"মাসিমা, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনি এখানে বসুন..." গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্কা মানুষটিকে সহজ করতে চেষ্টা করে অভিনব।
সে নিজেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই। তিয়াসা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা!
"মা, মা, দেখ... এক দিদা এসেছে আমাদের বাড়িতে..." একছুট্টে রান্নাঘরে এসে তিয়াসাকে খবরটা দেয় পাঁচ বছরের তিন্নি।
ছুটির দিনের জম্পেশ খাবারের আয়োজনে মহাব্যস্ত তিয়াসা মেয়ের কথায় একটু অবাকই হয়।
"এই... একটু শুনবে ...একটু কথা ছিল..." অভিনবের এই সুর তিয়াসা বিলক্ষণ চেনে।
সে প্রমাদ গোণে, "আবার কাউকে ধরে এনেছ?"
"না না, শোন না... বৃদ্ধা অসহায় অবস্থায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিলেন। স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন, অসুস্থ ... কি করে ওনাকে ওভাবে রাস্তায় ফেলে চলে আসি! মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াব না?"
"মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে ঠকেছ তো অনেকবারই! তাও তুমি বদলাবে না!"
"প্লিজ তিয়াসা, তুমি তো চেনো আমাকে। আমি... আমি যে এমনই ... তোমাকে খালি বিপদে ফেলে দিই... আমার মত মানুষের বোধহয় বিয়েই করা উচিত হয়নি!"
"ব্যস, হয়েছে ... অনেক হয়েছে... চল এবার..." কি করে আর রাগ করে থাকতে পারে তিয়াসা!
দুজনে বসার ঘরে এসে দেখে, তিন্নি বৃদ্ধার সাথে গল্পে মেতে উঠেছে। ওদের দেখেই উনি জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
"আপনি বসুন মাসিমা, কটাদিন আমাদের বাড়িতে থাকুন। আপনি যাতে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারেন, তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব।" তিয়াসা বৃদ্ধাকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে।
ওনার থাকার ব্যবস্থা করে তিয়াসা ঘরে আসতেই অভিনব তাকে জড়িয়ে ধরে, "এই না হলে আমার বউ! তোমার মত করে কেউ আমাকে বুঝবে না!"
"আর মাখন লাগাতে হবে না। আসলে...আমারও খারাপ লাগছিল। ওনাকে দেখে তো ভদ্রঘরের বলেই মনে হচ্ছে। সবকিছু ভুলে গিয়ে কি অসহায় অবস্থায়! বাড়িতে ওনার আপনজনেরাও কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছে!"
"সেটাই... আমি কালই থানায় গিয়ে সবটা জানিয়ে আসব। দেখা যাক, কি হয়!"
"মা, মা, আমি কিন্তু আজ থেকে দিদার কাছেই শোব। দিদা এখানেই থাকবে তো? কোথাও চলে যাবে না তো?" কচি গলায় বলে ওঠে তিন্নি।
তিয়াসার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তাদের বিয়েটা দুই বাড়ির কেউই আজও মেনে নেয়নি। তিন্নির জন্মও কাউকে তাদের কাছে আনতে পারেনি। দাদু দিদা ঠাম্মার ভালবাসা তাই বাচ্চাটার কাছে অচেনাই রয়ে গিয়েছে।
বন্ধুরা যখন দাদু দিদার আদর খায়, তিন্নি সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে থাকে, মাঝেমাঝে প্রশ্ন করে, " আমার দাদু দিদা নেই কেন?"
সেসময়গুলোতে বড্ড অসহায়বোধ করে তিয়াসা। অতটুকু বাচ্চাকে কি উত্তর সে দিতে পারে!
তাই বোধহয় হঠাৎ পাওয়া এই অচেনা বৃদ্ধাকে তিন্নি এতটা আঁকড়ে ধরেছে। সন্ধ্যেবেলায় তিন্নিকে পড়াতে বসাবে বলে তাকে ডাক দেয় তিয়াসা। কোন সাড়া না পেয়ে সে বৃদ্ধার ঘরে যায়। পরম বিস্ময়ে সে দেখে তিন্নি তার নতুন দিদার কাছে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। সেই সন্ধ্যেটায় তিন্নিদের বাড়ি থেকে কোন বকাবকি, মারধরের আওয়াজ পাওয়া গেল না। বহুকাল পরে তিয়াসা এক কাপ চা নিয়ে টিভির সামনে বসল, অভিনবের সাথে একান্তে সময় কাটাল... কতকাল নিজেদের কথাগুলো বাকি রয়ে গিয়েছিল!
পরদিন সকালে রোজকার মতই অভিনবের অফিস, তিন্নির ইস্কুলের জন্য প্রচণ্ড ব্যস্ত তিয়াসা।
"আমি কি কিছু সাহায্য করব তোমাকে?" পায়ে পায়ে রান্নাঘরে এসেছেন বৃদ্ধা।
"না...মানে... আপনি আর কি করবেন!"
"আমি তিন্নিকে তৈরি করে দিই?"
"দেখুন... যদি পারেন..."
সকলের টিফিন, জলের বোতল গুছিয়ে, জলখাবার নিয়ে টেবিলে এসে তিয়াসা অবাক! বাবার সাথে তিন্নিও একদম তৈরি! সেদিন ইস্কুলের গাড়ি আসার অনেকটা আগেই ধীরেসুস্থে তিন্নিকে নিয়ে বেরোলো অভিনব।
"মাসিমা, আপনার চা..." তিয়াসার জীবন যেন এক নতুন খাতে বইতে থাকে...
কতকাল পর কারোর সাথে গল্প করতে করতে চা খাওয়া ...
এঁটো হাতেই গল্প করে যাওয়া...
মনের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া ...
ঠিক যেন মায়ের মত...
তিন্নিও তার নতুন দিদাকে পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা ...
খেলাধুলো, পার্কে যাওয়া, পড়াশোনা করা, গল্প শোনা... নতুন দিদা নতুন করে যেন তার ছোট্ট জীবনে আলোর দিশা দেখালেন!
অভিনব একটু আধটু একাকীত্বের ফাঁদে বন্দি হয়ে যাচ্ছিল! তিয়াসা যে তিন্নিকে নিয়ে এতই ব্যস্ত! নতুন দিদা আসার পর আবার তিয়াসা তার সাথেও সময় কাটাতে সক্ষম হল।
দিন কেটে যায়। অজানা এক বৃদ্ধা কি করে যে একটু একটু করে এ সংসারের অংশ হয়ে ওঠেন, এ সংসারটাকে নিজের করে নেন, তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না!
"হ্যালো, অভিনববাবু? থানা থেকে বলছি... আপনাদের বাড়িতে আসা ঐ বৃদ্ধার বাড়ির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। আমি ওনার ছেলেকে নিয়ে আধঘন্টার মধ্যে আসছি।" পুলিশ অফিসারের ফোন পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল অভিনবের।
"না, না, আমি মাসিমাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারব না! ওনার মধ্যে আমি যে মাকে খুঁজে পেয়েছি!" কান্নায় ভেঙে পড়ে তিয়াসা।
"তিয়াসা মা, এখনও জলখাবার খাওনি! কতদিন বলেছি তোমাকে, ঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া করতে! তুমি অসুস্থ হলে সংসারটা টিকবে! কি... কি হয়েছে মা? কাঁদছ কেন?"
"আমাদের ছেড়ে কোথাও যেও না তুমি ... আমরা তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না! আর ... আর তিন্নি ... ও তো তোমাকে ছেড়ে থাকতেই পারবে না!" মাসিমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই থাকে তিয়াসা।
"কি বলছ... কেন বলছ এসব কথা ... আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!" বৃদ্ধা বিভ্রান্তির দোলাচলে বিব্রত!
এমনসময় কলিংবেলটা বেজে উঠল তারস্বরে। ইতস্ততঃ করে অভিনবই দরজা খুলল।
"মা, তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে আমাদের ছেড়ে?" মধ্যবয়সী ভদ্রলোক জড়িয়ে ধরলেন তিন্নির নতুন দিদাকে।
বৃদ্ধার চোখে জল। তিনিও জড়িয়ে ধরলেন নিজের সন্তানকে। স্মৃতি হারানোর অসুখে ভুগছেন তিনি। ছেলেকে দেখে মনে পড়ছে সবকিছু। অবাক হয়ে সবটা দেখছিল তিন্নি।
"নতুন দিদা, তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?" তিন্নির দুচোখে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি।
ঘরের মানুষগুলো বাকরহিত!
"আ... আমি আসব ... আমি আবার আসব..." কেঁদে ফেলেন বয়স্কা মানুষটিও।
বিষাদের মেঘে ঘরের আবহাওয়া ভারি হয়ে ওঠে। অনেকক্ষণ পরে নিজেকে সামলান বৃদ্ধার সন্তান। অভিনবের দুই হাত ধরে তিনি বলেন, "আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মত স্পর্ধা আমার নেই। আমার মাকে নিজেদের পরিবারের একজন করে রেখেছিলেন আপনারা! কোনদিন সে ঋণ শোধ করতে পারব না আমি। আমার মায়ের উপর আমাদের যতটা অধিকার, আপনাদের অধিকার তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
আচ্ছা তিন্নি, যদি তোমার নতুন দিদা আমাদের কাছে কিছুদিন আর তোমার কাছেও কিছুদিন থাকেন, তোমার কেমন লাগবে?"
"ইয়ে... এ...এ... কি মজা! সত্যিই জেঠু? নতুন দিদা আমাদের কাছেও মাঝেমাঝে এসে থাকবে!" আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে তিন্নি।
নতুন দিদা তাঁর নতুন পাওয়া নাতনি, মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। নতুন সম্পর্কের আলোয় তাঁর দুচোখে জল, মুখে হাসি! ঘরের সকলের মুখে আলোর ছটা! এত খুশিও পৃথিবীতে থাকে!
Tags:
বাংলা গল্প