সং-সার : সায়ন্তনী দাস ধর



       

       "এই শুনছ, শোন না...."

ওরে বাবা! সক্কাল সক্কাল বউয়ের এমন মিষ্টি মধুর গলা শুনলে আজকাল কেমন যেন ভয় পেয়ে যাই।

"এই তোমার মনে আছে তো? আজ কিন্তু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে।"

আকাশ পাতাল ভেবেও কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, আজ কি? 

"কি গো, উপহারটা কিনেছ তো? আমাকে তো দেখালে না?"

এই মেরেছে! নাঃ! এ যাত্রা আর রক্ষে পেলুম না গো! তবে এ বান্দা এত সহজে হার মানবে! কাভি নেহি! আন্দাজে ছুঁড়ে দিলাম এক ঢেলা,"আরে! ফেরার সময় কিনে নেব। তুমি চিন্তা কোরো না, ডার্লিং!"

" তা, আজ কি বলতো, শুনি?"

সর্বনাশ! বিয়ে, জন্মদিন নাকি অন্যকিছু? আমার বুক, মুখ সবই শুকোতে শুরু করেছে। ছোটবেলায় ইস্কুলে যখন স্যার পড়া ধরতেন, অবিকল এমনই অনুভূতি হত! বউয়ের মুখের নরম ভাব ধীরে ধীরে উধাও হতে শুরু করেছে। মাইরি! বউ এত বোঝে কি করে!

" কি হল? কোন উত্তর নেই? আবার ভুলে গিয়েছ? ভগবান! এমন পোড়া কপাল আমার! আজ দাদার ছেলের অন্নপ্রাশন। তোমাকে সোনার হার কিনে আনতে বলেছিলাম। ভুলেই গেলে? কেন, আমার দাদা বলে? আর ও মাসে যে তোমার মামার মেয়ের বিয়েতে অত মোটা সোনার হার দিলে? তখন তো মনে ছিল? ও......আচ্ছা, মা বলেছিল যে, সোনার হার দিতে হবে। তাই মনে রেখেছিলে। আমার কথার কি গুরুত্ব তোমার কাছে? মা ই তো তোমার সব....আমাকে বিয়ে করার কি দরকার ছিল? মায়ে পোয়ে মিলে তো জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতে! শুধু শুধু বাইরের একটা মেয়েকে নিয়ে এসে অত্যাচার করছ......."

উফ্! ব্যস্, শুরু হয়ে গেল। এখনও ষোলো কলা পূর্ণ হবার আরও কিছু বাকি ছিল। আসরে প্রবেশ করলেন আমার মাতৃদেবী, " কি ব্যাপার কি? বলি, এটা কি ভদ্রলোকের বাড়ি, নাকি বস্তিবাড়ি? অসভ্যের মত চেঁচামেচি! কাক চিল বসতে পারছে না গো!"

বউ: কি? আমার চেঁচামেচিটাই তোমার কানে ঢুকল? কেন চেঁচাচ্ছি, সেটা জানবে না?

মা: সবই শুনেছি বাছা! বাবু কত কাজে ব্যস্ত থাকে। ভুলে তো যেতেই পারে।

ইস্, আড়ি পাতছিল নাকি মা? আর এখন আমার হয়ে কথা বলার অর্থ হল, বারুদের স্তূপে ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে টুক করে ছুঁড়ে দেওয়া। 

আমি: আঃ, মা! তুমি থাম না।

মা: সেই, বিয়ে করেছিস, লায়েক হয়ে গিয়েছিস! বউকে শাসন না করে আমায় বলছিস? ছি ছি!

আমি: কি মুশকিল! কি এমন বললাম তোমায়?

মা: ছেলের বিয়ে দিয়ে এই দিনটাই দেখা বাকি ছিল আমার! এমন বউ ঘরে এসেছে! আমার সঙ্গে নিজের তুলনা করছে? বউমা, বাবুর জীবনে কার বেশি গুরুত্ব, সেই তুলনা করছ? 

দুপদাপ পা ফেলে মা তো চলে গেল ঘরে, সঙ্গে আমার ও সব শেষ.....ভয়ঙ্কর হাড়হিম করা এক দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বউও চলে গেল। একটু পরেই রান্নাঘর থেকে শোনা যেতে লাগল বাসনের ঝনঝনানি। বউয়ের সব রাগ ঐ নিরীহ বাসনগুলো সইছে! শুধু কি ওরা? আমিও আর বেশিক্ষণ ঘরে থাকার ঝুঁকি নিতে পারলাম না। আজ আর অফিসে যাওয়া হল না। সকালের চা টুকুই জুটেছে। আর কিছু আশা না করাই ভাল। তাড়াতাড়ি এ.টি.এম কার্ডটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টাকা তুলে বেশ দামী একটা সোনার হার কিনলাম। বুকের মধ্যে একটু টনটন করে উঠল বটে! গত মাসের মত এ মাসেও এত খরচা ....তবুও ....গৃহশান্তির সঙ্গে অন্য কিসের তুলনা? মনে মনে নিজের মাথায় নিজেই একটু হাত বুলিয়ে আদর করে দিলাম। স্বামী এবং ছেলে- কি কঠিন এই দুই চরিত্রে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা!!! 

        বাড়িতে ফিরে দেখি, পরিবেশ দারুণ থমথমে। 

আমি: শুনছ? শুনছ?

বউ: কি হলটা কি? আর এতক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে না? 

আমি: একটিবার ঘরে আসবে?

বউ: এমনিতেই তো দেরি হয়ে গেছে, রান্না শেষ করতে হবে তো? 

যাক, বউ যে রান্না করছে, খাবার জুটবে.....ঘরেও এল দেখছি।

বউ: কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। একদম সময় নেই আমার। 

আমি: একটু কাছে এস না।

বউ: কেন? আমি তো খারাপ বউ।

বউয়ের দুচোখে জল টলটল করে উঠল। সঙ্গে আমার বুকটাও টনটন করে উঠল। জোর করে কাছে টানলাম আমার একটু রাগী, জেদী আর অনেকটা ছিঁচকাঁদুনে বউটাকে। লাল ভেলভেটের বাক্সটা রাখলাম ওর সামনে। ও অবাক হয়ে চেয়ে রইল। হারটা দেখে ওর মুখে হাজার বাতির আলো জ্বলে উঠল। 

বউ: এত দামি কিনতে বলেছিলাম বুঝি? আমি তো ....এত খরচা করতে কে বলল? আশ্চর্য মানুষ তো! তোমার কি আক্কেল হবে না?

হে ভগবান! এখনও রেগে গেল বউ? ভালমানুষের মত মুখ করে বললাম, "তাহলে কি ফেরত দিয়ে আসব?"

এক জ্বলন্ত দৃষ্টিপাত করে বাক্সটা নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখল বউ। "আজ কিন্তু অফিস যাচ্ছি না। আমার উপহারটা দুপুরে তোমার কাছ থেকে চাই।" আমার কথা শুনে অপূর্ব ভ্রুভঙ্গি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও। অনেকদিন পর হঠাৎ পাওয়া ছুটির দিনটা দারুণ আনন্দে কাটালাম।  বিকেলে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। শুনতে পেলাম, বউমা, শাশুড়ির কথোপকথন....

বউমা: মা, কোন শাড়িটা পরবে?

শাশুড়ি: ওসব কি আমি দেখি? তুমিই তো শাড়ি, গয়না সব পছন্দ করে দাও। এবারও তাই দেবে। 

বউমা: এই নাও। এটা পরবে।

শাশুড়ি: এই বয়সে এটা মানাবে না আমায়। না না, এটা না....

বউমা: কে বলেছে তোমায় মানাবে না! খুব ভাল লাগবে। আর বয়স হয়ে গেছে মানেটা কি? এসব উল্টোপাল্টা কথা বলবে না তো?

শাশুড়ি: বাবু একটু দামী হার কিনেছে তো? আজকালকার দিনে কি যে সব হালকা পলকা সোনার গয়না বেরিয়েছে ....

বউমা: না গো মা, খুব দামী দেখে কিনেছে।

শাশুড়ি: যাক, কুটুমবাড়িতে একটা মানসম্মান আছে তো নাকি? 

              আমার চোখদুটো কেমন যেন জ্বালা করছে। বুকের মধ্যে প্রশান্তির অসাধারণ আবেশ! আজ বাড়িতে না থাকলে এ তো জানতেই পারতাম না! সন্ধ্যেবেলায় তিনজন সেজেগুজে চললাম নেমন্তন্নবাড়ি।

Post a Comment

Previous Post Next Post