একজন বৃহন্নলার কাহিনী : সৌমি বোস

 

আমার জন্মটা হয়েছিল একটা মধ্যবিত্ত খুবই সাধারণ পরিবারে। যেখানে ছেলেরা ছেলেদের মতন আচরন করবে আর মেয়েরা মেয়েদের মত আচরণ করবে সেটাই ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু এই নিয়মের বাইরে বেরোলেই ছিল কঠিন বিপদ। চার কন্যা সন্তানের পর শুধুমাত্র পুত্র লাভের আশায় আমার বাবা পঞ্চম সন্তান লাভ করেন । আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হলো অবশেষে কিন্তু আমার মধ্যে যে দুই সত্তার বসবাস তা বুঝেতে খুব বেশিদিন দেরি হয়নি বাবার। অনেক চেষ্টা করা হল কিন্তু কিছুতেই দুই সত্তা কে আলাদা করা গেল না। ধীরে ধীরে ব্যাকরণ ক্লাসে পরিচিত হলাম পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ এদের সাথে, অবশ্য আরো একটা লিঙ্গ কে চিনতে শিখলাম সেটা ছিল নপুংসক লিঙ্গ চিনতে শিখলাম সেইসব নপুংসক লিঙ্গদের কে। ধীরে ধীরে বুঝলাম আমি মানব সন্তান হলেও এই সমাজ আমায় মানব সন্তান বলে গ্রাহ্য করে না, এই সমাজে আমি এবং আমার মতোন মানুষেরা অস্পৃশ্য।

 

        হ্যাঁ আপনি ঠিকই শুনলেন, 'আমি এবং আমার  মতো মানুষেরা' , ভিড় বাসে কিংবা ট্রেনে যার  করতালি আপনাকে বিরক্ত করে বারবার। নিজের  অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার  আশায় যার কাছ থেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে আশীর্বাদ নিতেও ছাড়েন না আপনারা। আমি সেই বৃহন্নলা যাকে দেখলে আপনি আপনার সন্তানকে আড়াল করেন আমার থেকে। অসামাজিক কাজকর্ম প্রতীক হিসেবে যাদেরকে চিহ্নিত করেন আপনি এবং আপনার সমাজ । আমি সেই শ্রীখন্ডীর প্রতিনিধি ঘুম থেকে ওঠার পর যার মুখ দেখলে আপনার ধারণা অনুসারে আপনার সারাদিনই খারাপ যায়। যে আপনাকে ছুলে আপনার গঙ্গা স্নান করে অর্জন করা পুণ্য  সব বৃথা চলে যায়। যাকে রোজ আপনি ফিফটি-ফিফটি, ছক্কা ইত্যাদি নানা নামে ডাকাডাকি করেন, আমিই সে। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে এলাম এই শহরে। খুঁজে পেলাম আমার মত মানুষদের আর খুঁজে পেলাম আর একজনকে যিনি আমায় সন্তানস্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, আমার গুরুমা। গুরুমার কাছ থেকেই শিখতে শুরু করলাম অনেক কিছু, কি করে নিজের টুকুকে ছিনিয়ে নিতে হয় অন্যের কাছ থেকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য। কখনো আপনারা আমাদেরকে ছেলে ধরা বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন নিষিদ্ধপল্লির দালাল। কিন্তু এটা কি জানেন নিষিদ্ধ পল্লীতে জন্ম নেওয়া আড়াই দিনের ফুটফুটে বাচ্চা থেকে শুরু করে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যাওয়া আপনাদের মানব সন্তানকে আমরা সস্নেহে কাছে টেনে নিই। আমাদের অজান্তেই ওরাই  আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল হয়ে ওঠে।

 

 আপনাদেরকে তো আরো একটা কথা বলাই হয়নি আমি আপনাদের উপেক্ষিত এক কন্যাসন্তানের মা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল একজন ভালো মা হওয়ার।ঈশ্বর বোধহয় কোন এক কোনায় বসে আমার সেই প্রার্থনা শুনে নিয়েছিলেন।আর সেই জন্যই আমার কাছে তিনি সেরা উপহার টি কে পাঠিয়েছেন। আমার মেয়ে মানব সন্তান হলেও ওর আর একটা পরিচয় আছে ও একজন বৃহন্নলার সন্তান, আর ওর মা ও কে সবথেকে সুন্দর একটা পৃথিবী উপহার দেবে। যে পৃথিবীতে  আপনাদের মতো মানুষেরা বসবাস করেনা, বসবাস করে কিছু মানুষের মতো মানুষ। সব শেষে শুধু একটা কথাই বলবো আইন এর পাতায় জায়গা করে দেওয়ার পরিবর্তে, আমাদেরকে প্রকৃত অর্থে এই সমাজে জায়গা করে দিন। যাতে আমরা বাঁচতে পারি আমাদের মতোন করে।


[*প্রথমেই আসি প্রেক্ষাপট আর চিন্তাভাবনার প্রসঙ্গে। এই লেখাতে যখন আমি লিখি তখনও এমন কোন পরিকল্পনা নিয়ে আমি এই লেখাটা লিখতে বসিনি। তখনো করো না আমাদের জীবনে প্রবেশ করেনি।কলেজ থেকে ফেরার সময় একদিন মেট্রোতে একজনকে দেখি। তার মুখের গঠন চেহারা সবেতেই একটা পুরুষালি ছাপ অথচ কি উজ্জ্বল তার নারী মূর্তি। এর আগে অবশ্য রাস্তায় যেতে আসতে বহুবার তাদের মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু সেদিন যেন কোথাও একটা থেমে গেছিলাম। এতগুলো ভাবনার অনুভূতি একসঙ্গে ভিড় করে আসছিল যে তখনই ঠিক করি বাড়ি গিয়েই লিখতে বসতে হবে। তবে লিখতে লিখতেই পেনটা থামল হিউম্যান ট্রাফিকিং শব্দটার জন্য। খুব অবলীলায় আমরা আমাদের এই গোটা সমাজ হিউম্যান ট্রাফিকিং কে এদের নামের সাথে জুড়ে দিয়েছি, তবে এই চেনা পরিচিত চিত্র তো কোথাও না কোথাও বদলাতে পারে, হয়তো তো বদলেছে কিন্তু আমাদের চোখে পড়ছে না, কিংবা হয়ত তা বদলাতে পারে যদি আমরা সাহায্য করি। ব্যাস তারপর এই ভাবনার স্রোত যেদিকে বইতে শুরু করল আমি সেই দিকেই ভেসে গেলাম।


*এই লেখা টি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এই লেখাটির সাথে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার কোন যোগ নেই। তবে বাস্তবে যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তবে তা অনিচ্ছাকৃত।]

Post a Comment

Previous Post Next Post