সমুদ্র-সখী : সায়ন্তনী দাস ধর


 

         "দীপা, অত গভীরে যেও না, ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে পারবে না।" মায়ের কথায় পাত্তা দিতে ভারি বয়েই গেছে দীপার। " কিচ্ছু হবে না, মা। আর সমুদ্র তো কিছুই নেয় না, সবকিছু ফিরিয়ে দেয়" বলে আরও এগিয়ে যায় সে। সত্যিই, সমুদ্রের সঙ্গে কি এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ সে। সমুদ্রের কাছে বারবার ফিরে আসতে চায় সে। তাই তো প্রতি বছর বাবা মা তাকে নিয়ে ঘুরতে চলে যান ভারতবর্ষের বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতে। সাগরের রূপ রস গন্ধ প্রাণ ভরে উপভোগ করে দীপা। 


         কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। দীপার বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু তার সমুদ্রপ্রীতি এতটুকু কমেনি। সে আজও বিশ্বাস করে, সমুদ্র তার আত্মার দোসর, তার শুভাকাঙ্খী, প্রাণের শান্তি। দীপার স্বামী অরিন্দম ঠাট্টা করে, " সমুদ্র কি আমার সতীন?" "কিসব কথা! যত্তসব......." রেগেমেগে চলে যেতে যায় দীপা। অরিন্দম দীপাকে আটকায়, আদরে আদরে তার রাগ ভাঙায়," এবার বল তো, হানিমুনে কোথায় যাব আমরা?" উচ্ছ্বসিত দীপা বলে ওঠে, "সমুদ্রে......." হা হা করে হেসে ওঠে অরিন্দম," নাঃ! এবার কিন্তু সত্যিই হিংসে হচ্ছে আমার!" অরিন্দমের গলা জড়িয়ে বলে দীপা, "তাই বুঝি?" 


        কয়েকদিন পর। বিদেশের এক শান্ত, নির্জন সৈকতে বিস্তীর্ণ জলরাশির সামনে দীপা দাঁড়িয়ে আছে বিভোর হয়ে। সে তো ভাবতেই পারেনি অরিন্দম তাকে বিদেশের সমুদ্রের সাথেও পরিচয় করাবে! দীপা অনুভব করার চেষ্টা করছিল, দেশের সাগর কতটা আলাদা এই অচিনপুরের সাগরের থেকে! কয়েকদিন সমুদ্রে স্নান করে, ঘুরে বেড়িয়ে নতুন দেশটাকে চিনতে চিনতে বেশ কেটে গেল। ফেরার দিন প্রায় আসন্ন। প্রাণ ভরে সাগরের সবটুকু সান্নিধ্য পেতে চায় দীপা, আর অরিন্দম একান্তে উন্মোচিত করতে চায় দীপার সকল রূপ। বেখেয়ালে আবেগে ওরা ভেসে যায় সমুদ্রের অনেকটা গভীরে। হঠাৎ ধেয়ে আসে বিশাল এক ঢেউ। তাল সামলাতে না পেরে দুজনেই আলাদা হয়ে যায়। নিষ্ঠুর ঢেউটা ওদেরকে নিয়ে ইচ্ছেমত খেলা করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় একজনকে সৈকতের দিকে, আরেকজনকে নিয়ে চলে যায় আরও গভীরে। অনেক পর জ্ঞান ফেরে দীপার। তাকে ঘিরে লোকজন জড়ো হয়েছে। কিন্তু  অনেক খোঁজাখুঁজির পরও অরিন্দমের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। পাগলের মত কান্নাকাটি করতে থাকে দীপা।


          "সমুদ্র তো কোন কিছুই নিয়ে যায় না....সব ফেরত দেয়...." বিড়বিড় করতে করতে পাগলের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে দীপা। অনেকটা দূরে গিয়ে সে স্তব্ধ! অরিন্দম না? জ্ঞান ফেরাবার সমস্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করে সে যখন ব্যর্থ, তখনই চোখ খোলে অরিন্দম! সর্বস্ব ফিরে পাওয়ার আনন্দে হাউহাউ করে কাঁদছে দীপা। অলক্ষ্যে হাসছে সখা সাগর।

Post a Comment

Previous Post Next Post