বৌমা রেডিওটা ঠিক আছে তো ? কাল সকালে তো মহালয়া! মনে আছে তো ? এই বলতে বলতে ধীমান বাবু দোতলার ঘর থেকে হাঁক মারলেন। বড় বউ নীতা উত্তর দিল, সব ঠিক আছে বাবা। কাল ঠিক সময়মতো চলবে। এইজন্য , ঠিক এইজন্যই নিজের ছেলে- মেয়ের থেকেও বৌমাকে এত ভরসা করেন ধীমান বাবু। এব্যাপারে অবশ্য শাশুড়ীও একমত। বাড়ির প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি ব্যাপারে বড় বউ নীতার নজর থাকে। বড় বউ হওয়ার সব রকম গুণ ই তার মধ্যে আছে।
নীতার কথায় আশ্বস্ত হয়ে ধীমান বাবু আবার তার বই পড়ায় মনোনিবেশ করলেন। পরেরদিন যথাসময়ে মহালয়া শুনতে বাড়ির সবাই দোতলার বারান্দায় জড় হল। বড় বউ সময়মত চা এবং ছোটদের দুধ দিয়ে গেলো। এ বাড়িতে আসা ইস্তক এই দিনটায় নীতা এই কাজ ই করে আসছে। বাড়ির ছোট বউ অর্থাৎ শর্মিলা বড় জায়ের ছায়ায় বেশ ভালোই আছে। খুব একটা সাংসারিক দায়িত্ব তার ওপর পড়ে না। তাই সেও খুবই খুশি । সে অবশ্য নীতার মতো এতকিছু পারেও না। এই নিয়ে অবশ্য সবাই কম - বেশি কথা শোনায়। তাতে তার খুব একটা কিছু যায় আসে না।
মহালয়ার দিন এই বাড়ি থেকে সবাইকে জামাকাপড় দিতে যাওয়ার চল বহুবছর ধরে চলে আসছে। এখনও তার অন্যথা হয় না। শাশুড়ির থেকে শিখে নিয়ে নীতাই এতবছর ধরে এই কাজ করে আসছে। আজ তাই বাড়িতে সাজো সাজো রব। সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো চলছে। ধীমান বাবু বেশ খাদ্যরসিক। বিশেষ করে পুজো পার্বণের দিনে তার বেশ ভালোমন্দ খাবার চাইই চাই। দুই ছেলেও হয়েছে সেরকমই। এইদিনে অবশ্য প্রতিবার ই বাড়ির মেয়ে অনুরূপা আসে। আজও তাই হলো। পিপি এসেছে বলে বড়ো র মেয়ে পিংকি আর ছোটর ছেলে আবীরের সে কী আনন্দ! বিকেলে সবাই মিলে বাড়ির গাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হবে! কে কি সাজবে , তাই নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। অনুরূপা একাই আসে মহালয়ার দিনে। জামাই আসে অষ্টমীতে। তারপর দশমী কাটিয়ে তারা ফিরে যাবে। এই হয়ে আসছে এত বছর ধরে। পুজোয় ছোট বউও বাপের বাড়ি যায়। তবে একদিনের জন্য। বড় অবশ্য কোথাও যায় না। তবে এবারের নিয়ম একটু আলাদা। লক্ষ্মীপুজোর পর এবার সবাই মিলে উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যাবে। সেইমতোই সব ব্যবস্থা হচ্ছে। মেয়ে অনুও বাদ যাবে না। সব থেকে বেশি আনন্দ বাচ্চাদের। আসলে সারাবছর পড়াশোনা , দৌড়াদৌড়ি। ওরা আর পেরে ওঠে না। ওদের বাবা - কাকাদেরও একই অবস্থা। তাই তো সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে ওরা এই প্ল্যান টা করেছে। ধীমান বাবু ও তাঁর গিন্নী প্রমীলা দেবী অবশ্য এই সফরে নেই। তাদের বয়স হয়েছে । ছোটদের সাথে পাল্লা দিতে পারবে কেনো ?
যথাসময়ে যাওয়ার দিন এসে গেলো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে তারা সবাই স্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলো। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছাড়লো। সবাই মিলে খুব ই আনন্দ করতে করতে পরের দিন মাল জংশন এ এসে হাজির হলো। হোটেল আগেই বলা ছিল। সেইমত হোটেলে পৌঁছে স্নান করে তারা ওইদিনটা বিশ্রাম করার পরিকল্পনা করলো।
পরেরদিন খুব সকালে উঠেই ওরা তৈরি হয়ে নিল । যথাসময়ে গাড়ি এলে ওরা বেড়িয়ে পড়লো জঙ্গল দেখার উদ্দ্যেশ্যে। সারাদিন ঘুরে হোটেলে ফেরার সময় এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হলো ওরা। হঠাৎ করে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারলো যে , সামনে হাতি বেড়িয়েছে। একদম টু শব্দটি না করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বেশ কিছুক্ষণ এবং গাড়ির লাইট ও নিভিয়ে ফেলতে হবে। ওরা যেনো বুঝতে না পারে যে সামনে কেউ আছে। তাহলে হাতির দল জঙ্গলে চলে যাবে। এই কথা জানতে পেরে ওরা একদিকে যেমন দেখার জন্য উৎসুক হলো , ঠিক তেমনি ভয়ও পেয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য ওদের গাড়ি আবার যাত্রা শুরু করলো। কারণ ততক্ষণে হাতি মহাশয়রা জঙ্গলে চলে গেছে। এতে উপস্থিত অনেকেরই মন খারাপ হয়ে গেলো , কারণ তারা চাক্ষুষ দেখতে পারলো না ! তার আগেই ওরা জঙ্গলে চলে গেছে। পরের কদিন গরুমারা , জলদাপাড়া , রকি আইল্যান্ড , বিভিন্ন চা বাগান , তিস্তা নদীর ওপর তৈরি সেবক ব্রীজ এবং আরও অনেক জায়গা ঘুরে ওরা লাভা - লোলেগাও চলে গেলো। সেখান থেকে গ্যাংটক ঘুরে প্রায় দশদিন ছুটি কাটিয়ে ওরা সবাই ফিরে এলো কলকাতায়।
এতদিনে বাড়িটা আমার ভরে উঠলো , এই কথা বলতে বলতে ধীমান বাবু ঘরে ঢুকলেন। কেমন ঘুরলে তোমরা দিদিভাই , দাদুভাই ? আজ থেকে তোমাকে সব গল্প বলবো দাদাই। জানো তো আমরা একটুর জন্য হাতিটা দেখতে পাইনি। আমরা একটু দূরে ছিলাম তো ? কিন্তু স্যানচুয়ারিতে আমরা অনেক কিছু দেখেছি জানো ঠাম্মু ! ওদের কথা বলার উত্তেজনা বলে দিচ্ছে ওরা কতটা আনন্দ করেছে ! প্রমীলা দেবী বললেন , আচ্ছা ঠিক আছে , সবাই স্নান খাওয়া সেরে বিশ্রাম করো , বিকেলে সব গল্প শুনবো।
একান্নবর্তী পরিবারের এই যে বাঁধন যা আজ প্রায় নেই বললেই চলে , তা যে পরিবারের প্রত্যেকের পক্ষে কতটা সুবিধাজনক বা বলা যেতে পারে অক্সিজেনের উৎসস্থল তা শুধুমাত্র সেইসব পরিবারের মানুষেরাই বলতে পারে। বিশেষ করে বাড়ির বাচ্চাদের পক্ষেও তা সত্যি প্রয়োজনীয়। কিছু সুবিধা - অসুবিধা বাদ দিলে মোটের ওপর সত্যি তা খুব ই প্রয়োজনীয়। কিন্তু মুশকিল হলো, আমরা সব কিছুর পরিবর্তন করতে গিয়ে এরকম একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি , যা এই একান্নবর্তী পরিবারের ব্যবস্থাকে প্রায় মুছে দিয়েছে। আমরা তার জন্য অনেক অসুবিধা ভোগ করলেও সেই ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা মনেই আনি না। এতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাড়ির বাচ্চারা । ঠাকুমা - দাদুর আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে ওরা একেবারেই নিজেদের ছেলেবেলাকে হারিয়ে ফেলেছে। যারা বোঝে তারা মুখ ফুটে বলে ফেলে আর বাকিরা পরিস্হিতির শিকার। তাতে অবশ্য বড়দের খুব একটা কিছু যায় আসে না। বরঞ্চ তারা এই ছোট পরিবারের মধ্যে বাচ্চাকে নিয়ে আসতে পেরে খুব ই গর্ব অনুভব করে। শুধু নিজেদের কথা ভাবলেই হবে না , আজকের শিশু , যে ভবিষ্যতের নাগরিক, তাদের ভালো থাকা , আনন্দে থাকা নিয়ে তো বড়দের কেই ভাবতে হবে !!