অব্যক্ত : মধুমিতা পাল



 

জানো বাবা, মায়ের পেটের ভেতরটা না খুব ঠাণ্ডা,খুব তুলতুলে আর খুব আরামের। ওই নরম তুলতুলে বিছানাটাতে মায়ের জঠরের উষ্ণতায় আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকি। মা যে আমাকে কথা দিয়েছে -- আমাকে সবসময় সব বিপদের হাত থেকে বাঁচাবে।আমার কোন ক্ষতি হতেই দেবে না কোনদিন।


বাবা জানো, মা না আমার সাথে রোজ কত কথা বলে।এই তো সেদিন বলল---

----তোকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত।পৃথিবীটা খুব সুন্দর রে--কত আলো,কত রঙ,কত শব্দ, কত গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে।তুই আমার পেট থেকে বেরোলেই সেসব কিছু দেখতে পাবি,অনুভব করতে পারবি।সেই থেকেই তো ছটফট করছি--কবে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দুচোখ ভরে দেখতে পাবো।তবে জানতো বাবা, আমি সবার আগে কিন্তু তোমাকে আর মাকে দেখতে চাই।তোমরা খুব সুন্দর না গো?জানো বাবা,আমি আমার ছোট ছোট হাত-পা গুলো দিয়ে যখন মাকে মারি তখন মা খুব হাসে।মায়ের কি লাগে না বাবা?কী বলে জানো---

----খুব শয়তান হয়েছিস তুই।খুব বিচ্চু হবি।


মাকে বলিনি, তোমাকে চুপিচুপি বলছি শোন,আমি না একটুও দুষ্টুমি করবো না।শান্ত হয়ে থাকবো।তোমার সব কথা শুনবো।


আচ্ছা বাবা,তুমি আমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসতো?বলো না বাবা, ভালোবাসতো? ভাবছো কেন আমি তোমায় এই প্রশ্নটা করছি?আসলে সেদিন মা খুব কাঁদছিল।জানোই তো মা কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়।কাঁদতে কাঁদতে মা আমায় বললো----

-----জানিস তো তোকে ওরা মেরে ফেলতে চায়।তুই ছেলে না মেয়ে আমি জানিনা।আমি শুধু জানি তুই আমার সন্তান।কিন্তু ওরা--ওরা বলছে তুই নাকি মেয়ে।ওদের গুরুদেব তাই বলেছে।তাই ওরা তোকে মেরে ফেলতে চায়।তবে তোকে আমি কথা দিচ্ছে সোনা তোর কোন ক্ষতি আমি আমার জীবন থাকতে হতে দেবো না।

আচ্ছা বাবা,তুমি পারোনা আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচতে---নাকি তুমিও আমায় মেরে ফেলতে চাও?কেন বাবা---আমি মেয়ে বলে?আমি ছেলে না মেয়ে তা তোমার গুরুদেব জানলো কী করে?আর যদি মেয়েই হই তাহলেই বা তোমরা আমায় মারবে কেন?আমার কী দোষ? আমি তো শুধু দুচোখ ভরে তোমাকে-মাকে আর এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখতে চাই।একটু বড় হলে তোমার কাঁধে চড়ে ঘুরতে চাই,তোমার হাত ধরে স্কুলে যেতে চাই, অনেক গল্প শুনতে শুনতে তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমোতে চাই।তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে তো তখন।


হ‍্যাঁ গো বাবা, সেদিন তুমি মাকে মারলে কেন?তুমি জানোনা বুঝি মাকে মারলে আমারও লাগে। মা আর আমি -- দুজনেই তো খুব কাঁদছিলাম। আর ওই যে সেদিন--মাকে কেন খেতে দিলে না?তুমি তো জানো মা খেলে তবেই আমার খাওয়া হবে।সেদিন আমার খুব খিদে পাচ্ছিল।মা তোমার কাছে ঠাম্মার কিছু কত কাকুতি-মিনতি করছিল একটু খাবারের জন্য।তুমি তো না দিয়েই কোথায় যেন বেরিয়ে গেলে।ঠাম্মাও দিল না। মা ঠাম্মাকে কত করে বলল---

-----আমার জন্য নয় মা,ওই বাচ্চাটার কথা ভেবে একটু কিছু অন্তত আমায় খেতে দিন।

ঠাম্মা কী বলল জানো?বলল--

------ওটাকেই তো মারতে চাই।তুমি রাজী হয়ে গেলে তো বাছা, এত কষ্ট পেতে হত না।

সত্যি বলছি বাবা,সেদিন খিদেতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।এরকম আর কখনও করোনা বাবা।রাতে তোমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মা চুপিচুপি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে খেয়েছিল আর কাঁদতে কাঁদতে বলছিল----

----সারাদিন খুব কষ্ট পেয়েছিস সোনা।এইবার এইটুকুই খা।

এই যাহ!তোমায় তো সব বলে দিলাম।তুমি মাকে কিন্তু কিছু বলোনা বাবা প্লিজ।শুধু একবার মায়ের পেট থেকে বেরোই দেখবে তোমায় কত ভালোবাসবো।ছোটছোট হাত দিয়ে তোমায় কত্তো আদর করবো।


বাবা, তুমি মায়ের মত আমার কথাগুলো শুনতে পাচ্ছো তো?জানো তো আমার খিদে পেলে, কষ্ট পেলে মা ঠিক বুঝে যায়।মাঝেমাঝে মাকে ভয় দেখাবার জন্য আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি।তখন মা অস্থির হয়ে ওঠে। কান্না ভেজা চোখে বলে -----কীরে ঘুমিয়ে পড়লি নাকি??একটু হাত-পা ছোঁড় সোনা।

মা আসলে ভয় পায়।ভাবে আমার বুঝি কিছু হয়ে গেল।হি-হি-হি মাকে বলে দিয়ো তো যে আমি শুধু মজার জন্য করি।মা যেন ভয় না পায়।


বাবা, তুমি মাকে কী বলছো গো--খেতে? খাবার এনেছো তুমি?কী ভালো গন্ধ গো খাবার গুলোর।অনেক খাবার এনেছো না? কিন্তু তুমি কী করে জানলে যে এখন আমার খিদে পেয়েছে?ও তার মানে তুমিও আমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসো।মা যেমন বুঝতে পারে আমার খিদে পাওয়ার কথা ঠিক তেমনি তুমিও বুঝতে পারো না গো?


 কিন্তু মা খাচ্ছে না কেন গো?কেন বলছে খাবে না?তোমার কথা তো শুনছেই না। দাঁড়াও আমি একবার বলে দেখি।আমি বললে মা নিশ্চয় খাবে।ও তুমিই খাইয়ে দেবে বলছো।তাই দাও তো বাপু।আর অপেক্ষা করতে পারছি না।গন্ধে খিদেটা আরও বেড়ে গেল।তাছাড়া তোমার হাতে বহুদিন খাইওনি।সেই যে প্রথম কয়েকদিন খাইয়েছিলে।তারপর তো আর কোনদিন খবরও নাওনি খেয়েছি কিনা।আজ বরং এই ভালো গন্ধওয়ালা খাবার গুলো তুমি নিজেই খাইয়ে দাও।আঃ!কী সুন্দর খেতে।কে রান্না করেছে গো-ঠাম্মা? মাকে আজ রান্নাঘর থেকে ছুটি দিয়েছিলে না তাই মা একবারও রান্নাঘরে যায়নি। ঠাম্মা কে বোলো খুব ভালো খেতে হয়েছে।আর একটু খাইয়ে দাও বাবা -- আর একটু।


বাবা তুমি কী খাওয়ালে গো?আমার গোটা শরীরটা জ্বালা জ্বালা করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।মাও তো ছটফট করছে? আমার দমটা বন্ধ হয়ে আসছে।বাবা তুমি হাসছো?আমাক তাহলে সত্যিই মেরে ফেলবে? আর পৃথিবীর আলো দেখতে দেবে না? বাঁচাও না বাবা আমাকে।আমার সারা শরীরটা কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে বাবা।আমি বাঁচতে চাই বাবা।আমাকে বাঁচতে দাও----বাঁচতে দাও--বাবা-বাবা-বাবা----।

Post a Comment

Previous Post Next Post