ঠাম্মির স্নেহ : ঈশিতা ভট্টাচার্য

 

          ছোট্ট তিন্নি জানলা দিয়ে অনেকক্ষন ধরে কি যেন মন দিয়ে দেখছে ! মা যে কখন  পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে , সে দিকে খেয়ালই নেই তার ! বেশ কিছুটা সময় এইভাবে কেটে যাওয়ার পর মার ডাকে তার হুঁশ ফেরে। মা জিজ্ঞেস করতেই তিন্নি বলে ওঠে যে,  ও ঠাম্মির কথা ভাবছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ,  খুব সম্প্রতি তিন্নির ঠাম্মি গত হয়েছেন। দাদাই চলে যাওয়ার পর গত একবছর ধরে ঠাম্মিই ছিল ওর একমাত্র খেলার সাথী। কখনও চোর-পুলিশ  খেলা , কখনও ঠাম্মির পিঠে চড়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলা আবার কখনও একজায়গায় বসে ইকির - মিকির খেলা। আজ আর কেউ খেলার সাথী নেই। বাবা বলেছে , ঠাম্মি ওই আকাশের তারা হয়ে গেছে ! তাই ছোট্ট তিন্নি আকাশের তারাদের ভিড়ে তার প্রিয় ঠাম্মিকেই খোঁজার  চেষ্টা করে চলেছে  সবসময়। মায়ের ডাকে তার হুঁশ ফিরলে মাকে জিজ্ঞেস করে , মা ঠাম্মি কি আমাদের দেখতে পারছে ? উত্তরে মা তিন্নিকে বলে , ঠাম্মি সব দেখতে পারছে সোনা। তুমি যদি দুষ্টুমি করে আমার কথা না শোনো , তাহলে ঠাম্মি খুব কষ্ট পাবে কিন্তু। এই কথা শুনে  তিন্নি সোনা মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে আমি সবসময় তোমার কথা শুনবো মা। ঠাম্মি কষ্ট পায় এমন কাজ আমি কখনও করবই না। ছ'বছরের বাচ্চার মুখে এরকম কথা শুনে মা খুবই অবাক হয়।

        পরেরদিন বিকেল থেকে তিন্নির জ্বর আসে। ডাক্তারবাবু দেখে বলেন যে, ও কি কোনো কারণে  মানসিক আঘাত  পেয়েছে ? আসলে ওনার ধারণা সেই কারণেই জ্বর এসেছে। তিন্নির মা তখন সব ঘটনা খুলে বলে। এতে ওর বাবাও খুব ই অবাক হয়। ডাক্তারের পরামর্শমতো তিন্নি ওর মার সাথে কিছুদিনের জন্য দিদার বাড়ি বেড়াতে যায়। 

     আসলে বাচ্চাদের ওপর আমরা আমাদের সব কিছু চাপিয়ে দিই। ওদেরও যে মন আছে , ভালোলাগা , মন্দলাগা আছে , সেসবকে আমরা আমল দিই না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ঠাকুমা - দিদিমাদের থেকে বাচ্চারা যে আন্তরিকতা , স্নেহ - ভালোবাসা পায় ওরা  সেটা কখনও হারাতে চায় না। সেই জায়গাটা যখন কোনো কারণে হারিয়ে যায় , তখন সত্যি ওরা খুব ই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর জন্য ওরা অনেকসময় অসুস্থও  হয়ে পরে। ঠিক যেমনটি হয়েছে এই তিন্নির ক্ষেত্রে। ঠাম্মির কাছে যা এতদিন ও পেয়েছে , তা যে কোনোভাবেই বাবা - মার কাছে পাবে না। সেটা ও খুব ভালোই বুঝতে পেরেছে  এবং এটাই ওর  মনোকষ্টের কারণ।

    পরিশেষে বলি , আমরা যারা বাচ্চাদের ঠাকুমা - দাদুদের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে চাই  বা সরিয়ে রেখে বিশেষ উপায়ে শিশুদের  বড় করার চেষ্টা করি , তারা আসলে নিজের বাচ্চার কাছে যে ছোট মনের মানুষ হয়ে উঠি , তা কিন্তু বুঝতে পারিনা। কারণ একটি বাচ্চার বড় হওয়ার পিছনে তার মা - বাবার শাসনের পাশাপাশি    ঠাকুমা - দাদুর আদরেরও প্রয়োজন আছে। তবেই একটি বাচ্চা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

  এই গল্পের যে বাচ্চাটি ( তিন্নি ) তার ঠাম্মি - দাদাইয়ের সাথে যে ভালো সময়টা কাটিয়েছিল ,  দুজনেই চলে যাওয়ায় সে তার খেলার সাথীদের হারিয়ে ফেলে। এইসব ভাবনা থেকেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

          তাই বলি , বাচ্চাদের মনটাকে বোঝার জন্য বাড়ির বড়দের ওদের মতো করে ওদের সাথে মিশতে হবে। নিজেদের কাজের মধ্যেও সময় বার করে ওদেরকে কিছুটা সময় দিতে হবে। আবার পাশাপাশি এও মনে রাখতে হবে যে,  বাচ্চাদের মন ভালো রাখতে গিয়ে আমরা যেন তাদের অতিরিক্ত প্রশ্রয় না দিয়ে ফেলি ! যা কিনা পরবর্তীকালে বড়দের ই বিপাকে ফেলে !

Post a Comment

Previous Post Next Post