তোমাকে সেদিন ঘরে না দেখে কতো ফোন করলাম। বার বার বললো সুইচড্ অফ্। কতো খুঁজছি তোমায়....আজও খুঁজছিলাম...জানতাম দেখা হবে। চলো ফিরে চলো। বিশ্বাস করো,আজও আমি তোমায় খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষাতে ছিলাম।"
-"তাই নাকি! তাহলে সুশোভন বাবুর মেয়ে সঙ্গীতার কি হবে?"
-"বিশ্বাস করো আমি সঙ্গীতাকে নয় তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম।"
-"তাই নাকি!"ব্যঙ্গ হাসি হেসে অঙ্গনা বললো,-"আমাকে অনেকবার ওই কথাটা বলেছো আর আমি শুনে বিশ্বাস ও করেছিলাম, কিন্তু কই সেদিন তো নিজের বাবাকে এই সত্যি কথাটা বলার সাহস দেখাওনি! ঘরের ভেতর বৌকে দাঁড় করিয়ে রেখে বাবাকে বলেছো 'তুমি বিয়ে করোনি!' হেঃ হেঃ! কি সৎ আর বীরপুরুষ তুমি। যাও-যাও ফিরে যাও আমাকে বিরক্ত কোরো না।"
-"ভুলে যেওনা তুমি এখনো আমার বিবাহিত স্ত্রী।" হৃষিকেশ বিস্ময়ের সঙ্গে এদের কথাবার্তা শুনছিল। আজ একটু একটু করে তার সামনে অঙ্গনার অতীতের উন্মোচন ঘটছে। আজ বুঝতে পারছে এই নিষ্পাপ সরল মেয়েটি কেনো সেদিন তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। সে ব্যস্তভাবে বললো,
-"আপনি আঙনের হাজব্যান্ড! সরি, সরি! বসুন বসুন।পরে না হয় ধীরে সুস্থে কথা হবে। আগে একটু মিষ্টিমুখ করুন, তারপর আঙন না হয় আপনার সাথে ফিরে যাবে।" অঙ্গনা করুণ দৃষ্টিতে তাকালো হৃষিকেশের দিকে 'কি সরল আর নিঃস্বার্থ এই মানুষটা। এতোদিন সাথে আর পাশে থেকেছে, কোনোদিন কোনো অপমান করেনি। অফিস থেকে পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই জানে তারা বিবাহিত, কিন্তু কখনো একলা ঘরে, এতো পাশে পেয়েও কোনো সুযোগ নেয়নি বরং তার সামনে উজ্জ্বল এবং উচ্ছল নতুন জীবনের দরজা খুলে দিয়েছে। মানুষটার চোখে অঙ্গনার জন্য উজাড় করা ভালোবাসা,আশ্বাস,উদ্বেগ,ভরসা সবকিছুই দেখেছে অঙ্গনা। দীর্ঘ পাঁচ বছরের ওপর হলো একসাথে থাকতে থাকতে ওরা পরষ্পর পরষ্পরের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। সামান্য এই দুদিনের বিচ্ছেদে কি নিদারুণ ভাবে সেই বিরহ যণ্ত্রনা উপলব্ধি করেছে অঙ্গনা তা সে নিজেই বুঝেছে। আজ এই মানুষটার সততা নিজের হাতে গড়া তার সবচাইতে প্রিয় আঙনকে তার স্বামীর হাতে তুলে দিতেও দুবার ভাবাচ্ছে না। অঙ্গনা হৃষিকেশের দিকে তাকিয়ে কঠোরভাবে বলে উঠলো,-"না আমি কোনদিনও ওই লোকটার সাথে থাকিও নি তাহলে ফেরার প্রশ্নই বা উঠছে কি করে হৃষি?"
- "বিয়ে করেছো আবার? তোমার স্বামী এই আমি আজও জীবিত! তাহলে কি করে আবার বিয়ে করলে অঙ্গনা? কি করে এই অনৈতিক কাজ করলে তোমরা ?"ক্রোধ ফেটে পরলো সুমন্ত্রের কন্ঠে। হৃষিকেশ কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিল। অঙ্গনা হাত তুলে থামতে বললো তাকে। মুখে বললো,-"দাঁড়াও হৃষি,যে যেমন ভাষা বোঝে তাকে সেই ভাষায় আমাকে উত্তর দিতে দাও।" তারপর সুমন্ত্রর মোখোমুখি উল্টো দিকের সোফায় বসে হৃষিকে বললো, -"তোমায় মিষ্টিমুখ করানোর জন্য ব্যস্ত হতে হবেনা হৃষি, তুমি এখানেই বসো।" হৃষি একটা সিঙ্গেল সোফায় বসল। নিশ্চিন্ত হয়ে অঙ্গনা কথা শুরু করলো,-"হ্যাঁ,কি বলছিলে? একনম্বর হলো, আমাদের অনৈতিক কাজ! সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে ঘরে তুলে গৃহকর্তাকে জানানো যে তুমি বিয়েই করোনি...এটা কোন নীতিতে পরে সুমন্ত্র ? দুই নম্বর হলো এই, আমাকে তুমি ফোন করছিলে --ম্যেসেজ করছিলে! কি লিখেছিলে মেসেজে "এখনকার মতন পালাও,আমি সময় হলে বলবো।' সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে আশ্রয়হীনা করে কোথাও পালিয়ে যেতে বলাটা কোন নীতির অন্তর্ভূক্ত একটু বলবে?
- তিন নম্বর, আমায় খুঁজছিলে। কেন?বাবা -মার সামনে মুখফটে সত্য কথা বলার সাহসটা আজও কি তুমি আয়ত্তে আনতে পেরেছো? জানতে চাই। চার নম্বর, আজও তুমি একা কেন? সুপাত্রী জোটেনি না কি সঙ্গীতা তোমাকে বাতিল করেছে? পাঁচ নম্বর, এখনো আমাকে খুঁজছো কেন? ডিভোর্স করবে বলে? ছয় নম্বর, তুমি আমার স্বামী হওয়ার দাবি তুলছো? এক, রেজেস্ট্রি করা ছাড়া স্ত্রীর সন্মান রক্ষার জন্য আর তার প্রতি কর্তব্য করার জন্য একজন স্বামী হিসেবে তুমি কি করেছো?"এবার উঠে দাঁড়ালো অঙ্গনা এসে দাঁড়ালো হৃষিকেশের সোফার পাশে। বললো,কোনদিনও আমি তোমার সঙ্গে সহবাস করিনি তাই আমি তোমাকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠাবো বাড়ির ঠিকানায়। "ঝট্ করে উঠে দাঁড়ালো সুমন্ত্র,-" না না বাড়ির ঠিকানায় নয়।"
- "আরে বোসো বোসো, আরও কথা আছে।" সুমন্ত্র বসলো। অঙ্গনা হাসলো
- -" প্লিজ অঙ্গনা বাড়ির ঠিকানায় ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিও না।'সুমন্ত্রর কন্ঠে কাতর অনুরোধ।
- -"কেন,ওখানে তোমার আইন বহির্ভূত দ্বিতীয় স্ত্রী আছেন?" মুচকি হাসলো অঙ্গনা।
-"বাঃ! আমার অনেক শুভেচ্ছা জানিও তাকে। হ্যাঁ ভালো কথা হৃষি, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভবএখানকার কোনো ভালো উকিলের সঙ্গে কথা বলে মিউচুয়াল ডিভোর্সটা করানোর ব্যবস্থা করো। হৃষি, এবার তুমি হয়তো বুঝতে পারছো কেন আমি তোমাকে বিয়ে করতে সন্মত হইনি। তুমি আমাকে ওই দুর্দিনে আত্মহত্যা করার হাত থেকে রক্ষা করে আমার রক্ষক হয়ে নতুন ভাবে বাঁচবার পথ দখিয়েছিলে। বলেছিলে,শুধুমাত্র অতীতের বেদনাটুকু ভুলে যেতে। তুমিও আমার অতীত সম্পর্কে কিছুই জানতে চাওনি। তারপরও আমি কি করে আমাকে বিয়ে করার মতন অনৈতিক কাজ তোমাকে করতে দিতাম? আজ তুমি সবটা জেনেছো তাই বলতে দ্বিধা নেই হৃষি, আমি এবার তোমার সত্যিকারের বউ হতে চাই। তুমি কি রাজি আছো? হৃষিকেশ উঠে দাঁড়িয়ে অঙ্গনার হাত দুটো নিজের বুকের ওপর চেপে ধরলো।