মিঠেসারি নদীর পাড় ঘেঁষা কাশবনে একটি কাশফুলের গোড়া চিবোতে চিবোতে অধৈর্য পায়ে পায়চারি করছিল মুনিয়া। কখন থেকে সে অপেক্ষা করছে মুংলির জন্য! বেলা পড়ে এল, এখনও বেটার দেখা নেই!
এমনসময় দেখা গেল মুংলিকে, হন্তদন্ত হয়ে আসছে। মুনিয়ার রাগত দৃষ্টি তার উপর।
" রাগ করিস না, মুনিয়া। কি করব বল? সব ফসল গোলায় না ঢোকালে যে ছুটি নেই, বাবা কি একা অত পারে!" তাড়াতাড়ি বলে ওঠে মুংলি।
" আমি কি বলেছি যে তুই রামুখুড়োকে সাহায্য করবি না? আমাকে কি ভাবিস বল তো তুই?" রেগে যায় মুনিয়া, " বলছি... একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারিস তো! বেলা তো পড়ে এল, আজ পশ্চিম জঙ্গলে যাওয়ার কথা ছিল না? এত্ত কামরাঙা হয়েছে, দেখে এসেছি সেদিন। চল চল... তাড়াতাড়ি চল..."
এক ছুট লাগায় দুজনে। গ্রামের সচ্ছল বাসিন্দা যতীনের একমাত্র মেয়ে মুনিয়ার প্রিয় বন্ধু এই মুংলি। তার বাবা রামরতন যতীনের বাড়িতে গৃহসহায়ক। এই অসম বন্ধুত্ব যতীনের একেবারেই পছন্দ নয়। কিন্তু মুনিয়ার জেদের কাছে সে হার মানতে বাধ্য হয়েছে।
" তুমিই তো বল, সব মানুষ সমান। তাহলে আমার বেলায় অন্য নিয়ম কেন?" মুনিয়ার কথায় কোন উত্তর জোগায় না যতীনের মুখে।
অসন্তুষ্ট মনে সে উঠে যায় মেয়ের পাশ থেকে। মুনিয়া অবশ্য এতকিছু নিয়ে ভাবে না। সে তখন ভাবে, কখন মুংলির কাজ শেষ হবে, তারা একসাথে খেলবে!
মুংলির বেশি দেরি হলে অধৈর্য মুনিয়া ছুটে যায়, "ও রামুকাকা, আমি কি তোমাদের সাহায্য করব? তাহলে মুংলি তাড়াতাড়ি আমার সাথে খেলতে যেতে পারবে।"
" না না, দিদিমণি, তোমাকে কিচ্ছুটি করতে হবে না, তোমার বাবা দেখলে ভারি রাগ করবে। এই মুংলি, তুই যা, দিদিমণির সাথে খেলা কর। বাকি কাজ আমি একাই করে নেব।" সন্ত্রস্ত হয়ে বলে রামরতন।
মুংলি হাতের কাজ শেষ করে মুনিয়ার সাথে খেলতে যায়। মুনিয়া মুংলিকে পড়াশোনাও শেখাতে চায়। নিজের ইস্কুলের বইখাতা আর নিজের স্বল্প শিক্ষা দিয়ে প্রিয় বন্ধুকেও শিক্ষিত করে তুলতে চায় সে। পড়াশোনা সাঙ্গ হলে দুজনে মিলে জঙ্গলে ফল পাড়তে যায়, নদীতে মাছ ধরতে যায়...
" ও ভুবনমাঝি, আমাদের একটু ঘোরাতে নিয়ে যাবে?" মুনিয়ার আব্দার ফেলতে পারে না ভুবনমাঝি, ওদেরকে নৌকোয় বসিয়ে মিঠেসারি নদীর পথে বেশ খানিকটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। মুনিয়া তার হাতে তুলে দেয় সদ্য পাড়া কোন ফল। ফোকলা দাঁতে ভারি আমোদিত হয়ে হাসে ভুবনমাঝি।
সে বছর গ্রামে প্রচণ্ড বর্ষা হল। মিঠেসারি নদী জলে টইটম্বুর। সারা বছর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শান্ত নদীটাকে যেন চেনাই যাচ্ছে না! কি দামাল, উদ্ধত তার রূপ। সবকিছু যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা তার মনে! গ্রামবাসীদের মুখ গম্ভীর। সকলেরই মনে বিপদের আঁচ! মিঠেসারির এমন রূপের সাথে কেউই পরিচিত নয়। সকলের মনে আশঙ্কা, মিঠেসারি যদি আরও দামাল হয়ে ওঠে! তবে কি বন্যা? ভয়ে কেঁপে ওঠে সকলে।
শেষপর্যন্ত সকলের আশঙ্কাই সত্যি হয়। মাঝরাতে মিঠেসারি প্রবল বেগে গ্রামকে আক্রমণ করে। প্রবল বৃষ্টির সাথে বন্যার জল সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যতীনের বাড়িও রক্ষা পায় না। তুলনামূলক উঁচু ইস্কুলবাড়িতে যাওয়ার সময় প্রবল স্রোতে মুনিয়া তার বাবা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। স্রোতের সাথে দীর্ঘ লড়াই শেষে একটি গাছকে আঁকড়ে নিজের প্রাণ বাঁচায় মুনিয়া। ভোরের দিকে মুনিয়ার শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। অর্ধ অচেতন মুনিয়ার অবশ হাত গাছের গা থেকে খুলে আসতে চায়।
" মুনিয়া, মুনিয়া... তুই কোথায়? আমার গলা শুনতে পাচ্ছিস? সাড়া দে..." মুংলির গলা না?
সচকিত হয়ে ওঠে মুনিয়া।
সে শরীরের অবশিষ্ট শক্তি জড়ো করে প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে, " আমি এখানে, মুংলি... মুংলি... আমি এখানে..."
মুংলির সাথে থাকা সকলেই মুংলির সাথে চমকে ওঠে।
" ঐ তো ... ঐ তো মুনিয়া, গাছটার কাছে..." অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের আনন্দে মুংলি আত্মহারা! সাঁতার কেটে সে এগিয়ে যায় মুনিয়ার কাছে। অন্যরাও তাকে অনুসরণ করে। মুংলি হাত বাড়িয়ে মুনিয়াকে ধরে। মুনিয়া মুংলির হাত ধরে নিশ্চিন্তির হাসি হাসে, তারপর অজ্ঞান হয়ে যায়। সকলে মিলে ধরাধরি করে তাকে ইস্কুলবাড়িতে নিয়ে আসে। মুংলির মায়ের সেবা শুশ্রূষায় মুনিয়ার জ্ঞান ফেরে।
" যাক বাবা, কি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!" স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুংলি।
মুংলির বাবা মা, গ্রামের আরও অনেকে সেই ইস্কুলবাড়িতে থাকলেও মুনিয়ার বাবা মায়ের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। মুনিয়া কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সকলে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, অন্য কোথাও হয়তো তারা ভেসে চলে গিয়েছে, পরে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ভয় আশঙ্কায় মুনিয়া কেবলই কেঁদে চলে। মুনিয়াকে নিয়ে আর মাথা ঘামানোর মত অবকাশ কারোর ছিল না, সকলেরই তো একই অবস্থা, অনেকেই তাদের প্রিয়জনকে খুঁজে পাচ্ছে না। যারা পরিবারের সকলকে খুঁজে পেয়েছে, তাদের চিন্তা পরের ধাপ নিয়ে- নিজেরা কি খাবে, সাথে থাকা ছোট্ট দুধের সন্তানকে কি খাওয়াবে, সব হারিয়ে এসে কিভাবে জীবন কাটবে?
মুনিয়াকে নিয়ে মুংলি বড়ই চিন্তায়! সে খালি কেঁদেই চলেছে। এ সময় এগিয়ে আসে ভুবনমাঝি। মুংলি ও আরও কয়েকজন দামাল ছেলেকে সাথে নিয়ে সে সাঁতরে যায় নিজের নৌকোর খোঁজে। নৌকোটির খোঁজ পেয়ে তারা আনন্দে মেতে ওঠে। সকলে মিলে নৌকোটিতে চড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সন্ধানে বেরোয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বহু মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়, কিছুজনকে পাওয়া গেলেও জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। পরিজনদের আবার ফিরে পেয়ে কেউ আনন্দে মেতে ওঠে, আবার কেউ পরিজনদের মৃত্যুর খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সন্ধ্যার দিকে ওরা খুঁজে পেল মুনিয়ার বাবা মাকে, মুমূর্ষু অবস্থায়। মুংলির বাবা মায়ের অক্লান্ত সেবা শুশ্রূষায় যতীন ও তার স্ত্রী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। ততদিনে বিভিন্ন সংস্থার সাহায্য এসে পৌঁছে গিয়েছে বন্যার্তদের জন্য। ধীরে ধীরে বিপদ কেটে আশার সোনালী আলো দেখা যাচ্ছে। মিঠেসারি নদী আবার ফিরেছে তার চেনা রূপে। গ্রামবাসীরা সকলে মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আবার নতুন করে সাজিয়ে নিচ্ছে সংসার। এই ভয়াবহ বিপদ মানুষের মনকেও নতুন ভাবনায় ভাবতে শিখিয়েছে।
বেশ কয়েক মাস পর ...
যতীন নিজে গিয়ে মুংলিকে ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।
" মুংলি যত ইচ্ছে পড়তে চায়, পড়ুক। রামু, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ওকে মানুষ করার দায়িত্ব এখন থেকে আমার।" দরাজ গলায় বলেছে যতীন।
রামরতনের বাড়ি সারাবার জন্যও সব খরচ দিয়েছে যতীন। আর মুনিয়া এখন নির্দ্বিধায় খেলে মুংলির সাথে। যতীনের প্রশ্রয়ের দৃষ্টি ঝরে ওদের উপর।