"ও মা, আজ টিফিনে লুচি, আলু ভাজা দিও না গো।" ঘর থেকে শোনা যায় তিতির আব্দার। "আমার শার্টটা ইস্ত্রি করেছ?" তন্ময়ও কিছু কম যায় না আব্দার জানানোয়। "দুটোই সমান, আমি কিচ্ছু পারব না, যাও।" রাগ করে বলে ওঠে তনয়া। "মা, প্লিজ ....প্লিজ ....।" "ওগো, দয়া কর, আমার অফিসে লেট হয়ে যাচ্ছে। " একা একাই রান্নাঘরে হেসে ফেলে তনয়া। বেশ খানিক পর দেখা যায়, এক হাতে লুচি, আলু ভাজা ভরা টিফিনবক্স আর অপর হাতে ইস্ত্রি করা শার্ট নিয়ে তনয়া হাজির। তিতি ছুটে এসে মায়ের গালে চকাস্ করে চুমু খেয়ে বলে, " এই না হলে আমার মা!" তন্ময়ও বউয়ের আরেক গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে ওঠে, " এই না হলে আমার বউ!" তনয়া লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে, " যত্তসব আদিখ্যেতা, বয়স তোমার কমছে না বাড়ছে?" বলে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে যায়। বাপে মেয়েতে খুব একচোট হাসাহাসি চলে। বেশ কিছুক্ষণ পর তনয়া এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এতক্ষণের ঝড়টা থেমেছে। সকাল থেকে যা চলে! বাপ মেয়ে দুজনেই যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এখন তনয়ার অখণ্ড অবসর। সামনে পড়ে আছে এক লম্বা অলস দুপুর। তারপর সন্ধ্যায় সবাই ফেরার পর আবার তনয়ার রেলগাড়ি চালু। নিত্য নতুন খাবার বানানো, মেয়েকে পড়ানো, তন্ময়কে টিভি দেখায় সঙ্গদান, তারপর একসঙ্গে রাতের খাবার খাওয়া। সে সময়ে তিনজন নিজেদের সারা দিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। এক কথায় হাসিখুশি সুখী পরিবার। মাঝে মাঝে তনয়ার মনে হয়, অনেক ভাগ্য করে এমন বুঝদার, যত্নশীল, ঘরোয়া স্বামী ও সন্তান পেয়েছে সে।
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে তনয়া বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল ফোনটা নিয়ে। এসময়টায় সে সোশাল মিডিয়ায় সময় কাটায়। হঠাৎ টুং করে সুরেলা আওয়াজে একটি মেসেজ ঢুকল। নামটা দেখে তনয়ার গোটা পৃথিবী যেন থমকে গেল। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। তনয়ার সুখী সংসার এই নামটা প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছিল তনয়াকে।
অয়ন। স্কুল জীবনটা একসঙ্গেই কাটিয়েছে ওরা। অয়ন, তনয়া দুজনেই ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্রছাত্রী। দুজনেরই পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনোদিকে মন ছিল না। কিন্তু কি করে কবে থেকে যে মনে মনে ওরা একে অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল সেটা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারে নি। মুখ ফুটে কেউই কাউকে কিছু বলে উঠতে পারে নি কখনও। শুধু চোখের ভাষাই ছিল ওদের সম্বল। অনেকগুলো বছর স্কুলে এভাবেই কেটে গিয়েছিল। স্কুলের শেষ বছরে অয়ন চেষ্টা করেছিল নিজের মনের কথা তনয়াকে জানানোর। কিন্তু তনয়ার অসম্ভব লজ্জা, তার পালিয়ে বেড়ানো অয়নকে সফল হতে দেয়নি। স্কুল শেষ। যোগাযোগেরও ইতি।তনয়া কলেজে ভর্তি হল। মনে দৃঢ় বিশ্বাস, ভগবান ঠিক সময়ে অয়নের সঙ্গে আবার দেখা করিয়ে দেবেন। অয়নকে যে সে মনে মনে স্বামীর জায়গা দিয়ে ফেলেছে। বোকা মেয়ে! নিজের ভুলেই অয়নকে সে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কলেজ জীবনও শেষ হল। অয়নের সঙ্গে আর কোনো দিন তার দেখা হয় নি। বাড়িতে যখন তার বিয়ের কথাবার্তা শুরু হল, তখন তনয়া উপলব্ধি করল কি ভুল সে করে ফেলেছে। এতদিনের অপেক্ষা- সব ব্যর্থ। একটা সময় সে বুঝতে পারল অয়নের সঙ্গে দেখা হওয়া অসম্ভব। তার কোনো খবর সে জানে না। মুখচোরা স্বভাবের কারণে মনের কথা কাউকে বলেও উঠতে পারল না সে। আর কোন পথ খুঁজে না পেয়ে বাড়ির চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয় সে। তনয়ার জীবনে আসে তন্ময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তন্ময়ের ভালোবাসায়, যত্নে তার মন থেকে অয়নের ছবিটা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যায়। আর মেয়ের জন্মের পর এক দমকা হাওয়ায় ভেসে যায় অয়ন অনেক দূরে।
আজ এত বছর পর কোথা থেকে আবার ঐ নামটা তার জীবনে ঝড় তুলতে এল! ফোনের আওয়াজে ঘোর কাটল তনয়ার। ফিরে এল পুরোনো যুগ থেকে আজকের দিনে। অচেনা নম্বর। ধরবে কি ধরবে না, ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল। আবার ফোনটা বাজছে। এবার ফোনটা ধরল তনয়া।
- হ্যালো .....- ..............- হ্যালো .....- তনয়া?
- বলছি....আপনি?
- আমি অয়ন। - ..............- কথা বলবি না, তনয়া?
নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না তনয়া। হৃৎপিণ্ডের গতি এত বেড়ে গেছে যে মনে হচ্ছে তনয়া বোধহয় অজ্ঞানই হয়ে যাবে।
- তনয়া, শুনতে পাচ্ছিস?
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো তনয়া।
- হ্যালো.....হ্যাঁ .....বল্.....কেমন আছিস?
- তুই কেমন আছিস, তনয়া?
- ভালোই.....
- আমি ভালো নেই রে....- ................- কিছু বলবি না, তনয়া?
- হুঁ..........
- অনেক কষ্টে তোর নম্বরটা জোগাড় করেছি। তোর সব খবরই পেলাম। বিয়ে করেছিস, খুব ভালো আছিস, একটা ফুটফুটে মেয়েও আছে তোর।
- তোর কটা ছেলেমেয়ে, অয়ন?
- হাহাহাহা......ছেলেমেয়ে? বিয়েটাই তো করে উঠতে পারলাম না। একজনকে ছোটবেলা থেকেই এমনভাবে মন দিয়ে ফেললাম......আর কাউকে সে মন দিতেই পারলাম না।
- আমার খুব খারাপ লাগছে, অয়ন।
- নাঃ.....মন খারাপ করিস না, তনয়া। আমার ভাগ্যে বোধহয় লেখা ছিল না তোকে পাওয়া। এত লাজুক ছিলি তুই.....সব গড়বড় করে দিলি। তোর গম্ভীর মুখটা দেখে আমিও স্কুলে কিছুই বলে উঠতে পারলাম না। ছাড়্, এসব পুরোনো কথা। মাঝে মাঝে তোকে ফোন করে জ্বালালে ফোন ধরবি তো?
হেসে ফেলে তনয়া। ফোনটা রাখার পর এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ভরে ওঠে তার।মনে হয়, তার জীবনটা যেন পূর্ণ হল আজ। এরপর থেকে প্রায়ই দুপুরে কথা বলে তারা।
আজকাল আর সংসারে সেভাবে মন বসতে চায় না তনয়ার। সব কাজে ভুল হয়ে যায়। তন্ময়, এমনকি তিতির চোখেও তা ধরা পড়ে। তিতি প্রশ্ন করে, "মা, তোমার কি হয়েছে?" তন্ময়ও মজা করে, " কি ব্যাপার ম্যাডাম? আজকাল আমাকে পাত্তাই দিচ্ছ না মোটে! প্রেমটেম করছ, নাকি?" হালকা মজার ছলে বলা কথাটাই তনয়ার বুকে তীরের মত এসে বেঁধে। স্বপ্নের জগত থেকে ও নেমে আসে বাস্তবের মাটিতে। কি করছে সে? কোন পথে চলেছে সে? হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে যায় তনয়ার। সে কি তন্ময়কে ঠকাচ্ছে? মা হিসেবেই বা সে কেমন? অনেক অনেক ভাবতে থাকে সে।অনেক কষ্টে মনকে বোঝায় সে। অতীতকে অতীতেই ফেলে আসতে হয়, বর্তমানে আনতে নেই। খুব খুব কষ্ট হতে থাকে তনয়ার। উপলব্ধি করে, এখনই না থামলে ভবিষ্যতে হয়তো অনেক বড় ভুল সে করে ফেলতে পারে।
নির্দিষ্ট সময়ে ফোনটা বাজছিল।বার বার বেজে বেজে ফোনটা একসময় থেমে গেল। আজ আর কেউ ফোনটা ধরল না। ওপারের মানুষটি উদ্গ্রীব হল। আবার ফোন করল। কিন্তু না। এবারও কেউ ফোনটা ধরল না। তনয়া ধীরে ধীরে ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বরটা ব্লক করে দিল। আজ থেকে আর কখনো অয়নের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকবে না তার। অতীতের সুন্দর, মন ভালো করে দেওয়া মিষ্টি স্মৃতি হয়েই থেকে যাক্ অয়ন। বর্তমানে তার কোনো ছায়া পড়তে দেবে না সে। মনের গোপন কুঠুরিতে খুব যত্ন করে রেখে দেবে তনয়া তার প্রথম ভালোবাসাকে।
আজ বাড়ি ফিরে তন্ময় ও তিতি তো অবাক। অনেক অনেক দিন পর তনয়া আগের মত কত্ত কত্ত ভালো ভালো রান্না করেছে। আর কি হইহই করছে তনয়া। যেন পুরোনো তনয়া ফিরে এসেছে। বাপমেয়ে দুজনেই তনয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল," এইবার তোমাকে চিনতে পারছি। মাঝে কদিন যেন তোমাকে চিনতেই পারছিলাম না।" তনয়া হেসে বলল," বয়স হচ্ছে তো, ভীমরতি ধরেছিল আমায়।" তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠলো। গোপনে চোখের জলটা মুছে মনে মনে বলল তনয়া, "বিদায় বন্ধু, বিদায় "।