হাউস ওয়াইফ : ঈশিতা ভট্টাচার্য



       রান্নাঘরে কাজের মধ্যেই অনিতা হঠাৎ করে শুনতে পেলো অনীক কাকে যেন বলছে  , ' না না ওকে দিয়ে এই কাজটা হবে না। ও তো হাউস ওয়াইফ।'  কথাটা শুনেই মূহুর্তে অনিতার হাতের কাজ থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো। আবার সেই কথা ? বিগত দশ বছরে এই কথাটা শুনে শুনে কানে তালা ধরে  গেলো। ওর মনে হতে লাগলো , বিয়ের পর থেকে এখনও পর্যন্ত ওর কি এই একটাই পরিচয় ? ওতো কারোর মেয়ে , কারোর বৌমা , কারোর বউ আবার কারোর মা । সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ওর পরিচয় কেনো যে এই শব্দটায় আটকে আছে , এটাই অনিতা এক এক সময় বুঝে উঠতে পারে না। 


         সারাদিন এই ভাবনা ভাবতে গিয়ে ওইদিন ও  মেয়ে রিম্পির স্কুলের পি টি এম  মিস  করে যায়। যা সময় পেরিয়ে যাওয়ার অনেকক্ষন পরে ওর মনে পড়ে।  অনেকবার এই শব্দটা শুনলেও সেইদিন রাতে  ও প্রথম অনীকের কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়ে বসে। অনিতার বক্তব্য, "হাউস ওয়াইফ"  শব্দটার সোজা অর্থ হলো ' বাড়ির বউ '। তাহলে ওর মতে   বাড়িতে থাকা যেকোনো  বউ মানেই তো  " হাউস ওয়াইফ।"   সেই অনুযায়ী সব বউ ই তো বাড়িতেই থাকে। কিছু সময়ের জন্য বাইরে থাকলেই তার নামকরণ পাল্টে যাবেই বা কেনো আর তাতে তাদের মূল্যই বা বেড়ে যাবে কেনো ? ও আরও বলে যে,  বাড়ির মেয়েরাও তো বাড়িতেই থাকে , সে রোজগেরে হোক বা না হোক   তবে মেয়েদের কেনো  ' হাউস গার্ল বলা হয় না ? এই নিয়ে অনেকরাত পর্যন্ত অনীকের সঙ্গে তার তর্কও হয়। যাইহোক তর্কে এবং  যুক্তিতে অনিতার  জিত হয় ঠিক ই, কিন্তু  জগৎ সংসার  সত্যি ই কি অনিতার যুক্তি মানবে ?


     " হাউস ওয়াইফ " যখন রোজগেরে হয় , তখন কিন্তু তার নামকরণ পাল্টে হয় ' রোজগেরে  বউ।' শুধু তাই নয় , তার প্রাপ্য  সম্মান বজায় রাখা থেকে শুরু করে  সে ঠিক করে খাবার খাচ্ছে কিনা , ঠিকমতো বিশ্রাম নিতে পারছে কিনা সব দিকেই সবার খেয়াল থাকে। অথচ যে বাড়ির বউ রোজগার করে না , সে কিন্তু  বাড়ির সব কাজ যেমন  কাকভোরে  ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাকে স্কুলের জন্য তৈরী করা,  শ্বশুর মশাইয়ের হাতে সময়মতো চায়ের কাপ ধরিয়ে দেওয়া, শাশুড়িকে পুজোর জোগাড় করে দেওয়া , আবার বরের অফিসের প্রেজেন্টেশন এর জন্য তৈরী করা স্লাইড রেডি করে দেওয়া আরও কত কী কাজ সে একা হাতে সামলায়। তখন কেউ কি রোজগেরে বৌ এর মত তার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয় ?  মনে তো হয়  না। এটাই বাস্তব। অনিতা এটাই ভাবতে থাকে। সত্যি যদি সে আজ চাকরী করতো , তাহলেও কি অনীক থেকে শুরু করে সবাই তার দিকে আঙুল তুলতে পারতো ? ছোট্ট রিম্পির কথা ভেবে সেই তো সেদিন চাকরীর প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। যোগ্যতায় সেও তো কম ছিল না। মনে পড়ে যায়  অনেক অসুবিধার মধ্যেও সে কিন্তু মাষ্টার ডিগ্রিটা অর্জন করেছিল। চোখে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু হায়, তার  স্বপ্ন আর সফল হলো না। তাই তো মেয়েকে  নিজের মতো করে বড় করার লক্ষ্য নিয়ে সে এগোচ্ছে।


          আমাদের ভুলে গেলে চলবে না , বাড়ির বউ , সে  রোজগেরে হোক বা না হোক সবার ওপরে সে একজন মানুষ , আর পাঁচটা মানুষের মতো তার ও চাওয়া - পাওয়া আছে। তারও  শখ - আল্হাদ আছে। রোজগেরে না হলে বাড়ির বৌ -এর যদি কোনো মূল্যই না থাকে, তবে আমরা কিন্তু  আসলে আমাদের মা - ঠাকুমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছি । কারণ এখন পরিস্থিতি মহিলাদের কর্মমুখী করে তুলেছে। কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত চিত্রটা  এমন ছিল না।


         খেয়াল করলে দেখা যাবে পরিমিত  কাজের বিনিময়ে একজন রোজগেরে মহিলা যে পরিমাণ পারিশ্রমিক পান, তাতে অনেকসময় তিনি  খুশিও হন না।  অন্যদিকে  অপরিমিত কাজের ব্যয়ভার বহন করে একজন তথাকথিত হাউস ওয়াইফ বিনা পারিশ্রমিকে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেন হাসিমুখে। উপরি পাওনা অসম্মান। 


              মজার বিষয় হলো , এই রোজগেরে মহিলারা আবার  নিজেদের বাড়ির বউ এর থেকে পৃথক ভাবেন ,  উন্নত ভাবেন। অথচ একবার ও ভাবেন না যে, তারাও কিন্তু পরিচয়ের দিক থেকে প্রথমে হাউস ওয়াইফ , তারপর আর্নিং ওয়াইফ। কাউকে অসম্মান করা  মানুষের শোভা পায় না। মনে রাখতে হবে  আমরা সবাই এক ই মাঠের  খেলোয়াড়।  ২২ গজের মধ্যেই আমরা সবাই সীমিত। যে যখন আউট হবে , জীবন সেখানেই শেষ। কী হবে ভেদাভেদ করে ? চলুন সবাই মিলে একসাথে চলার ব্রত নিই। জীবন তো একটাই। তাকে সবাই মিলে সুন্দরভাবে উপভোগ করি। এমনিতেই প্রকৃতি এবং পরিবেশে সৃষ্ট হওয়া বিভিন্ন মারণ রোগ আমাদের জীবনকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে , তার ওপরে নিজেদের তৈরি করা ভেদনীতি ছেড়ে আমরা যদি এগিয়ে যেতে না পারি , তবে পৃথিবীর ধ্বংস আটকায় কার সাধ্যি ? 


     অনিতার মতো এরকম অনেক মহিলাদেরই যোগ্যতা থাকা সত্বেও বিভিন্ন কারণে রোজগেরে হওয়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু  তাদের নিশ্চয়ই এই কারণে অনীকদের মতো মানুষদের থেকে অসম্মান প্রাপ্য নয়!  কিছু অর্থ বেশি এলে স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে এই তো ? শুধুমাত্র এই কারণে মানুষ হয়ে রোজগার না করা  মানুষগুলোর  প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা কি উচিৎ ? নিজেদের উন্নত বলে দাবী করে যে মনুষ্যজাতি , তাকে কি অমনুষ্যের কাজ করা শোভা পায় ? তবে কি বলা ভালো ' অর্থই অনর্থের মূল ! ' একটু ভেবে দেখবেন !

Post a Comment

Previous Post Next Post