বেঁচে থাকার লড়াই : সহেলী মল্লিক


 


গরিব আধপেটা খেয়ে যে মানুষগুলো দিনযাপন করতে থাকে তাদের মতো লড়াকু আর তাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকার তীব্র জেদ দেখা যায়, তা শহরের ঝাঁ চকচক মজাক করা AC রুমে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে ওতটাও লক্ষ্য করা যায় না। আজ তোমাদের নিয়ে যাবো এমন এক গ্রামে যেখানে বেঁচে থাকার জন্য জীবন ধারনের জন্য লড়াই করতে হয় সর্বক্ষণ। হুগলি জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের নাম কুবিরগেড়ে, সেই গ্রামে বসবাস করত একদল আদিবাসী সম্প্রদায়। ১৯৫০ সালে ২৬ শে জানুয়ারি আমাদের দেশের সংবিধান কার্যকর হয় যেখানে বলা হয় জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সমান অধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু না সংবিধান কার্যকর হবার ৫০ বছরের মধ্যেও এই জাতি ধর্মের ব্যবধান মেটেনি আর কোনদিন মিটবে কিনা তাও জানা নেই। আজও সেই আদিবাসীদের ভদ্রসমাজ কোন কাজ দেয়না, কাজ তো দূরের কথা তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে তার বাইরে তারা বেড়াতে পারে না। তাদের না আছে জমি আর না আছে কোনো কাজ। তাদের একএকটা দিন কাটে আধপেটা খেয়ে বা হয়ত না খেয়ে। সরকার ভোটের সময় নানা প্রতিশ্রুতি দেয় তারপর ভোট শেষ আর তাদের দেখাও যায় না। সমাজ পাল্টেছে কিন্তু না তাদের জীবনধারার কোনও পরিবর্তন হয়নি। না গ্রামে পৌঁছেছে আলো, না পৌঁছেছে পানীয় জলের ব্যবস্তা একটা একটা করে ইলেকশন আসছে যাচ্ছে কোনও কাজ হয়নি। যদি তাদের মধ্যে কোনও জিনিস পৌঁছৈ থাকে তা হল দ্রারিদ্রতা, হাহাকার আর কান্না। গ্রামের সবথেকে বয়স্ক সদস্য তিরুলাল তাকে সবাই মান্য করে, বিশ্বাস করে। তিনি একদিন সব গ্রামবাসীদের একত্র করে বলল- 'এইভাবে আমাদের দিন আর না চলবে, আমাদের সবাইকে একসাথে লড়াই করতে হবে আমাদের হকের লড়াই।' 'ভৃমিহীন দের জন্য এত সুযোগ সুবিধা আমরা তার বিন্দুমাত্র কিছুই পাইলা বটে, আমাদের যা প্রাপ্য তা আমাদের দিতেই হবে।' এরপর তারা পঞ্চায়েত, ব্লগ সব জায়গাতেই ঘুরতে থাকে গ্রামে যাতে আলো আসে, জল আসে। কিন্তু না কোনও লাভ হয়নি। একদিন তিরুলাল কে খুব চিন্তিত দেখে মনিশ তার কারণ জানতে চাওয়ার তিরুলাল তাকে সব খুলে বলল। মনিশ হলেন পাশের গ্রামের শিক্ষক তিরুলাল এর নাতনি মুংরি তার কাছে পড়ে। 


     তিরুলাল গ্রামবাসীদের বলেছিল ছেলেমেয়ে গুলোকে লেখাপড়া করায় কেনে। গ্রামবাসীদের মধ্যে একজন বলেছিল– ' পেটে লা খেয়ে কি আর লেখাপড়া হয়? তার থাইকা কাম খুঁজক, অত্যন্ত দুবেলা পেট পুরে খেতে তো পারবে। তিরুলাল আর কোন কথা বলেনি কিন্তু সে তার নাতনি কে পড়তে পাঠিয়েছিল। 


মনিশ বাবু তিরুলাল এর মুখে পুরো বিষয় টি শুনে বলেছিল–'এইভাবে হবে না, তোমাদের অধিকারের জন্য তোমাদের কঠিন থেকে কঠিনতর লড়াই করতে হবে। দরকার পড়লে রাস্তায় নামতে হবে।'


 সব শুনে তিরুলাল গ্রামের সবাই কে ডেকে বলে– 'এইভাবে হবে না আমাদের পথে নামতে হবে দাঙ্গাতে নামতে হবে, যে করেই হোক জল আলো আমাদের একটা কামের ব্যবস্থা করতে হবে।'


শুরু হলো পথ অবরোধ হরতাল লাঠি চলল পুলিশের তাও তারা নড়ল না। আহত হলো কত মানুষ তবুও থামল না তারা, শেষে বাধ্য হলো প্রশাসন তাদের দাবি মানতে। দেখতে দেখতে গ্রামে আলো এল, সজলধারা এল জল আর আলোর সমস্যা মিটল। গ্রামের পাশে যে দারকেশ্বর নদী বয়ে চলেছে তার কাছে তৈরি হলো ইঁটভাটা গ্রামের মানুষজন কাজ পেলো তাদের আর না খেয়ে থাকতে হতো না। পেটে খিদে থাকলে শিক্ষার কথা মাথাতেও আসে না এখন আর নাই খিদের চাহিদা তাই তারা শিক্ষার চাহিদাও অনুভব করল। 


মনিশ তিরুলাল এর কথায় এর উদ্যগ নিলো গ্রামে স্কুল খোলার। তারপর গ্রামে নতুন স্কুল হলো মুংরি ভারী খুশি সে এখন স্কুলে পড়বে তার নিজের স্কুল, তার গ্রামের স্কুল। সে যাদের সাথে খেলা করত তারাও এখন তার সাথে পড়বে। মুংরি জানে তাকে অনেক অনেক পড়তে হবে যাতে সে এই গ্রামের আরও উন্নতি করতে পারে। একদিন মুংরি তার শিক্ষক কে জিজ্ঞেস করল- 'আচ্ছা মাস্টারমশাই আমি কি কাজ করলে এই গ্রামের আরও ভালো হবে?আর কোনো দুঃখ থাকবে না!' তোকে আগে ভালো মানুষ হতে হবে রে মানুষের মতো মানুষ। তুই যদি বি.ডি.ও হতে পারিস তবে তুই গ্রামের উন্নতি করতে পারবি। তবে মাথায় রাখবি শুধু তোর গ্রামের নয় সব গ্রামের উন্নতি করতে হবে। এবার শুরু হলো মুংরি র জীবনে এক নতুন লড়াই ভালো থাকার লড়াই মানুষজন কে ভালো রাখার লড়াই। মুংরির কাছে—-

     লড়াই মানে নয় কেবল ঝগড়া মারামারি

     লড়াই মানে একান্ত ব্যক্তিগত 

     শত বাধাতেও মানবোনা হার

     এমনই বদ্ধপরিকর 

     তাই নিজের সাথেই 

     কখনও ভাব কখনও আড়ি।।

Post a Comment

Previous Post Next Post