" আমরা যারা বিবাহ নামক সম্পর্ককে মেনে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি , তারা কি আদৌ এই সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ? এই প্রশ্নটা মাথায় আসতেই হঠাৎ সেটা সৌমেন এর দিকে ছুঁড়ে দেয় পারমিতা।" সহধর্মিণীর থেকে ছুঁড়ে আসা প্রশ্নে সৌমেন একেবারে চমকে যায় ! চমক ভাঙ্গে পারমিতারই ধাক্কাধাক্কিতে। আসলে এরকম প্রশ্নবাণে সৌমেন একেবারেই অভ্যস্ত নয়। তাই তো বিয়ের পরে বাড়ির লোকের থেকে পাওয়া ডিপ্লোম্যাটিক আচরণ তাকে অবাক করে দেয়। বাড়ির লোকের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করার পরেও কেন তাকে বিভিন্ন সমস্যা পোহাতে হলো, বলাবাহুল্য এইসব প্রশ্নের উত্তরই সে সবসময় খুঁজে বেড়ায়। নতুন বউয়ের থেকে সমস্যা না আসায় সে আরো অবাক হয় ! নিজের লোক হঠাৎ করে দূরের হয়ে গেলো কি করে , এটাই তার সবসময়ের জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়ায় !
অন্য বাড়ি থেকে আসা মেয়েটির প্রতি তার ও তার বাড়ির লোকের প্রতিমুহূর্তে অসম্মান, উদাসীনতা , অবহেলা মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পরে তার হুঁশ ফেরে। ততদিনে সব শেষ। নতুন তৈরি হওয়া সম্পর্কের প্রতি ধ্যান না দেওয়ায় সৌমেন আর পারমিতার সম্পর্কটা যে শুরুতেই শেষ হয়ে গেলো , এটা ভাবলেই সত্যি সৌমেনের খুব আফশোস হয়। সত্যিই নতুন তৈরি হওয়া এই সম্পর্কের ব্যাপারে তার আরও যত্নশীল হওয়া দরকার ছিল বলে সে সবসময় মনে করে। অন্যদিকে পারমিতাও সর্বদা ভাবতে থাকে তার অপরাধটা কী এতটাই গুরুতর যে , সৌমেনও তাকে ভুল বোঝে ? তার অপরাধটা যে কি সেটাই সে এখনও বুঝে উঠতেই পারে না।
পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই মা- বাবার কথায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় পারমিতা। সেইমত দেখাশোনা শুরু হতেই সৌমেনের বাড়ির লোকের পছন্দ হয় পারমিতাকে। অবশ্য পছন্দ না হবার তো কিছু ছিল না ! পারমিতা সব দিক থেকে সৌমেনের উপযুক্ত তো বটেই , বরং আরও বেশি কিছু। বলা যেতে পারে, এই হীনমন্যতা থেকেই
পারমিতার প্রতি সৌমেনের একটা চাপা ক্রোধ ও ক্ষোভের জন্ম হয়, যা পরবর্তীকালে সৌমেনকে অন্য সম্পর্ক তৈরিতে প্রায় বাধ্য করে। এবং এটা হলো শুধুমাত্র পারমিতাকে চাপে রাখার একটা উপায়। এপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো , পারমিতাকে সৌমেনের কোনোদিনই সে অর্থে পছন্দ ছিল না। বাড়ির লোকের কথা রাখতে গিয়ে সে পারমিতাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে যা হয় ! অন্য দিকে দৃষ্টিটা একটু বেশিই ছিল তার। কিন্তু এখানেও বাধ সাধে পারমিতা। তাই তো পারমিতার প্রতি সৌমেনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এতে পারমিতার একাকিত্বতাও ক্রমশ বেড়ে যায়।
স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক ভাঙনে বাইরের লোক তখনই আসে , যখন নিজেদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব থাকে !
পারমিতা বরাবরই একটু অন্য ধাঁচের। বড়দের সম্মান করা , ছোটদের আদর ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নেওয়া, এ সবই তার স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। অনেকে তার এই স্বভাবের প্রশংসা করলেও , অনেকে আবার এগুলোকে বেশি বাড়াবাড়ি বলে মনে করে। তাতে ওর অবশ্য কিছু যায়- আসে না। এরপর শ্বশুরবাড়ি গিয়েও ও ওর স্বভাবমত সবার সাথে মেশার চেষ্টা করলেও , শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারে না। এতে পারমিতা প্রথমটায় খুব ভেঙে পড়লেও , পরবর্তীতে সে সব সামলে সন্তানদের বড় করায় ব্রতী হয়। আসলে পারমিতার কাছে সম্পর্কের মূল্য এতখানি যে , সেই জায়গায় সে আর অন্য কিছু ভাবতেই পারে না। তা বলে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কোনোকিছু করা তার আবার পোষায় না। আর সেখানেই সবার সাথে তার পার্থক্য। শ্বশুরবাড়ির সাথে ওর মানসিকতার যে আকাশ - পাতাল পার্থক্য , তা প্রথমে ও বুঝতে না পারলেও , ধীরে ধীরে সবই সে বুঝতে পারে।
বরাবরই সকলের থেকে পারমিতা ছিল একেবারে আলাদা। নিজের কোনোকিছু কে মূল্য দেওয়ার থেকে অন্যেরটা দেখা তার অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে ছিল। শিশু বয়স থেকেই পারমিতা সব কিছু সবার মধ্যে ভাগ করে তারপরই নিজের জন্য রাখতো। এই মেয়ে যে বড় হয়েও একই স্বভাব বজায় রাখবে , সেতো বলাই বাহুল্য। একেবারেই সমাজ বহির্ভূত স্বভাব। এরকম যারা হবে , সবাই কিন্তু তাদেরকে বাঁকা চোখেই দেখবে। পারমিতার ক্ষেত্রেও একই ঘটনাই ঘটেছে। সে আবার তার স্বভাব পরিবর্তনে নারাজ। এই ব্যাপারে সৌমেনেরও প্রথমটায় পারমিতাকে যাচাই করতে বেশ অসুবিধাই হয়েছিল। অনেক পরে অবশ্য সে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও ততদিনে সম্পর্ক প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। তবে পারমিতার দিক থেকে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টার অন্ত ছিল না। আমরা যেহেতু সময়ের কাছে দায়বদ্ধ , তাই সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে অপেক্ষা করা ছাড়া ওর কাছে আর কোন উপায়ও ছিল না। সেই অপেক্ষাই পারমিতার জীবনে সুখ এনে দিলো। মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে সৌমেন একটা সময় পারমিতার চিন্তাধারাকে মূল্য দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতেই পারমিতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু করলো। বাইরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে সৌমেন আস্তে আস্তে সংসারের প্রতি , বিশেষত পারমিতার প্রতি মনোযোগ দেওয়াও শুরু করলো। সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনে সৌমেনের এই উদ্যোগকে পাথেয় করে পারমিতাও তার ব্যক্তিগত স্বভাবের কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে একসাথে আজীবন চলার অঙ্গীকার করলো।
শেষ হলো দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান।এইভাবেই যেনো সব মৃতপ্রায় সম্পর্ক আবার সজীব হয়ে ওঠে এটাই সবার কাম্য। সম্পর্ক গড়ার থেকে টিকিয়ে রাখা বেশি কঠিন। তাই আমাদের সবারই উচিৎ সেই দিকেই মন দেওয়া।