এই ক'দিন হলো বিল্টুর মাথায় একরকম ভূত চেপেছে। সাইকেলটা কি করে চালাতে হয় সেটা তাকে শিখতেই হবে এবং সেটা শিগগিরই। ওর সমবয়সী রাতুল, তুতুন, পিকলু- এরা সবাই সাইকেল চালাতে শিখে গেছে; কিন্তু বিল্টু এখনো এ বিষয়ে কাঁচা। সেদিন রাতুলের দিদি রানী ও সাইকেল চালানো নিয়ে মুখ ভেংচে কি সব যেন বলছিল। সামনেই ক্লাস সেভেন-এর ফাইনাল পরীক্ষা। বিল্টু ভাবে, "পরীক্ষার আগেই সাইকেল চালানো শিখে গেলে রেজাল্টের আগেই বাবার কাছে জেদ করে ঠিক নতুন সাইকেল নিয়ে নেওয়া যাবে। তারপর সারাদিন রাতুলদের সাথে সাইকেল নিয়ে ভোঁ ভোঁ করে ঘুরবো। কি মজা!"
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবার পুরনো লঝঝরে সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় বিল্টু। বের হয় বললে ভুল হবে, প্রচন্ড কসরত করেই সাইকেলটা বের করতে হয়। ওর মা পেছন পেছন চিৎকার করলেও আজ সে কোনো পাত্তাই দেয়না। সাইকেল চালানো যে শিখতেই হবে ওকে। সাইকেলটা কিছুটা বেঢপ আকৃতির। পুরানো দিনের জিনিস, এটা নাকি একসময় বিল্টুর ঠাকুরদার নিত্যসঙ্গী ছিলো। ইয়া বড়ো কেরিয়ার পেছনটায়। আর রডগুলোও অনেকটাই মোটা। বিল্টুর চেহারার সাথে এই জিনিস খাপ খায় না কোনোমতেই। কিন্তু কোনো উপায় ও তো নেই। অন্য কে-ই বা ওকে নিজের সাইকেল দেবে? অগত্যা মধূসুদন, বাড়ির পুরনো সাইকেলটাই ভরসা।
সতর্কভাবে রাস্তায় এদিক ওদিক দেখে নেয় বিল্টু। এসময় ওর বন্ধুরা সবাই বই নিয়ে বসেছে। মাঠ একরকম ফাঁকা। কোনো চিন্তা নেই। কেউ এখন অন্তত ঠাট্টা করতে আসবে না। একটা ভয় অবশ্য হচ্ছে, ওর বাবা যদি কোনোভাবে জানতে পারে যে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সকাল সকাল সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে, আস্ত রাখবে না তাহলে। বিল্টুর বাবার চায়ের দোকান। সাধারণত এ সময় তিনি দোকানেই থাকেন। তবুও তিনি কোনো কারণে যদি বাড়িতে আসেন, আর মা যদি বলে দেয় সব, তাহলে? থাক, এতো চিন্তা করে কাজ কি! এখন বিল্টুর কাছে সবথেকে বড় চিন্তা, কী করে খুব তাড়াতাড়ি সাইকেল চালানো শেখা যায়।
কিছুদিন সামনে থেকে বন্ধুদের চালাতে দেখেছে বিল্টু। পদ্ধতিটা জানা আছে, এখন শুধু নিয়মিত অনুশীলন দরকার। লোহার যেকোনো জিনিস ই যে ঠাকুর বিশ্বকর্মা'র আশীর্বাদধন্য সেটা বিল্টু জানে। 'জয় বাবা বিশ্বকর্মা' বলেই প্যাডেলে পা দেয় সে। নাহ্, শুরুতেই বিপত্তি। প্যাডেলে চাপ দিতেই ডানদিকে হেলে যায় সাইকেল। ভার সামলাতে পারে না বিল্টু। সাইকেলটা পড়ে গেছে। একটু রাগ ওঠে, লজ্জাও লাগে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়, কেউ দেখে ফেলেছে কি না। নাহ্, মাঠে এখনো আসেনি কেউ। আবার শুরু করে নতুন করে। ভার কি কম! এবারেও হয়না কোনোমতেই। অসতর্ক হয়ে প্যাডেলে চাপ দিয়েছিল সে। সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় তখনি। পায়ে লেগেছে অনেকটাই, উঠতেও পারছেনা একা একা। এসময় রতন কাকা গরু নিয়ে এসেছিল মাঠে। বিল্টুকে পড়ে যেতে দেখেই দৌড়ে আসেন তিনি। জিজ্ঞেস করে যে লেগেছে কি না। বিল্টু মাথা নেড়ে অস্বীকার করে, 'না না, একদমই লাগেনি'। এর পর আরও দুদিন সাইকেল নিয়ে মাঠে এসেছিল বিল্টু। খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। পড়ে গিয়ে হাতে পায়ে ছড়ে গেছে দুই একবার। তবে হাল ছাড়েনি সে। হয়তো আর কটা দিন চেষ্টা করলে শিখেও যেত। কিন্তু বাদ সাধলো রতন কাকা। খবরটা তার থেকেই ছড়ায় প্রথমে। এরপর ওর বন্ধুদের মাঝে এ খবর রাষ্ট্র হতে বেশি সময় লাগেনি। তারপর আর কি! যা হবার, তাই ই হলো। ওর সব বন্ধুরা আবার ওকে নিয়ে খিল্লি করতে শুরু করে।
একটা চাপা অসন্তোষ কাজ করে বিল্টুর মধ্যে। ও নিজেও বোঝে, পড়ে গেলে বন্ধুরা তো ওরকম করবেই। মনে পড়ে, রাতুল একবার সাইকেল নিয়ে ড্রেনে পড়ে গেছিল। তারপর সে কি কান্না! তখনও তো বন্ধুরা সবাই মিলে হাসাহাসি করছিল। আর ওদের মধ্যে বিল্টু নিজেও তো ছিল, তার বেলায়?
"একটা হালকা ছোটো সাইকেল হলে দুদিনেই চালানো শেখা যেত", বিল্টু ভাবে। ক'দিন থেকে সাইকেলটা আর বের করছে না বিল্টু। বিল্টুর মায়ের ভাবনা হয়, "এতদিন তো মানা করেও ঘরে আটকে রাখা যায়নি, আর হঠাৎ এমন কি হলো যে সাইকেলে হাত ই দিচ্ছে না বিল্টু।" ব্যাপারটা কি হয়েছে জানতেই হবে তাকে। উঁহু, কোনো উত্তর নেই ছেলের কাছে। শেষে হাল ছেড়ে দেন তিনি। "যাক, না বের হওয়াই ভালো। শুধু শুধু পড়ে গিয়ে হাতে পায়ে চোট-আঘাত লাগিয়ে নিয়ে আসে। এর চেয়ে বাড়িতেই বসে থাকুক," বিল্টুর মা নিজেকে বোঝায়।
ক'দিন বাদেই ফাইনাল পরীক্ষা। দিনগুলো কিভাবে যেন কেটে যায়। খুব অসহায় বোধ হয় ওর। তবে কি ও কোনোদিনই সাইকেল চালানো শিখবে না? স্কুলে যাওয়া কমিয়ে দেয় বিল্টু। খুব রাগ ওঠে। সব্বাই হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। আর পিকলু তো মহা বদমাশ! ক্লাসের সবাইকে বলে বেড়িয়েছে যে বিল্টু সাইকেলে যতবার প্যাডেল মারে, তার চেয়ে বেশি বার উল্টে পড়ে। এরকম কথা শুনে কার স্কুল যেতে ইচ্ছে করবে শুনি? পরীক্ষার আগে যদি জেদ করে কোনোভাবে নতুন সাইকেল না কেনা যায় তো মহাবিপদ। রেজাল্ট খারাপ হলে যে আর কোনো জারিজুরি খাটবে না তা সে ভালো করেই জানে। যা কিছু করার, দুই একদিনের মধ্যেই করতে হবে।
বিল্টুর মা চিন্তায় পড়ে যান। দুদিন থেকে ঠিকঠাক খাচ্ছে না বিল্টু। খেতে বললেই বলছে খিদে নেই। এভাবে চলতে থাকলে তো শরীর খারাপ করবে। মায়ের কোনো কথাই শোনে না সে। বলে, "আমার শরীর খারাপ লাগছে, কিছুই ভালো লাগছে না।" ওর বাবা রাতে দোকান থেকে ফিরলে বিল্টুর মা ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলে। এর আগে দুএকবার শরীর খারাপের ভান করেছে বিল্টু, সেটা ওর বাবা জানতো। শরীর খারাপের সঠিক কারণ বুঝতে জায়গামতো খোঁচা মারেন তিনি। পাশের ঘরে ছেলে শুয়ে আছে, ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন,
"আচ্ছা বেশ। কাল সকালে দোকানে যাওয়ার সময় বিল্টুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। দুখানা ইনজেকশন দিলে ওই অসুখ ঠিক সেরে যাবে। তুমি সকালেই ওকে রেডি করে দিও।"
একটা ঘরে থাকে বিল্টুর বাবা, আর পাশের ঘরে বিল্টু ওর মায়ের সাথে ঘুমায়। আজ ওর মা বিছানায় আসতেই মা'কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। 'মা আমি ইনজেকশন নেবো না, খুব ব্যাথা করে', বলে কাঁদতে থাকে।
--কেন বাবা, তুমিই তো বলেছো যে তোমার শরীর খারাপ। ডাক্তার কাকু দুটো ইনজেকশন দিলে তোমার অসুখ খুব তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।
--আমার অসুখ হয়নি তো। এমনিই বলেছি।
--মিথ্যে কেন বলেছো? আর তাহলে ক'দিন ধরে ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করছো না কেন?
এরপর আর সে কথা লুকোয় না মায়ের কাছে। এক এক করে সব কথাই খুলে বলে। সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বন্ধুদের কাছে কিভাবে অপদস্থ হতে হয়েছে, সবটাই বলে সে। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করতে থাকে। আরও বলে, ছোটো একটা নতুন সাইকেল পেলে দুদিনেই সে চালানো শিখতে পারতো। কেউ আর তখন বাজে কথা বলতে পারবে না। তাছাড়া সাইকেল থাকলে স্কুলেও তো তাড়াতাড়ি যেতে পারবে সে। মাকে কথা দেয়, "সাইকেল কিনে দাও, ভালো করে পড়াশোনা করবো। রেজাল্ট ভালো হবেই, কথা দিচ্ছি।"
ওর মা আর কথা বাড়ায় না, বুঝতে পারেন সবটাই। একটা নতুন সাইকেল কিনতে অনেক টাকার দরকার। সেটা কিনতে গেলে তার চায়ের দোকানদার স্বামীর যে কতখানি অসুবিধা হবে সেটা তার অজানা নয়। তবুও পরদিন সকালে তিনি বিল্টুর এই অন্যায় আবদারের কথা জানান। এ বিষয়ে কোনোমতেই সায় দেয় না বিল্টুর বাবা। এদিকে বিল্টু ও নাছোড়বান্দা। একবার যখন লাগবে বলেছে তো সাইকেল লাগবেই। অবশেষে হার মানতে হয় ছেলের জেদের কাছে। হাতে কিছু টাকা জমানো ছিলো। ইচ্ছে না থাকলেও তার প্রায় পুরোটাই বিল্টুর সাইকেল কিনতে খরচ করতে বাধ্য হন তিনি। তবে বিল্টুর বাবা ও একটু একরোখা গোছের লোক। ছেলেকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেন যে রেজাল্ট খারাপ হলে সাইকেলটা তিনি বিক্রি করে দেবেন। বিল্টু একদিন বলেছিল যে নতুন সাইকেল থাকলে দুদিনেই সে চালানো শিখে যেতো। সাইকেল কিনে বাড়িতে আনার পর বিল্টুকে তিনি বলেন, " আগামী কাল আর পরশু, এই দুদিন সময় আছে। হয় দুদিনে চালানো শিখবি, নয়তো মেরে আমি তোর পা ভাঙবো। আর তোর ঐ সাইকেলটার কি গতি করবো, সেটাও তখন দেখতে পারবি।"
'কুছ পরোয়া নেহি' গোছের ভাব করে বাবাকে উত্তর দেয় 'আচ্ছা, তাইই হবে'।
বিল্টু এর আগে এরকম উৎফুল্ল ঠিক কবে হয়েছিল, মনে পড়ে না। একবার ওর বড়ো মামা একটা নতুন ক্যারম বোর্ড কিনে দিয়েছিল। সেই সময়ও খুব আনন্দ হয়েছিল। তবে এবারেরটা একদমই অন্যরকম। নতুন সাইকেলটা দেখিয়ে বন্ধুদের মুখে কেমন ঝামা ঘষে দেবে, এই চিন্তায় মশগুল সে। এতদিন খুব অপদস্থ হতে হয়েছে ওকে, কিন্তু আর না। এবারে বিল্টুর নতুন সাইকেল দেখে সবকটা জ্বলে পুড়ে মরুক! 'কাউকে যদি চালাতে দিয়েছি...', বিল্টুর মাথায় সারাক্ষণ এসব কথা ঘুরতে থাকে। পরদিন সকাল সকাল বের হয় বাড়ি থেকে। চালানোর চেষ্টা না করে এপাড়া সেপাড়া করে সাইকেল নিয়ে হেঁটে বেড়ায়। গর্বে যেন ছোট্ট বুকটা ফুলে ঢাঁই। যখনই রাস্তায় বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, ওর মুখে চওড়া হাসি। এ হাসি বিজয়ীর হাসি। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়িয়ে সাইকেল চালানো শেখার কথাই মনে নেই বিল্টুর। হাতে মাত্র আর একটা দিন। কালকের মধ্যে না চালানো শিখলে বাবা যে আস্ত রাখবে না, সেটা তার অজানা নয়। খুব ভালো করেই বাবাকে চেনে সে। তবুও মনের ফুর্তিতে ওসব কথা ভুলে যেতে থাকে। রাতে খাওয়া দাওয়ার সময় বাবার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় বিল্টু। চোখ এড়ায়নি ওর বাবার। বিল্টুকে তিনি মনে করিয়ে দেন, 'আর একটা দিন। মনে থাকে যেন।'
নাহ্, কিছুতেই হচ্ছে না। এটা তো ছোট্ট একটা সাইকেল, বাবার সাইকেলের চেয়েও অনেক কম ওজন। বিল্টু ভেবে পায়না যে তবুও কেন চালাতে পারছে না। মনোযোগ দিতে পারছেনা সে। বারবার রাতুল আর পিকলুর কথা মনে পড়ছে। কাল কেমন গোবেচারা মুখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল বিল্টুর সাইকেল টার দিকে। খুব মজা লেগেছিল বিল্টুর। ধুস... বাবার হাতে মার খেতেই হবে আজ। ঠিকমতো চালাতে পারছে না সে; শুধুই মাথায় হাবিজাবি চিন্তা। মাঠে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে সে। আবার উঠে দাঁড়ায়। অনেক চেষ্টা করে এবারে কিছুটা পেরেছে ঠিকই, কিন্তু এটাকে চালানো বলে না। দশ পা এগোতে না এগোতেই আবার পা নামিয়ে দিতে হচ্ছে। যতটা সহজ মনে হয়েছিল, ততটা তো সহজ নয় সাইকেল চালানো। বিকেলে বিল্টু যখন বাড়ি ফেরে, মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেছে। মায়ের সাথেও কোনো কথা বলেনা। 'খুব খিদে পেয়েছে' বলে বাবা বাড়িতে ফেরার আগেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে সে। কিছুই ভোলেনি ওর বাবা। 'কি, ছেলে শিখেছে চালাতে?' বিল্টুর মা কোনো সদুত্তর দিতে পারে না।
"ছেলেকে সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিও, কাল দেখবো কতটা শিখেছে। এমনিতেও কাল সারাদিন ফ্রি আছি, বাজার 'হরতাল'।"
রাতে শুয়ে শুয়ে বাবার সব কথাই শুনেছিল সে। সকালে মায়ের ডাকে সাড়া দেয়না বিল্টু। অজানা ভয়ে সে কুঁকড়ে থাকে। ওর বাবা বিছানা থেকে একরকম টেনে নামিয়ে আনে বিল্টুকে। সাইকেল সহ ছেলেকে মাঠে নিয়ে যান। বলেন, 'নে, চালা দেখি এবার।' বিল্টু পারে না চালাতে। কাল যতটুকু পেরেছিল, সেটুকুও পারে না। খেপে যান তিনি। "নতুন সাইকেল লাগবেই? এতো জেদ কিসের তোর? তোদের কথা ভেবেই সারাদিন খাটুনি করি, একটু আয়েশ করার সময় পাইনা। টাকার মর্ম বুঝবি কবে তুই?", বলেই মাঠে পড়ে থাকা একটা লাঠি দিয়ে বিল্টুর পায়ে মার বসিয়ে দেয় ওর বাবা। কঁকিয়ে উঠে বিল্টু। ব্যাথা ভালোই লেগেছে।
--যা, চালা সাইকেল। আমি ধরে আছি পেছনে। আজ তোকে চালানো শিখিয়েই ছাড়বো। পড়ে গেলেই মারবো। ঠিক মতো চালাবি। তোর জেদ আজ বের করবো।
কি করে চালাতে হয়, দু-একবার দেখিয়েও দেন। এরপর শুরু হয় বিল্টুর পরীক্ষা। একটু এদিক ওদিক হলেই মার পড়ছে গিয়ে সোজা পায়ের মধ্যে। এরমধ্যে ওর দুই বন্ধু হাজির মাঠে। ফিকফিক করে হাসছিল ওরা। বিল্টুর সেদিকে তাকানোর সময় বা সাহস, কোনটাই নেই। মার খেয়ে চোখ দিয়ে জল পড়ছে অথচ প্যাডেল থেকে পা সরানোর জো নেই। এইভাবে কতকটা মার খেয়ে আর খানিকটা সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে আঘাতে জেরবার বিল্টু বাবু। এত বড় হয়েছে বিল্টু, আজ পর্যন্ত চোখ দিয়ে এতটা জল পড়েনি। সিটে চড়ে চালাতে না পেলেও দিনশেষে বিল্টুর অনেক বড়ো প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে। হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালানো শিখেই যায় শেষমেশ। চোখের জলের দাম অবশেষে দিতে পেরেছে বিল্টু।
বিল্টুর পায়ে দু-তিন দিন ভীষণ ব্যাথা। এই নিয়ে ওর মা প্রচন্ড রাগ দেখিয়েছে। সাইকেল চালানো নিয়ে নিজের ছেলেকে কেউ এভাবে মারে! তবে বিল্টুর মধ্যে বিশেষ কোনো হেলদোল দেখা গেল না। আগামী দুই তিনদিনের মধ্যেই পুরোপুরি সাইকেল চালানো শিখে যায় সে।
ক'দিন পরের ঘটনা। বিল্টুর মা খেয়াল করে বিল্টু আজকাল ওর বাবাকে কেমন যেন এড়িয়ে চলছে। ব্যাপারটা বুঝতে বাকি থাকে না ওর মায়ের। তবুও বিল্টুকে জিজ্ঞাসা করে ওর মুখ থেকে কথাটা জানতে চান তিনি। ওর সাথে কথা বলে এতটুকু স্পষ্ট যে সেদিন সাইকেল চালাতে শেখাতে নিয়ে গিয়ে সমস্ত বন্ধুদের সামনে ওর বাবা যে উত্তম-মধ্যম দিয়েছে সেটাতে বিল্টুর আঁতে ঘা লেগেছে। ওর মা এ বিষয়ে বোঝাতে চাইলেও বিল্টু বুঝতে নারাজ। সেদিনের ওর বাবার রাগের আসল কারণটা বললে হয়তো বিল্টু সবটাই বুঝে যেত। কিন্তু ওর বাবা বিল্টুকে জানাতে নিষেধ করেছিল।
আজ প্রায় বারো বছর অতিক্রান্ত। ঐ একটা ছোট্ট ঘটনা যে বিল্টুর মনে এতটা ক্ষতের সৃষ্টি করবে সেটা ভাবনারও অতীত। বাবার সাথে ওর সম্পর্কটা আজও স্বাভাবিক হয়নি। এই বারো বছরে বিল্টু ওর বাবার সাথে ক'দিন কথা বলেছে, হাতে গোনা যাবে। মাঝে মাঝেই ওর বাবার বুকে মোচড় দেয়। তবে ভেতরের কষ্টটা বুঝতে দেননা কাউকেই। বাবা তো, তাই হয়তো এসব সইতে হয়! অনেক ঝড় ঝাপটা এলেও এতদিন তিনি বিল্টুর পড়াশোনায় কোনো খামতি রাখেননি। ফলস্বরূপ বিল্টু গতবছর এক সরকারি অফিসের করণিক-এর চাকরি পায়। এরমধ্যে দুটো ঘটনা ঘটে। বিল্টু নতুন একটা মোটরসাইকেল কিনে আনে দুপুরের দিকে। অফিসে যাতায়াত করতে এটার দরকার ছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটে রাতের দিকে। এটা অবশ্যই খুব খারাপ খবর, অন্তত বিল্টুর বাবার জন্য। ব্যাবসায়ী সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে স্টল ছাড়া দোকান করা যাবেনা কারুর। আর দখলে রাখা জায়গা আগামী দশ দিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। দোকানটা না থাকলেও হয়তো আর্থিক কোনো সমস্যা হবে না, তবুও এই খবরে বিল্টুর বাবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কত স্মৃতি, কত আবেগ জড়িয়ে এই দোকানের প্রতি।
আজকাল বিল্টুর বাবা বাড়িতেই বসা। দোকানটা নেই আর। বিল্টুর নতুন মোটরসাইকেল টার দিকে মাঝে মাঝেই চেয়ে দেখেন তিনি, আর সাথে সাথেই সেদিনের ঘটনাটা মনে করেন,
"সত্যিই তো, বিল্টুকে ওভাবে মারা'টা ঠিক হয়নি সেদিন।"
বিল্টু অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে মা-ছেলেতে অনেক কথা হয়।
"তোর ছুটির দিনগুলোতে বাবাকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরে আসতে পারিস তো। মন খারাপ করে বাড়িতে বসে থাকে সারাটা দিন।" এ কথার উত্তরে বিল্টু নীরব। সত্যিই তো, বিল্টু বাইক কেনার অনেকদিন হয়ে গেল। এর মধ্যে মা'কে বাইকে চড়িয়ে ঘুরিয়েছে, কিন্তু বাবার কথা একটা দিন মনেও করেনি। বিল্টুর মা আর চুপ করে থাকতে পারে না। বাবা-ছেলের মধ্যে গড়ে ওঠা ভুল বোঝাবুঝি, অভিমান কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তাকে। ওর বাবা যতই বলতে মানা করুক, সত্যিটা আজ বিল্টুকে জানতেই হবে। বলতে শুরু করেন তিনি,
"জানিস নিশ্চয়ই, বাজারে আমাদের কেনা জায়গা ছিলনা। তোর বাবা যে চায়ের দোকানটা করতো, সেটা দখলের জায়গা। সেই বছর তোর বাবা কষ্ট করে পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে ছিল। বাজারে নতুন স্টল তৈরি হবে। শর্ত ছিল, যাদের নিজস্ব জায়গা নেই তারা দশহাজার টাকার বিনিময়ে নতুন স্টল পাবে। স্টল তৈরি হতে হতে বাকি টাকাটা ও কোনভাবে ম্যানেজ হয়ে যেতো। হঠাৎ তুই জেদ করলি সাইকেল কিনে দিতে। প্রথমটায় রাজি না হলেও শেষে তোর পড়াশুনার কথা ভেবে বাধ্য হয়েই সাইকেলটা কিনে দিতে রাজি হতে হয়। সেদিনই দোকানের স্টল কেনার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয় তোর বাবাকে। তোর বাবার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল সেদিন। তাই হয়তো তোকে সাইকেল চালাতে শেখাতে গিয়ে রাগ আটকে রাখতে পারেনি। আজ তো দোকানটা ও রইলো না, চাকরিটা না পেলে কী করে চলতো সংসার?"
বিল্টু না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। মাঠের এককোণে চুপ করে বসে থাকে। পুরনো কত কথা যে মনে পড়ে। অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পায় বিল্টু, সে সাইকেল চালাতে চেষ্টা করছে আর পেছন পেছন বাবা লাঠি নিয়ে ছুটছে। চোখের জল আর বাধ মানলো না। বাবার উপর কী রাগটাই না পুষে ছিল এতদিন! ছিঃ! নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জায় মরে যায় সে। সব বাবা-ই যে তার ছেলেমেয়ে বা সংসারের জন্য প্রাণপাত করে এটা অনেকসময়ই আড়ালে থেকে যায়। বিল্টুর নতুন সাইকেলের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে ওর বাবা সেদিন নতুন দোকানের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়েছিল।
সাধারণত বাজার খরচ বিল্টুর বাবা-ই করে। আজ অনেকদিন পর বাজারে ঢোকে সে। দখল জায়গাগুলো ভেঙে নতুন স্টল তৈরি হচ্ছিল। নতুন সব স্টল ই এবারে চড়া দামে বিক্রি হবে জানিয়ে দেয় ব্যাবসায়ী সমিতি। বিল্টুর কাছে এটাই বাবার স্পপ্ন পূরণের শেষ সুযোগ। যে জায়গায় আগে ওদের চায়ের দোকানটা ছিল, সেটাই লাগবে ওর। দাম নিয়ে রফা হয়ে যায়। তবে সবটাই গোপন থাকে। মাঝে দুটো মাসের বিরতি। মা'কে নতুন শাড়ি, বাবাকে নতুন পাজামা পাঞ্জাবী পড়িয়ে সকাল সকাল তৈরি হয় বিল্টু। বাজারটা কাছেই। বাইকে দুজনকেই উঠিয়ে নেয় সে। প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারে না ওর বাবা-মা। বাইকটা গিয়ে থামে একটা নতুন স্টলের সামনে। সামনেটা ফুলে দিয়ে সাজানো। ক'দিন আগের চেনা জায়গাটা ও যেন অচেনা লাগে ওর বাবার। একজোড়া চাবি বাবার হাতে তুলে দিয়ে বিল্টু বলে, "বাবা তোমার নতুন দোকান। পারলে সেদিনের জেদের জন্য ক্ষমা করে দিও আমাকে।" বিল্টুর বাবার মনে চরম বিস্ময়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। আজ এতদিন পর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বিল্টুর মা। তার সামনেই আজ বাবা-ছেলের মধ্যে গড়ে ওঠা অভিমানের সেই অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে চুরমার।