একটি অসমাপ্ত কাহিনী : সৌমি বোস



রাত যত বাড়ে রায় বাড়ির ছোট বউটার আর্তনাদ  যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তবে ওসব এই পাড়ার মানুষদের গা-সওয়া কারোর কানেই ওই আওয়াজ আজ আর পৌঁছায় না। কিংবা পৌঁছালেও ওই আওয়াজ কেউ কানে তুলতে চায় না বোধহয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ও সব একটু আধটু ঝামেলা নাকি হয়েই থাকে, তাছাড়া বউটাই বা অত অবাধ্য কেন? যখন জানেই যে বরটা একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায় তখন সব কথায় তোমার অত কথা বলতে যাবার কি আছে শুনি? পুরুষ মানুষ এমনি একটু কড়া ধাতের, রেগে গেলে ওদের মাথা ঠিক থাকেনা, নাও এবার সামলাও ঠেলা মার খেয়ে মরো। পাশের বাড়ির চৌধুরী কাকিমার রাতের রূপচর্চা সেরে নিতে নিতে তার ষাটোর্ধ্ব স্বামীকে এই কথাগুলোই বলছিলেন আর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ত্বকের যত্ন নিচ্ছিলেন।




"তবুও প্রতিরাতে উর্মিলার এই আর্তনাদ কিছুতেই স্থির থাকতে দেয় না তাকে, এমনকি যেসব রাতগুলো অফিসের জন্য অসম্ভব কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটায় সেইসব রাতগুলোতেও উর্মিলার এই আর্তনাদ বারবার অস্থির করে দেয় তাকে।"




        রায় বাড়ির ছোট বউ উর্মিলা এপাড়ায় বিয়ে হয়ে আসবার পর থেকেই রোজ রাতে তার এই বুক কাঁপানো আর্তনাদ এখন পাড়ার সকলেরই গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম-প্রথম সবাই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে একটু আধটু দেখবার চেষ্টা করতো বটে কিন্তু এখন আর কেউ ফিরেও তাকাতে চায় না। সবাই এখন ব্যস্ত,এইসব উটকো ঝামেলায় মাথা  ঘামানোর সময় কই তাদের! আর তাছাড়া এ পাড়ায় বড় পরিবার বলতে সকলেই ওই রায়দেরই নাম করে। তাছাড়া সবাই ওই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি যারা দিনের শেষে ফিরে এসে দু তিন কামরার ঘরের মধ্যে ছোট্ট জগতে আশ্রয় নেয়। এ সব কিছুর মধ্যে সবথেকে পুরনো আর বনেদি বাড়ি হল রায়দের এই বাড়িটা। তবে এই বাড়ি আজ আভিজাত্য আর প্রাচুর্যের ভারে নুয়ে পড়েছে। আর এই লকডাউনে সবাই ঘরবন্দি হয়ে যাবার পর থেকেই এ পাড়ার চালচিত্র পাল্টে গেছে। সবাই যেন কেমন আত্মনিমগ্ন হয়ে গেছে, প্রতিদিনের এই একঘেয়ে জীবনও কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি তাতে।


বছর সাতাশের তথাগত চক্রবর্তী সল্টলেকের বড় কর্পোরেট সংস্থার সিইও, ব্যাচেলর ছেলে, আর তার মধ্যে আবার একেবারেই অজানা অচেনা একটা শহর তাই একা থেকে হাত পুড়িয়ে রান্না করা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই। আর তাই বাসস্থান হিসেবে এই পাড়া  টাকেই বেছে নিয়েছে সে। কেউ কারোর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না, বেশ শান্ত নিরিবিলি।


তথাগত এই পাড়ায় এসেছে এখনো এক বছর হয়নি। কিন্তু তার মধ্যেই এই লকডাউন এর সুবাদে এই পাড়ার কিছু দৈনন্দিন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা সম্পর্কে সেও বেশ পরিচিত হয়ে গেছে,যেমন- সন্ধ্যে সাতটা বাজলেই পাশের বাড়ি থেকে বস্তাপচা গ্যাদগেদে সিরিয়াল এর শব্দ ভেসে আসা, সেকেন্ড ফ্লোর থেকে চিন্টু কেন বাংলায় কম কথা বলে ইংরেজিতে বেশি কথা বলবে সেই নিয়ে তারস্বরে চলতে থাকা চিন্টুর মায়ের নাতিদীর্ঘ ঘ্যানঘ্যানানি এবং প্রতি রাতে এই শহরের কোলাহলকে ছাপিয়ে রায় বাড়ির ছোট বউ উর্মিলার তীব্র আর্তনাদ। এইসবই তথাগত শোনে, তবুও প্রতিরাতে উর্মিলার এই আর্তনাদ কিছুতেই স্থির থাকতে দেয় না তাকে, এমনকি যেসব রাতগুলো অফিসের জন্য অসম্ভব কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটায় সেইসব রাতগুলোতেও উর্মিলার এই আর্তনাদ বারবার অস্থির করে দেয় তাকে। কিছুতেই স্থির থাকতে পারে না সে। অনেকবার সে ভেবেছে উর্মিলা কে বাঁচাতে রায় বাড়িতে ছুটে যাবে কিন্তু যতবারই ভেবেছে  ততোবারই কোন এক অজানা ভয় যেন তাকে বারবার আড়ষ্ট  করে গ্রাস করেছে। একবার তো সে ভেবেছিল পুলিশের সাহায্য নিয়ে উর্মিলা কে উদ্ধার করবে রায়বাড়ি থেকে কিন্তু বারবার সে অজানা ভয়ের দ্বারা প্রতিহত হয়েছে, অথচ সে নিজেও জানেনা কবে-কোথা থেকে- কিভাবে- কি জন্য এই ভয়ের উৎপত্তি?


        অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ যেন উর্মিলার আর্তনাদ টা আরো বেশি আকাশ কাঁপানো। মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা এসপার-ওসপার হয়ে তবেই শান্ত হবে রায়বাড়ি। একটা সময় চিৎকারের আওয়াজ টা ভীষণ তীব্র হয়ে উঠল, মনে হল গোটা বিশ্বসংসার হাহাকার করে বোধহয় চারিদিকে ফেটে পড়ছে। তথাগত আর কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিল না, বারবার সে জানলার ফাঁক দিয়ে কিছু একটা দেখবার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিল না। তবে এর কিছু সময় পর হঠাৎই উর্মিলার আর্তনাদ যেন কোন এক গভীর অন্ধকারে মিশে গেল। ব্যাপারটায় খানিকটা অবাক হলো সে, আপন মনেই বিড়বিড় করতে শুরু করলো 'মেয়েটার কোন বিপদ হল না তো!', 'মেয়েটা আদৌ বেঁচে আছে তো'? মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা শুরু হলো, সেই রাতটায়  তথাগত কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। দুশ্চিন্তা টা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। সারারাত এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভোরের দিকে সবে দুচোখের পাতাটা এক হয়েছে হঠাৎ-ই ভীষণ শোরগোলের শব্দে তথাগতর ঘুমটা ভেঙে গেল। চশমা চোখে দিয়ে বাড়ীর বাইরে পা রাখবা মাত্রই শোরগোলের কারণ তার আর বুঝতে বিশেষ বাকি রইল না। গতকাল রাতেই উর্মিলা চিরশান্তির দেশে পাড়ি দিয়েছে। রোজ রোজ আর কাঁ হাঁ তাক্ এই অকথ্য অত্যাচার সহ্য করা যায়। আজ সকালেই বাড়ির দুধওয়ালা বংশী দুধ দিতে এসে তার ছোট বউরানী কে দেখতে না পেয়ে হাঁকডাক শুরু করে, কিছুক্ষণ পর সকালে বেরিয়ে এলেও তার ছোট বউ রানী কে দেখতে না পেয়ে খানিকটা অবাকই হয় সে। যে মেয়ে হাত-পায়ের রক্ত জমাট বাঁধা কালশিটে দাগ গুলো নিয়েও রোজ সকালে হাসি মুখে বাড়ির সব কাজ সামলায়, তার বংশী কাকার কাছ থেকে রোজ মেপে ছয় পোয়া দুধ নেয়, আবার দুধে ভেজাল থাকলে বংশী কাকা কে হলকা  বকুনিও দেয় তাকে কি না আজ বাড়িতে দেখা যাচ্ছে না! আকাশের চাঁদ সূর্য যেখানে মাঝেমধ্যে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দেয়, সেখানে রায় বাড়ির ছোট বউরানী কে কোনদিনও সে সামান্য অবসর টুকুও নিতে দেখেনি। তাই সন্দেহের বশেই তিনি নাকি পুলিশে খবর দেন, তবে তখনো তিনি ভাবতে পারেননি তার ছোট বউরানী এই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। পুলিশ আসবার পরই নাকি তার বাপের বাড়ির লোকদের খবর পাঠানো হয়। উর্মিলার বাপের বাড়ির লোক বলতে তার বয়স্ক বাবা আর একটা ছোট ভাই,মা-কে হারিয়েছে উর্মিলা বহু যুগ আগেই। অন্ন বস্ত্র সংস্থানের রাস্তা বলতে তার বাবার পান-বিড়ির ছোট্ট একটা গুমটি দোকান।


ঘটক মশাই যখন সম্ভন্ধে এনেছিল, উর্মিলার বাবাকে তখন বলেছিল নাকি- 'স্বপ্নেও কি কখনো তোমরা কল্পনা করেছিলে যে তোমার মেয়ের এত বড় বাড়িতে বিয়ে হবে, একি কম সৌভাগ্যের ব্যাপার!' তবে এত বড় বাড়ির বউ হয়ে উর্মিলার জীবনের সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে তার দিনের আলোর মত পরিষ্কার। অবশ্য পাড়ার  সকলেই এখন এক বুক সমবেদনা জানাবার জন্য ছুটে এসেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বলছে মেয়েটা ভারী লক্ষ্মীমন্ত ছিল সাত চড়েও রা কার তো না, এইভাবে চলে যাবে বুঝতে পারিনি। তথাগত এইসব কথা শুনে আর কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছিল না রাগে-অপমানে-অপরাধবোধে-ঘেন্নায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল তার। উর্মিলার লাশটা যখন তার সামনে দিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পোস্টমর্টেম এর জন্য তখন তথাগত পেটের ভেতর কার নাড়িভুঁড়ি গুলো যেন পাক মেরে গলার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। উর্মিলার চোখের নিচের রক্ত জমাট বাঁধা কালশিটে দাগ টা যেন এই সমাজের বুকে তাদের ব্যর্থতার কথা মোটা হরফে লিখে দিচ্ছে। ওর গলায় যে লালের পোঁচ পরেছে ওটা যেন আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞেস করছে সাত চড়ে রা কার তো না বলেই কী সে লক্ষ্মীমন্ত ছিল? যদি তাই হয় তাহলে এর বিচার কে করবে? কাদের শাস্তি দেওয়া হবে এই জন্য? প্রত্যেকেই যে সমান দোষে দোষী। তার মতো কত মেয়েকে রোজ এই পোড়া দেশে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হয় ঘরোয়া সহিংসতার জন্য। আচ্ছা এই লাশগুলোর হিসেব কে রাখছে? অপরাধগুলো কোন খাতায় নথিবদ্ধ করা হচ্ছে? বিচারের বাণী আজ নীরবে নিভৃতে কাঁদছে! বার বার প্রশ্ন করছে মানুষের শাস্তি দেওয়া গেলেও মানসিকতার শাস্তি দেওয়া যাবে তো?



Post a Comment

Previous Post Next Post