আকাশের অশ্রু যখন তীর রূপে মাটি স্পর্শ করে দুকূল প্লাবিত হয় তখন মানুষ একটু বাচবার জন্য সাপকেও বুকে জড়িয়ে ধরে। পা হীন মানুষেরা বুকে ভর দিয়ে ভগ্ন শরীর টাকে ঠেলে ঠেলে ভিক্ষা চায়। লক্ষ্মী দেবী সেই সকল মানুষের ঘরে সদা বিরাজিত। তবু দু পয়সার বিষ খেয়ে কেউ ই পাপিষ্ঠ দেহকে শেষ করার চেষ্টাও করে না। অদৃষ্ট কখন কার আত্মাকে শরীর থেকে ছিনিয়ে নেয় তা কেউ জানে না। ----- এইসব কথা ভাবতে ভাবতে দু ফোটা চোখের জল বেরিয়ে এল গোপালী বাউরির।
গোপালী বাউরির ছেলে বিশ্বম্ভর, ঘরের খুটিতে ঠেস দিয়ে লণ্ঠন জ্বেলে কঠিন নামতা গুলি মুখস্ত করছিল। আচমকা বাতাস আসায় লণ্ঠনের শিখা সঙ্কীর্ণ হয়ে আবার স্বমহিমায় জ্বলে উঠল। দশ বারো বার নিভে গেলে গোপালী বাউরি উনার থেকে শুকনো পাতা দিয়ে জ্বেলে দিল লণ্ঠন টি। আর যাতে নিভে না যায় তাই বিশ্বম্ভর দুহাত ছড়িয়ে আগুন শিখাকে টিকিয়ে রাখল।
ছেলে হবার আগেই গোপালীর বর, ছেলের নাম বিশ্বম্ভর রেখেছিল। আর গোপালীকে দ্বিপাশ্রী নামে ডাকত। দ্বিপাশ্রী মানে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের সৌন্দর্য ---- তা ভেবে মনে মনে বরের নাম মুখে নিয়ে গোপালী খুব হাসত।
বিশ্বম্ভর তখনও আগুনের শিখাকে জীবন্ত রেখে সুর করে নামতা পড়ছিল। সেই নামতার সুরে গোপালীর ভাবনা গুলি আরও সুরেলা হয়ে উঠল। মাটির উনানে ভাত বসিয়ে গোপালী স্বস্তি পেল দাউদাউ আগুনের শিখায়। তার চির তৃপ্তির স্বাদ চোখ দিয়ে বয়ে চলল অঝোরে।
বাতাসের বিনা গতিতেই বিশ্বম্ভর লণ্ঠনের আগুন শিখাকে আর টিকিয়ে রাখতে পারল না। উদরের খাদ্য ক্রমশ শেষ হতে হতে শিখাও সঙ্কীর্ণ হয়ে নিভে গেল।
স্তব্ধ চারিদিকে আধার নেমে আসল। উনানের ক্ষীণ আলোয় বিশ্বম্ভর লণ্ঠন থেকে নির্গত ধোঁয়া লক্ষ্য করতে লাগল। এক দৃষ্টিতে চাওয়া চোখ দুটিকে বিরাম দিয়ে স্বল্প সময়ে একবার চোখ বুজে আবার তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে বিশ্বম্ভর তার মায়ের দিকে চেয়ে রইল।
উনানের আগুন শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে পরছে। শিখা ক্রমে দীর্ঘায়িত হয়ে গোপালীর গোলাপি মুখ খানা লাল করে আবার সঙ্কীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘায়িত আগুনের শিখায় গোপালীর চোখের জল চকচক করতে লাগল দেখে বিশ্বম্ভর রুগ্ন পদে এসে নীরবে মায়ের কোলে বসে পড়ল।
বিশ্বম্ভর নরম হাতে মায়ের চোখ দুটি মুছিয়ে দিয়ে বলল -- বাবার কথা মনে পড়ছে তোর! ওর কথা কেমন মনে করিস। আমাদের ছেড়ে কতদিন আকাশের দেশে চলে গেছে। আমাদের কথা মনেই করে না। ও আমাদের ভালোবাসে না মা। তুই বলেছিলি একদিন ঠিক ফিরে আসবে। আমার অসুখ হয়েছে একটি বার আমায় দেখতেও এল না। ও আমাদের কেউ হয় না।
গোপালী সজোরে ছেলের মুখ চেপে ধরে বলল --- এমন কথা বলতে নেই বাবা।
কপালে গালে চুম্বন করে বিশ্বম্ভর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল ---- তবে সে আসে না কেন মা! আমি যে তারে একটি বারও দেখিনি। গোপালী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল ----- তোর বাবা আমাদের ছেড়ে বহুদূরে যুদ্ধ করতে গেছেন। তারার দেশে। অনেক বড় যুদ্ধ। মাথায় টুপি পায়ে জুতো হাতে বন্দুক
গোপালীর চোখের জল চোখেই শুকিয়ে গেল। একমুখ হাসি নিয়ে বলল --- তারাদের দেশে যে ভগবান থাকে। অসুর দের হাত থেকে ভগবান দের রক্ষা করতে হবে যে।
বিশ্বম্ভর কল্পনার জগতে প্রবেশ করে বলল ---- আমার বাবা ভগবানের থেকেও বড়। ভগবান যুদ্ধ করতে পারেন না?
গোপালীও ছেলের কল্পনা ক্ষেত্রে হারিয়ে গেল। বলল --- ভগবান যুদ্ধ করেন না। ভগবান যখন কাউকে ডেকে পাঠান তখন সবাইকেই যেতে হয়। তারাদের দেশে কারো চোখের জল ফেলতে দিতে নেই।
ছেলে বিন্দু মাত্র বিলম্ব না করে বলল ---- বাবা আমার মায়ের চোখের জল মুছাতে এল না তো।
গোপালী ছেলের কৌতূহল কে প্রশমিত করে বলল --- তোর বাবা ঠিক ফিরে আসবেন।
বিশ্বম্ভর মায়ের কথা শুনে স্বস্তি পেল। মনকে একটুও নিশ্চিন্ত করতে পারল। যেন কোনও দায়িত্ব জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের মাথা থেকে দায়িত্বের বোঝা নামল। ভাবটা তার এমনই ছিল।
মায়ের কোলে শুকনো পাতা নিয়ে খেলতে খেলতে বিশ্বম্ভর বলল --- আমিও বাবার মত অনেক বড় সৈনিক হব, অনেক ভালো যুদ্ধ করব, তাহলে বাবার মত আমাকেও ভগবান ডেকে পাঠাবে।
কল্পিত খুশির পরিবেশ ভেঙে গেল। গোপালী বলল --- তোকে কিছূ হতে হবে না। তুই শুধু আমার কাছে থাকবি। তুই দূরে চলে গেলে আমি বাচব কেমন করে।
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে গোপালী কেদে ফেলল।
বিশ্বম্ভর স্তব্ধ হয়ে গেল। ক্ষুদ্র বালকটি হয়তো সব কিছু নিজের মত করে বুঝে নিল। নিজেকে স্থির রেখে মায়ের চোখ মুছিয়ে বলল ---- বাবা তোকে খুব ভালোবাসত?
গোপালী যেন নিজের মনের কথা শোনানোর মত একজন সঙ্গী পেল। বিপুল উৎসাহে বলল --- খুব ভালোবাসত। কত উচুঁ বংশের ছেলে। আমরা ছোট জাত। তাই বলে কখনও দূরে সরাইনি আমায়। পাশের গ্রামের রাঙা পূজোর মেলা থেকে আমায় রামধনু হার এনে সাজিয়ে দিত। যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় কত খাবার কত কাপড় গয়না এনে দিত। আমি খুব খুশি হতাম।
বিশ্বম্ভর চুপ করে মায়ের কথা শুনছিল। আর স্থির থাকতে না পেরে বলল --- বাবা যখন আসবে আমার জন্য কি আনবে? বাবা জানে আমি এসেছি আমার জ্বর হয়েছে!
গোপালী বলল --- তোর বাবা সব জানে। তুই এসেছিস,তোর জ্বর হয়েছে সব জানে। আর আসার সময় তোর জন্য অনেক খেলনা আনবে।
মায়ের স্নেহাদোরে বিশ্বম্ভর চিরসুখ অনুভব করল। মায়ের কোলই তার একমাত্র সম্বল। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল ---- মা, গ্রামের চৌধুরী বাড়িটা নাকি আমাদের। লোকে যে বলে আমায়। কত বড় বাড়ি, কত লোক থাকে। কত আলো জ্বলে। কত উচুঁ ঘর। বাইরে থেকে দেখায় যায় না। তবে তুই গ্রামের শেষে ঘর করে আছিস কেন। ওরা তোকে ডাকে না মা?
বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে গোপালী বলল --- আমরা জাতে নীচু কিনা। তাই ওরা ডাকে না। বিয়ের পর তোর বাবাও ঘর ছেড়েছে। পরে সবাই মেনে নিয়েছিল আমায়। আমরা ওই বাড়িতেই থাকতাম। তোর বাবা চলে যাবার পর ওরা আমাদের আর রাখল না।
গোপালীর চোখের জল অবাধে বেড়িয়ে আসল।
বিশ্বম্ভর বলল --- কাদিস নে মা। আমি তোর সব কষ্ট মুছে দেব। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঈষৎ উষ্ণতা অনুভব করল গোপালী। বলল --- তুই তো আমার সাত রাজার ধন মানিক।
মায়ের কোল থেকে উঠে বিশ্বম্ভর বলল --- কিছু খেতে দে। খিদেয় পেট চো চো করছে।
চমকে উঠল গোপালী। ছেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন যে ভাত পুড়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে তার খেয়াল নেই।
বিশ্বম্ভর ঘর থেকে জল এনে হাড়িতে দিয়ে দিল। বাকি জল টুকু পেট ভর্তি করে খেয়ে ঘরের মাদুরের এক প্রান্তে শুয়ে পড়ল। পরিস্থিতি মানুষ কে কত পরিণত করে দেয়।
গোপালী নিশ্চল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল --- জানি তুমি কখনও আসবে না। সব কিছু ছেড়ে তোমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছা হয়। শাড়ির আচল ধরে বিশ্বম্ভর আজও ঘুমায়। তবু মন চায় নিশ্চিহ্ন পৃথিবীর বুকে তোমার অমৃত লাভ করতে। তোমার আলিঙ্গনে আমার সুখ। আমি আজও তোমার অপেক্ষায়------।
উত্তরের ঝোড়ো বাতাস সমগ্ৰ মনকে শীতল করে দিল।
