পায়েলের বিয়ে হয়ে গেল। ছেলে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি ভালো উপার্জন। বাবা দেখে শুনে এমন ছেলে যোগার করেছেন। পায়েল খুশীতে ডগমগ।শ্বশুর বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী নতুন বৌ বরণ হবে সূর্য ডোবার পর। বাবার ইচ্ছে ছিল বিকেল পরতেই কন্যা বিদায় করবেন। বাসর জাগার ফলে বিবাহ উৎসবের পরের দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমের আবেশ লেগেছিল যুবক যুবতীর চোখে, ফলে পায়েলের সাজতে আর কন্যা বিদায়ের কালে কান্নাকাটির পর্ব চুকতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল।
বরের ভাই এসেছে নবদম্পতিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। পেছনের সিটে যতটা সম্ভব বরের গা ঘেঁষে বসেছে পায়েল। দুজনেরই ইচ্ছা পাশাপাশি বসে একটু খুনসুটি করবে। ড্রাইভারের পাশে বসেছে বরের ভাই প্রশান্ত। মাঝপথে গিয়ে গাড়ি আর চলে না,কি হলো! অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি আর চললো না। দেরি হয়ে গেছে বলে এতোক্ষণ গাড়ি বেশ হাই স্পিডে চালানো হচ্ছিল হঠাৎ থেমে যেতে ড্রাইভার বিব্রত। নতুন গাড়িতে এই উটকো ঝামেলা। শীতের সন্ধ্যে পথে লোকজন নেই কয়েকটা গাড়ি আর বাইক পাশ দিয়ে হু হু করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ভাই আর ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে কিছু পরামর্শ করছে। পায়েল বরের আরও গা ঘেঁষে বসতে গিয়ে পায়ের নূপুরটা অস্বাভাবিক জোরে ঝুমঝুম করে বেজে উঠলো। আর পায়েলের মনে হল তার পাশে সিটের ফাঁকা অংশে শীতল শরীরের কেউ এসে বসলো। গাড়ি থেমে যাওয়ার কারণে উদ্বিগ্ন
সুছন্দ আর পায়েল হঠাৎ করে বেজে ওঠা নূপুরের তীব্র ধ্বনিতে চমকে উঠলো। সুছন্দ একটু বিরক্ত হলো-" অপ্রস্তুত পায়েল তার দুপায়ের মালাইচাকি শক্ত করে ধরলো যাতে পা একটুও না নড়াচড়া করে। তাতেও নূপুরের শব্দ থামলো না বরং শীতল স্পর্শের তীব্রতা আরও তীব্রতর হওয়াতে আতঙ্কে পায়েলের সম্পূর্ন শরীর থর থর করে কেঁপে উঠলো।সেই কাঁপুনিতে একনাগারে তার পায়ের নূপুরের ঝঙ্কার বেড়েই চললো। পায়েল অনুভব করলো সেই শীতল স্পর্শ এবার পা ছেড়ে তার হাতদুটোতে জাঁকিয়ে বসেছে। থাইয়ের ওপর রাখা হাত দুটোতে পাঁচটা,পাঁচটা দশটা আঙ্গুলের স্পর্শ! যেন বড্ড চেনাচেনা! সুছন্দর শরীরে বিয়ের জোড় জড়ানো তার ওপর ঠাণ্ডার কারণে নতুন শাল জড়িয়েছে। জোড়ের সাথে পায়েলের বেনারসির আঁচল বাঁধা সুতরাং বিরক্ত হলেও সুছন্দ গাড়ি থেকে নামতেও পারছে না।প্রশান্ত বললো,-"দাদা,গাড়ি সাড়তে সময় লাগবে,দেখি কোনো ক্যাবে তোদের দুজনকে তুলে দিতে পারি কিনা..।" ফোন ঘেঁটে গুগল ম্যাপে তাদের বর্তমানের অবস্থান দেখে প্রশান্তর মুখে হাসি ফুটলো,-"আরে! আমরা তো শুভেন্দুদের বাড়ির কাছেই আছি! এক কাজ করি ওর বাড়িতে তোদের দুটিকে কিছুক্ষণের জন্য বসিয়ে আমি আর ড্রাইভার গাড়ি সাড়ানোর ব্যবস্থা করি। গাড়ি মেরামত করে তোদের তুলে নেবো নাহয়। আসলে বৌদির গা ভর্তি গয়না আর তোদের এই বেশে অন্য গাড়িতে একলা তুলে দিতেও ভরসাও পাচ্ছিলাম না। দাঁড়া,আমি শুভেন্দুকে কল করছি।" শুভেন্দু সব শুনে বললো ডানদিকে তাকিয়ে দেখ্,একটা মেরুন বর্ডারের গাঢ় হলুদ রঙের বাড়ি নাম 'সমর্পণ, ওখানে গিয়ে বেলটা টেপ্, ভাই একা আছে দরজা খুলে দেবে। আসলে আমরাও একটা বিয়ে বাড়িতে এসেছিলাম ,এখন ফিরছি ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে যাবো। তোর দাদা-বৌদিকে ওখানে রেখে গাড়িটা আগে মেরামত কর। এখুনি আমার পরিচিত মেকানিককে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।"
কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে গেল কিন্তু যে দরজা খুললো তাকে দেখা গেলনা। যাই হোক দরজা খুলতেই প্রশান্ত দাদা-বৌদিকে সামনের ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে বললো,-"শুভেন্দুর মেকানিক আসছে, আমি তাহলে এলাম,দেখি,গাড়িটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করার চেষ্টা করি। তুই বরং বাড়িতে একটা খবর দিয়ে দে।"বেড়নোর সময় সে উচ্চস্বরে বললো,-"এ ভাই, আড়ালে কেন?লজ্জার কি আছে?"
দরজাটা টেনে দিতেই লকড্ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে পায়েলের আর্তনাদ শুনতে পেলো সছন্দ। পায়েল ওর পাশে সিঁটকে বসে আছে চোখে মুখে আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ! মনে হচ্ছে কারও বাহু কিংবা দড়ির বন্ধনে আটকে পরেছে। বিরক্তির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে সছন্দ বললো,-" আর কতো ন্যাকামো জানো তুমি....এমন একটা সিরিয়াস সময় অতো ন্যাকামী কি করে আসে! রাবিস্।" নিজের গায়ের চাদর সরিয়ে জোড়টা খুলে ওর কোলে ছুঁড়ে রেখে সে টয়লেটের সন্ধানে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।হঠাৎ নূপুরের শব্দে পায়েল চমকে উঠে পায়ের দিকে চেয়ে দেখলো ওর পায়ের নূপুরে যেন ঢেউ উঠেছে! কে যেন এক হাত দিয়ে তার ডান পায়ের নূপুরটাকে একবার আর পর মূহুর্তে বাঁপায়ের নূপুরটাকে নাড়াচাড়া করছে আর তাতেই ঝুমুর ঝুমুর শব্দ হচ্ছে, আর একটা হাতে তাকে বাহুপাশে বেঁধে রেখেছে। পায়েল শুধু হাত দুটো দেখতে পাচ্ছে....বড্ড চেনা হাত... কিন্তু কার হাত মনে করতে পারছে না। তার বোবা কন্ঠ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না, ঠোট দুটো শুধু নানা ভঙ্গিমায় নড়াচড়া করছে। টয়লেট থেকে বেড়িয়ে সছন্দ নূপুরের শব্দ কোন দিক থেকে আসছে তার অনুসন্ধান করতে করতে ড্রইং রুমে আসছিল হঠাৎ ড্রইং রুমের দরজাটা দরাম করে বন্ধ হয়ে গেল দেখে বিরক্ত মুখে সে আবছা অন্ধকার ডাইনিং রুমে গিয়ে মোবাইল কানে বাড়িতে ফোন করে জানালো।
পায়েল অনেক কষ্টে বললো,-"কে তুমি?" বহুদূর থেকে যেন ঘর্ঘর কন্ঠে উত্তর এলো -" চিনতে পারছো না? ভেবে দেখ।" কন্ঠস্বরের শব্দ কোনদিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করে পায়েল ওই বাহুপাশ থেকে মুক্ত হতে চাইলো। কিন্তু সেই কন্ঠস্বর এবারে একেবারে যেন কানের পাশে এসে বাজলো, -"কোথায় খুঁজছো আমায়?আমি তো তোমার পাশেই আছি, তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো এবার।"
-" না প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও,আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে...." -"হাঃ হাঃ" শব্দে হেসে উঠলো কন্ঠস্বর।বললো,-" তোমার বরের মনে তোমার জন্য বিরক্তি আনতে পেরেছি আমি,এখন সেতো তোমার মতো উন্মাদের কাছ থেকে ছাড়া পেতে চায়....।দেখছো না,তুমি ভাবছো 'বিপদে পরেছো' আর সে তোমাকে ভাবছে 'আপদ' হাঃ হাঃ!"
--"কে তুমি? তোমাকে চিনতে পারছি না।"চোখ বিস্ফোরিত করে বাতাসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে।
-"তুমি আমাকে বিয়ে করবে বলে কতো স্বপ্ন দেখিয়েছিলে, বলেছিলে আমাকে প্রাণের চাইতে বেশী ভালোবাসো, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তোমাকে আমার প্রাণের চাইতেও বেশী ভালোবেসেছিলাম আর তুমি বেইমানি করে বড়লোক ছেলেকে বিয়ে করলে! বারবার বলেছিলাম, তোমাকে ছেড়ে আমি মরেও শান্তি পাবোনা সে কথার তুমি পাত্তাই দিলে না নূপুর... " 'নূপুর'সম্বোধনে পায়েলের মনে পারলো।বললো,
-" দিব্যেন্দু, তুমি? তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন?"
--"খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আমাকে?তাই তো তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যেতে চাই, চলো..."
বাড়িতে ফোন কোরে প্রায় অন্ধকার ডাইনিং রুম থেক বেড়োতে গিয়ে সছন্দর চোখে পরলো ডাইনিং টেবিলের ওপর একটা ফোন,তার আলোটা শুধু কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুঝলো কোনোও কল আসছে। ফোনটা মিউট করে রাখা বোধহয় তাই শব্দ হচ্ছেনা। হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলতেই শব্দ করে ড্রইংরুমের দরজাটা খুলে গেল। দিব্যেন্দুর অতি পরিচিত দুই হাত পায়েলকে ঠেলা মেরে বললো,
-" লোকটার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নাও না হলে লোকটার সর্বনাশ হয়ে যাবে।"
-ওর সর্বনাশ কে করবে!তুমি?"
--" কেন! লোকটার আমার মতন সর্বনাশ হোক তুমি চাও না....কিন্তু কেন?" ঘর্ঘর কন্ঠস্বরে পায়েলের দুই কানে যেন বোমা বিস্ফোরণ হলো। থতোমতো খেয়ে পায়েল বললো ওর সর্বনাশ করলে যদি আমাকে ছেড়ে দাও তাহলে ওর সর্বনাশ তুমি করতে পারো।" উত্তর শুনে আরও জোড়ে ধাক্কা মেরে এক্কেবারে সছন্দর কাছে পৌঁছে দিয়ে সে ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে বললো, -"ফোনটা কেড়ে নাও...." ফোনটা ছিনিয়ে নেওয়া মাত্র দিব্যেন্দুর হাতের মুঠোতে ধরা পায়েলের ফোন ধরা হাতটা পায়েলের কান স্পর্শ করলো। সছন্দ অবাক চোখে দেখলো আর শুনলো-- পায়েলের কন্ঠে পুরুষের কন্ঠ! অপরপ্রান্তের সঙ্গে ফোন হাতে এপ্রান্তের কথপোকথন,-"হ্যাঁ বল্ দাদাভাই..."
-"আমি সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই শুনতে পাইনি।"
--"হ্যাঁ,তোর বন্ধুর দাদা আর তার নতুন বৌয়ের ভালই দেখ-ভাল করছি।"
-" কি বলছিস? এক্ষুনি আসছিস...?আয় দাদাভাই, তাড়াতাড়ি আয় আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে..একটু শুতে যাচ্ছি।"সছন্দ কিছু বলার আগেই পায়েলের হাত থেকে ফোনটা মেঝেতে পরে গেল আর সেই সঙ্গে পায়েলও জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে শুভেন্দুরা বাড়ি ফিরলো সঙ্গে প্রশান্ত। শুভেন্দুর মা ছোটোছেলের ঘরে ঢুকে আর্তনাদ করে উঠলেন। সদ্য জ্ঞান ফেরা দূর্বল পায়েলকে ড্রইংরুমের সোফায় একলা শুয়ে থাকতে বলে সকলে সেই ঘরের দিকে ছুটে গেল।
পায়েল দেখলো দিব্যেন্দুকে। পায়ে হেঁটে ওর কাছে এলো,গলায় দড়ি দেওয়ার ফলে ঠিকড়ে বেড়িয়ে আসা বিস্ফোরিত চোখে বললো,-" বৃথাই তোমার মতন স্বার্থপর মেয়েকে না পেয়ে গলায় দড়ি দিলাম... তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা...তোমার সঙ্গে কথা ব্যয় করতেও ঘৃণা হচ্ছে। যাকগে চিরকূটে 'আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়'লিখে রেখেছিলাম ..তাই এবারের মতন ছাড় পেলে। পারলে নিজেকে শোধরাও।"