জীবনের খেলা : সায়ন্তনী দাস ধর


 আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল নিপা। নাইটি পরতে পরতে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, "তোমার দ্বারা হবে না। তুমি পুরুষ মানুষ?"

আমি শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম, " একটু সময় তো দাও আমায়....আমি...."

আমায় এক দাবড়ানিতে থামিয়ে দিল নিপা, " থাম তো, খালি ...." ও চলে গেল। আমি নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রইলাম। ওর চাহিদার সঙ্গে আজকাল তাল মেলাতে পারছি না আমি। আমার নিজের পুরুষত্বের উপরেই সন্দেহ জাগতে শুরু করেছে! নিজেকে এতটা অসহায়, অপমানিত আগে কখনও লাগেনি! অথচ এমনটি তো ছিল না আগে। বিয়ের পরপর দুজনেই নিজেদের নিয়ে খুশি ছিলাম। গোল বাধল তখন যেদিন প্রথম জানতে পারলাম আমাদের সন্তান না হওয়ার কারণ আমারই অক্ষমতা। নিজের প্রতি লজ্জায় ঘেন্নায় রাগে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম আমি। নিপার কাছেই আশ্রয় খুঁজতে চাইছিলাম আমি। কিন্তু সেদিন নিপা রাগে ফেটে পড়েছিল আমার উপর, " এতদিন সকলের কাছে অভিযোগ শুনেছি, যেন আমারই অপরাধ! দেখলে তো, আমাদের ঘরে সন্তান না আসার কারণ কে? যাও, যাও, এবার সকলকে বল....কে দায়ী!" 

আমার পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছিল। বিড়বিড় করছিলাম, " কিন্তু সেদিনগুলোতে তো আমি তোমার পাশেই ছিলাম, নিপা। আমি তো কোনদিন তোমায় দোষারোপ করিনি। তুমি কি আমায় ঘেন্না কর?" 

শান্ত স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল নিপা," হ্যাঁ, আমার জীবন নষ্ট করার কোন অধিকার তোমার নেই। তোমার জন্য আমি 'মা' হওয়ার স্বর্গীয় সুখ থেকে বঞ্চিত হলাম।"

আমি হতবাক হয়ে চেয়েছিলাম নিপার দিকে! এ কোন নিপা? যে কোন পরিস্থিতিতে আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকবে, আমায় কখনও একা ছেড়ে দেবে না....এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল না, কবে যেন? নাকি এসব আমার ভ্রান্ত ধারণা? উঃ! মাথা কাজ করছিল না আমার। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছিল। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে পড়েছিলাম আমি। আর নিপা একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। 

          সেই শুরু। তারপর থেকে কথায় কথায় নিপা আমাকে অপমান করে, আমার সবকিছুতে ত্রুটি খুঁজে বের করে। আমার কোন কাজই আর পছন্দ হয় না। এককথায় আমায় সহ্যই করতে পারে না। আর সহ্য করতে পারছি না আমি। আমার আত্মবিশ্বাস দিন দিন কমে যাচ্ছে। কোন কাজ করতে গেলেই দ্বিধা হয়। এর প্রভাব পড়ছে অফিসেও। যে 'আমি' অফিসের দক্ষ কর্মী ছিলাম, সেই 'আমি' টা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আজকাল প্রায়ই কাজে ভুল হয়। বসের কাছে ধমক খাই," কি ব্যাপার স্যান্যাল? শরীর-টরীর খারাপ নাকি? কাজে এত ভুল?" প্রথম প্রথম এমন মিষ্টি করে বললেও দিনের পর দিন আমার ভুলে ভরা কাজ দেখে বসের মেজাজও সপ্তমে উঠল,"স্যান্যাল, কাজের সময় মন কোথায় থাকে আপনার ? এভাবে কাজ করলে আমাকে কিন্তু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। দেখুন, কি করবেন?"

এতদিন আমার উন্নতিতে যাদের গাত্রদাহ হত, আজ তারা আমার এই অবনতিতে হাতে চাঁদ পেল। এমনই একজন বোসদা। বসের ধমকানি খেয়ে বেরোচ্ছি, উনি বলে উঠলেন, " কি স্যান্যাল, বাড়িতে বউ অনেক কাজ করাচ্ছে বুঝি? তাই অফিসের কাজে এত ভুল?" বেশ বুঝতে পারছিলাম সবাই মুখ টিপে হাসছে। যত দিন যাচ্ছে, নিজের আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকেছে। বাড়িতে নিপার দুবেলা মুখঝামটা, অফিসে বসের হুমকি, সহকর্মীদের টিটকিরি আমায় পাগল করে দিচ্ছিল। 

           এরপর এল সেই দিন। সেদিন অফিসে একটা প্রেজেন্টেশন ছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির করে তৈরি করেছিলাম। ঘুম ভাঙল নিপার চেঁচামেচিতে, " বলি, আর কত ঘুমোবে? কাল এতবার বলে দিলাম, ঘরে বাজার নেই।খালি হাত দোলাতে দোলাতে চলে এলে? রান্না করব কি? তোমার পিণ্ডি?"

আজ প্রেজেন্টেশন ভাল দিতেই হবে, নইলে....ভয়ে ভয়ে বললাম, " আজ সেদ্ধ ভাত করে চালিয়ে দাও, প্রেজেন্টেশন আছে। একটু ঝালিয়ে না নিলে....ফেরার সময় নিয়ে আসব, কেমন?"

ভয়ঙ্করভাবে চেঁচিয়ে উঠল নিপা, " কি? সন্তান দেবার মুরোদ নেই, এখন না খাইয়ে রাখবে? এমন সংসারের মুখে আগুন ...." আরও কত কি বলে যেতে লাগল ও। আমার মাথার ভিতরে কেমন যেন হতে লাগল। তাড়াতাড়ি গিয়ে বাজার করে আনলাম। ভাতের থালাটা ঠক করে নামিয়ে রাখল নিপা আমার সামনে, " গিলে উদ্ধার কর আমায়।" 

কেন কে জানে, আজ গলা দিয়ে ভাত নামতে চাইছিল না। রোজ তো গালাগালি খেতে খেতেই ভাত খাই। আজ খুব ভয় লাগছিল, প্রেজেন্টেশন ঠিকমত দিতে পারব তো? একটুও ঝালাই করার সময় পেলাম না। ভাত নেড়েচেড়ে উঠে পড়লাম, খেতে পারলাম না। নিপা চিৎকার করেই যাচ্ছিল, "খাবে না যে, আগেই বলতে পারতে। কষ্ট করে তাড়াহুড়ো করে রান্না করতাম না। এমন বেয়াক্কেলে লোক আমারই কপালে জোটে...." 

কোনরকমে তৈরি হয়ে অফিসে পৌঁছলাম। পৌঁছে খেয়াল হল ফাইলটাই আনিনি। মাথা কাজ করছিল না। অবধারিতভাবে জঘন্য প্রেজেন্টেশন দিলাম। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। বিকেলের দিকে ডাক পড়ল বসের ঘরে, " স্যান্যাল, আপনার পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। আপনাকে আর কাজে রাখা সম্ভব নয়।" আমার মুখ থেকে একটিও কথা বেরোল না। মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। চোখ না তুলেই বুঝতে পারছিলাম, সকলে হাসছে আমার দিকে আঙুল তুলে। এত দিনের সঙ্গী টেবিল চেয়ারে হাত বোলালাম। ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম অফিস থেকে। আজ থেকে বেকার আমি। বাড়ি গিয়ে কি বলব নিপাকে! উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম একটি পার্কের পাশ দিয়ে। পার্কের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, বাচ্চারা খেলছে, তাদের মায়েরা গল্প করছে, কত সুখী ওরা! আরে ও কে? নিপা না? পাশে ছেলেটি কে? বন্ধু নিশ্চয়ই। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে অত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কেউ? কি এক আকর্ষণে আমার পা ওখানেই আটকে গেল। কিছু পরে ওরা হাঁটতে শুরু করল। আমিও ওদের অনুসরণ করলাম। সস্তা একটি হোটেলে ঢুকল ওরা। আমার বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছিল কেউ! আমি জানি, এই ধরণের হোটেলগুলিতে কি কি হয়! ঘন্টাদুয়েক পর নিপাকে ছেলেটির হাত ধরে পরিতৃপ্ত মুখে বেরোতে দেখলাম। এমন পরিতৃপ্তি কখনও দেখিনি ওর মুখে। নিজের প্রতি করুণা হচ্ছিল  আমার।

         নাঃ! অনেক হয়েছে। আর নয়, নিপার মনে  আমার জন্য কোন ভালবাসা অবশিষ্ট নেই। একসাথে থাকা টাকার জন্য। আজ তো রোজগারও নেই আমার। শুধুশুধু আর বাড়ি ফিরে কি হবে? হারিয়ে যাব বরাবরের মত নিপার জীবন থেকে। হুঁশ ছিল না আমার! হাঁটতে হাঁটতে কখন রেলগেটের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছি, নিজেই জানি না! গেট বন্ধ। কোন ট্রেন আসবে হয়তো। আজ যদি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই, কারোর কিচ্ছু আসবে যাবে না। দূর থেকে দেখছি ট্রেন আসছে প্রবল গতিতে। এক পা এক পা করে গেটটা পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম লাইনের কাছে। 

            কে যেন এক হ্যাঁচকায় আমায় সরিয়ে আনল লাইন থেকে। " কি রে! পাগল হয়ে গেলি নাকি? কি করতে চাইছিলি তুই?" চিৎকার করে বলে উঠল অপর্ণা। আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। নিশ্চিত মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আমার শরীর মন সব অসাড় হয়ে গিয়েছে। অপর্ণা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। পৌঁছলাম অপর্ণার বাড়িতে। আমি কেবল জিজ্ঞেস করলাম, "আমায় কেন বাঁচালি?"

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে," সে বুঝলে তো আমার আর কোন ঝামেলাই থাকত না। চুপ করে এখানে বোস। তোর জন্য গরম দুধ আনছি।" 

একা একা বসে মনে পড়ছিল এই কালো কুচ্ছিত  মেয়েটার কথা। ছোট থেকেই পাশাপাশি বাড়িতে বসবাস আমাদের। একসাথে খেলতে খেলতে বড় হয়েছি। একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকে ওর সঙ্গ আর তেমন ভাল লাগত না আমার। কুরূপা মেয়েকে কারই বা ভাললাগে! অপর্ণা কিন্তু বরাবর পড়াশোনায় খুব ভাল। আমাকে অনেক সাহায্যও করত। কলেজে পড়াকালীন সুন্দরী নীপার প্রেমে পড়লাম। কলেজ ফাঁকি দিয়ে দুজনে দেদার ঘুরে বেড়াতাম আর সব নোটস তৈরি করে দিত অপর্ণা। ওর জন্যই এত ফাঁকি দিয়েও কলেজ পাশ করতে একটুও অসুবিধা হয়নি আমার। তারপর তো চাকরি, নিপাকে বিয়ে করলাম। কিন্তু অপর্ণা যে কেন বিয়ে করল না, বুঝতেই পারলাম না। অবশ্য ওকে নিয়ে অত মাথা ঘামানোর সময়ও তখন ছিল না আমার। 

        " নে, দুধ খেয়ে নে।" অপর্ণার কথা আজ আর অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। বিনা বাক্য ব্যয়ে খেয়ে নিলাম। খুব ঘুম পাচ্ছে। অপর্ণা ওর বিছানায় শুইয়ে দিল আমায়। মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগল। বহু বছর আগে মাকে হারিয়েছি, আজ মায়ের কথা মনে পড়ছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, জানি না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে শরীর ঝরঝরে লাগছে। একটু পর ঘরে ঢুকল সদ্যস্নাতা অপর্ণা, পিঠময় ছড়ানো এক ঢাল ভিজে চুল। ওর মুখে স্নিগ্ধ প্রসন্নতা, চোখে ভরসার প্রশ্রয়, হাতে চায়ের কাপ, "সুপ্রভাত! ঘুম ভাঙল?" 

সেকি! সারা রাত এক ঘুমে কেটে গেল! কতকাল এমন নিশ্চিন্তে ঘুমোইনি! এত সুন্দরও তো লাগেনি সকালগুলো! কিন্তু ....এ তো অস্থায়ী! বললাম, "তোকে খুব অসুবিধের মধ্যে ফেলে দিয়েছি, তাই না? আমি চলে যাচ্ছি।"

" এক পা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখ, কি করি আমি! অনেক জ্বালিয়েছিস আমায়! বাকি পথটা তোর সঙ্গে চলতে দিবি?" 

অপর্ণার কথা শুনে হাউহাউ করে কাঁদছি আমি, "আমার কাছে তোকে দেবার মত কিচ্ছু নেই রে! নিঃস্ব আমি!"

অপর্ণা আমায় জড়িয়ে ধরে, আমার বুকে মাথা রাখে। নিঃশব্দে কাঁদছে ও। আমি অনুভব করলাম, আমার জীবনের সার্থকতা ওর কাছেই।

Post a Comment

Previous Post Next Post