প্রায়শ্চিত্ত : পূর্বাশা ঘোষ


 

খান্ডেলওয়াল ইন্ডাস্ট্রিসের একমাত্র কর্ণধার নীরজ খান্ডেলওয়ালের হুকুম বা খামখেয়ালিপনাকে অগ্রাহ্য  করে,  এমনও  কেউ  যে আছে তা জানে ওই কোম্পানির ছোটো বড়ো সকল কর্মচারী থেকে শুরু করে অফিসের কেরানিটি  পর্যন্ত। নীরজ স্যারের ডানহাত আদিত্য চৌধুরীর অঙ্গুলি হেলনেই  খান্ডেলওয়াল ইন্ডাস্ট্রিসে দিন ও রাত্রি হয়।চরম মাত্রায় অধ্যাবসা আর অপরিসীম  জেদই নীরজ খান্ডেলওয়ালকে একটি অতি সাধারণ জামা কাপড়ের দোকান থেকে নিজের ইন্ডাস্ট্রিসের মালিক করে তুলেছে। কোটিপতি হলেও তিনি ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। মাইনে একটু কম দিলেও অধীনস্ত কর্মচারী মহলে  মিস্টার খান্ডেলওয়ালের জনপ্রিয়তা ভালোই আছে। আসলে মানুষটা বেশ হাসি খুশি। আর সহজেই সবাইকে আপন করে নেন। যদিও এটাও ব্যবসারই একটা ট্রিক। তবুও সাধারণ কর্মচারীরা তাতেই খুশি। 


তা এতদিন সব মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু ইদানিং কোম্পানির অভ্যন্তরে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বয়স্ক জনিত কারণে মিস্টার খান্ডেলওয়াল কোম্পানির সবদিকটা ঠিক মতো সামলে উঠতে পারছেন না। অধিকাংশ দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন তার স্নেহের পাত্র আদিত্যর কাঁধে। যদিও উনার নয়নের মণি হলেও আদিত্য বা ওরফে চৌধুরী স্যার অফিসের প্রতিটি স্টাফের দু চোখের বিষ।


কি গুন নেই এই আদিত্য চৌধুরীর!বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হবে। চেহারায় যেমন সুপুরুষ, বুদ্ধিতেও তেমনই তুখোড়। তবে চটুল বুদ্ধির পরিমাণটাই বেশি। এহেন হ্যান্ডসম, ইন্টেলিজেন্ট, ড্যাশিং পুরুষে মজবেনা তেমন মেয়ের সংখ্যা নেহাতই নগন্য। অফিসে পুরোনো বা নতুন যে কোনো মেয়েকেই  আদিত্য স্যারের মন জুগিয়ে চলতেই হয় । 


আসলে  মহিলা  জাতিকে বরাবরই আদিত্য চৌধুরীর  বড্ড বেশি  পছন্দ । উপযুক্ত মাইনে, কম কাজের চাপ, ভালো ব্যবহার.. এই সবই অফিসের মহিলাদের  ঝোলায়। আর পুরুষ এমপ্লয়ীদের জন্য সবসময়ই যেন শ্বাসরোধ করা নিয়ম নীতি।


 একদিকে মহিলা কর্মচারীদের  চাইলেও কোম্পানি ছাড়ার উপায় নেই অন্য দিকে অধিকাংশ পুরুষ কর্মচারী  চাকরি ছেড়ে অন্যত্র  জীবিকার সন্ধান করে চলেছে। কোম্পানির মালিকের এই অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলতার জন্য খান্ডেলওয়াল ইন্ডাস্ট্রিস ভিতরে ভিতরে খইতে শুরু করেছে। সুদক্ষ এমপ্লয়ীরা কাজ থেকে রেজিগন্যাশন দিয়ে চলে যাওয়ার ফলে ব্যবসাও লসে রান করতে শুরু করছে। 


কিন্তু এই সব কিছুর মাঝেও একটি মানুষের অবস্থা সব থেকে বেশি বেহাল। তিনি হলেন এই কোম্পানির প্রায় তিরিশ বছরের পুরোনো কর্মচারী শিবেন পাল। পদে তিনি বেয়ারা কিন্তু বড়ো মালিকের সবচেয়ে প্ৰিয় পাত্র তিনি। একরকম চোখে হারান তাকে এই খান্ডেলওয়াল ইন্ডাস্ট্রিসের সৃষ্টি কর্তা। আসলে কোম্পানি  সৃষ্টির শুরু থেকেই একমাত্র এই মানুষ টি  এখনও রয়ে গেছেন। বলা ভালো টিকে গেছেন।


 সবার কাছে শিবেন দা নামে জনপ্রিয় অমায়িক এই মানুষটি মাথা নীচু করে মুখবুজে এতোগুলো বছর এই কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারীর সেবা করে গেছেন। আদ্যন্ত সৎ মানুষটি তার জীবনের অধিকাংশ সময়টি শুধুমাত্র অন্যের হুকুম তামিল করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন তার এই প্রাণাধিক প্ৰিয় কোম্পানির মান  দিন দিন নিম্নমুখী হওয়ায় শিবেন দা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।শরীরের বিভিন্ন অসুখে জর্জরিত  বড়বাবুকে তিনি কিছু বলতেও চান না। কারণ, নিঃসন্তান নীরজ খান্ডেলওয়াল আদিত্যকেই তার সন্তান রূপে স্নেহ করেন। তাই  শিবেন দা এই বয়সে এসে তার বড়ো বাবুর মন ভাঙতে চাননা। কিন্তু তা বলে এমন বিশৃঙ্খলা তো চোখেও দেখা যায়না।সাহসে ভর করে ছোটো বাবুকে একদিন সে বলেই ফেললো,

 " ছোটো বাবু, ছোটো মুখে বড়ো কথা। কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা বলি? "

" আবার কি ঘ্যান ঘ্যান করতে এলে। আজ অফিস পাঁচটায় বন্ধ করে দেব। আমার ক্লাবে ইনভিটেশন আছে। তুমি বরং সবাইকে বাড়ী চলে যেতে বলো। "

" আজ্ঞে, বাবু এই ভাবে চলতে থাকলে তো আমার বড়বাবুর সাধের এই কোম্পানি লাটে উঠবে। আমি তো দেখেছি কত রক্ত জল করে এই অফিসের প্রতিটা ইঁট গেঁথেছিলেন তিনি। তাই বলছিলাম,  এমন  করবেন না। "

" কি ! তোর এতো সাহস। আমাকে কিনা জ্ঞান দিতে এসেছে এক অশিক্ষিত বেয়ারা।ওও! ভয় দেখানো হচ্ছে আমাকে। দাঁড়া, তোর চাকরি তো আমি খেতে পারবো না। চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে যাবে। কিন্তু তিন মাসের মাইনে তো বাতিল করতেই পারি। "

" অমন করবেন না ছোটোবাবু। এই বয়সেও খেটে যাচ্ছি শুধু সংসারের অভাব মেটানোর দায়ে। আপনাদের ভালো চাই। তাই বললাম। মাফ করে দিন। "

" তিন মাস আর মাইনে হাতে পাবি না। যা করার করে নে। "


আহত শরীর, নিহত মন নিয়ে ছোটবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শিবেন। হাত জোড় করে অনুরোধ করলেও পায়ে সে পড়েনি। গরীব হলেও ওটুকু সম্মান জ্ঞান তার অবশ্যই আছে। মনে মনে সে ভাবলো, দেখাই যাক আগামী তিন মাস কেমন কাটে। 


সত্যিই, আগামী তিন মাস খান্ডেলওয়াল ইন্ডাস্ট্রিসের জন্য অত্যন্ত খারাপ প্রমানিত হল। ব্যবসায় আয়ের ঘরে শূন্য, অফিসের কর্মচারী প্রায় শূন্য, মহিলাদের বাড়বাড়ন্তও ওই শূন্যই । পড়ে  থাকলো  ধার বাকির বোঝা,  আর তার একমাত্র কারণ আদিত্য চৌধুরী। আরও একজন রয়ে গেল, শিবেন দা।


এমনই একদিন সন্ধ্যা হওয়ার মুখে ছোটবাবু বেরিয়ে গেলে ফাঁকা অফিস তালা দিয়ে সবে বেরোতে যাবে শিবেন,  এমন সময় লকার রুমে আলো দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। ফাঁকা অফিস, বাবুও নেই তবে বন্ধ লকার রুমে আলো কেন। গুটি গুটি পায়ে ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো শিবেন। এরপর ঘরের ভিতরে র দৃশ্য দেখে তার তো চোখ ছানাবড়া। শিবেন দেখলো ছোটবাবু লকার থেকে কয়েক বান্ডিল টাকা নিয়ে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। আড়াল থেকে পুরোটাই দেখলো শিবেন। 


এরপর দিন থেকে আদিত্য চৌধুরী কোথায় গায়েব হয়ে গেল। কেউ জানে না। ফলত, অফিসে তালা পড়লো। এর কিছুদিন পর টাকার হিসাবের গরমিলের অভিযোগে  খান্ডেলওয়াল ইন্ডাস্ট্রিসে পুলিশ এলো টাকা তছরুপের তদন্ত করতে। উধাও হয়ে যাওয়া আদিত্য চৌধুরীকেই সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রাখলেও একে একে সবাইকেই পুলিশ জেরা করতে শুরু করলো। সবে পুলিশ  জেরা শুরু করতে যাবে  এমন সময় শিবেন পাল বলে উঠল, 

" স্যার, চুরিটা আমি করেছি। তিন মাস মাইনে পাইনি। পেটের অভাবে আর উপায় না পেয়ে অবশেষে লকার থেকে টাকা চুরি করেছি আমি। এতদিন এখানে বেয়ারার কাজ করছি কোথায় কিসের চাবি থাকে সবই আমার নখদর্পনে। "


পিতৃসম বড়বাবুর আদেশেই পুলিশ এরেষ্ট করলো শিবেনকে। 


পুলিশ কাস্টডিতে থাকার তিনদিনের মাথায়  দুপুর বেলা আদিত্য চৌধুরী এলো শিবেনের সাথে দেখা করতে। 

" কেন তুমি চুরির দায় নিজের ঘাড়ে নিলে। আমি জানি যে তুমি জানতে আমিই দোষী। আমিই চুরিটা   করেছি। আমি এটাই জানতে এলাম যে,  কেন তুমি...? "

"বাবু, আমি হলাম গিয়ে অশিক্ষিত চাকর বাকর মানুষ। থাকলাম কি না থাকলাম কারোর কোনো যায় আসবে না। এমনিও গত দুমাস ধরে কোনোমতে খাওয়া জুটছে না।  তার চেয়ে বরং জেলের ভাতই খাই। ছোটবাবু, আপনি থাকলে আমার বড়বাবুর কোম্পানি আবার নতুন করে শুরু হতে পারবে। উনার স্বপ্ন ব্যর্থ  যাবে না।  আপনিই পারেন আবার সবকিছু ফিরিয়ে দিতে। তাই আপনার থাকা যে বড্ড প্রয়োজন। "


ফিরে  গেল আদিত্য সেদিন। 


পরদিন পুলিশ অফিসার শিবেনকে ডেকে বললেন, " হ্যা রে, এমন মালিকের জন্য জেলের ঘানি টানার এতো সখ ! তোর মতো এমন কর্মচারী আর দেখিনি রে। তোর মালিক আদিত্য চৌধুরী তার দোষ স্বীকার করেছে। আর সমস্ত টাকা ফেরত দিয়েছে। আগরওয়াল স্যার তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছেন। "


শিবেন জেল থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দেখলো হাতকড়া পরে আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। 

" কেন এমন করলেন বাবু? কি দরকার ছিল? "

"নিজে দোষ স্বীকার করেছি আর টাকা ফেরত দিয়েছি বলে হয়তো আমার সাজা কিছু কম হবে। জেল থেকে বেরিয়ে তোমার স্বপ্ন সার্থক করবই। কথা দিলাম। "


একজন বেরিয়ে এলো মুক্ত বাতাসে, অন্য জন ফিরে গেল বদ্ধ আকাশে।

Post a Comment

Previous Post Next Post