ঘুঙুরের ছন্দ : সহেলী মল্লিক


  

-এ কী! তুমি! তুমি কখন এলে?

– কেন আমার বুঝি আসতে মানা?

-আসতে মানা কীনা ওত শত জানিনা, তবে তুমি পাঁচ পাঁচটা বছর পর আবার ফিরে এসেছে! এটা মেনে নিতে পারছি না।

– ও.. না ফিরলেই বুঝি ভালো হতো?

-তুমি তোমার পৈত্রিক বাড়িতে ফিরবে কী ফিরবেনা, সেটা একান্তই তোমার ব্যক্তিগত ব্যপার। আমার এখানে কথা বলা কী সাজে?

– আজও বুঝি রেগে আছো?

-রাগ টা ঠিক তার ওপর করা যায় যার ওপর অধিকার থাকে, ভালোবাসা থাকে। তোমার ওপর কোনো অধিকার নেই।

– আর ভালোবাসা?

-জানিনা।

– ও.. আমাকে আর ভালোবাসনা! অবশ্য ভালোবাসবে কেন! মাঝপথে যে হাত ছেড়ে চলে যায় তাকে কী ভালোবাসা যায়? ঘুঙুর তবে কী তুমি আমায় মন্দবাসো?

-মন্দবাসা ঠিক কেমন জানি না, তবে তোমায় নিয়ে আর ভাবি না।

– এ কী! আবার মাথা ব্যথা? আদা চা খাবে? আমি বানিয়ে দেবো?

-না…থাক। মাথা ব্যথা হলে আদা চা খাওয়ার অভ্যেস টা আর নেই। এখন পেনকিলার এ কাজ চালিয়ে নিই। আদা চা করে দেবার মানুষটাই যখন আর পাশে নেই, তখন ওই বিশ্রি বেদনাদায়ক অভ্যেস টা না থাকায় ভালো।

– জানো আজ কলেজে গেসলাম। ওই গাছটা আজও একই ভাবে আছে, যেটাতে লেখা আছে 'ঘুঙুরের ছন্দ '।

-ভুল লেখা আছে। ঘুঙুরের ছন্দ থাকতে পারে না। ঘুঙুরের আছে বুক ফাটা কান্না, বিষাদ, যন্ত্রনা। হ্যাঁ হ্যাঁ শুধুই যন্ত্রণা।

– ঘুঙুর…

-কী বলবে বলো?

– তোমার মনে আছে সমাজের সমস্ত বেড়া অতিক্রম করে আমরা একে অপরকে ভালোবেসেছিলাম। আমি মুসলিম ছন্দ আলি রহমান আর তুমি ব্রাহ্মণ ঘুঙুর চ্যাটার্জী। আমরা একে অপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু…

-পাশে থাকতে পারলে না,তাই তো? আjমি তো জানি সে কথা।

– খুব কষ্ট পেয়েছিলে?

-না কষ্ট মানুষের পায় পাথর না। তাছাড়া যখন কোন কিছুর ওপর আর এক বিন্দুও আশা থাকে না, তখন কষ্ট আসেনা। সে যাক গে শুভ জন্মদিন।

– তোমার মনে আছে?

-আমি কোন কিছুই সহজে ভুলি না, এটা তো তুমি জানো। আমার স্মৃতিশক্তি বরাবরই প্রখর। আমার আজও সব মনে আছে সব!

– জানো ঘুঙুর, আজ পাঁচ পাঁচটা বছর হয়ে গেল আর মনে করিয়ে দেয়না জন্মদিন বলে। কেউ আর মাঝরাতে আমার জন্য surprise birthday party arrangement করে না। কেউ আর জোর করে না পূর্ণিমা তে চাঁদের জোছনার ছাদর জড়িয়ে ঘুমানোর জন্য কিংবা কুয়াশার ভীরে মুঠো ভরে রোধ ধরার জন্য। জানো ঘাসের ওপর দিয়েও হাঁটা হয়নি বহুবছর,  শিশিরে ভেজানো হয়নি পা। এমন একটা দিন ছিলোনা যেদিন তোমাকে আমার মনে পড়েনি। কতবার তোমাকে ফোন করেছি তুমি একটিবারও ফোন তোলোনি! বিরিয়ানি টাও কতকাল খাইনি, তুমি তো জানো তোমার থেকে আলুটা মারপিট করে ছিনিয়ে না খেলে বিরিয়ানি খেয়ে মজা নেই। 

      বুঝলে ঘুঙুর আমিই তোমাকে আগলে রাখতে পারিনি! তোমাকে আপন করে রাখতে পারিনি! সত্যি বলতে তোমার মতো কেউ নেই যে এই অগোছালো আমিটা সুন্দর করে পরিপাট্য করে গুছিয়ে রাখে। আবার নতুন করে তোমাকে সাথে নিয়েই জীবনটাকে শুরু করব বলে ফিরে এলাম কিন্তু…

-কিন্তু আবার মত বদলালে তাই তো? 

– ঠিক সেটা না ঘুঙুর। আমরা তো জীবনে অনেক কিছুই চাই সব কী পাই? আবার কোন কোন জিনিস না চাইতেও একনিমেষে পেয়ে যাই। যদি জীবনে যা যা চাইতাম সবই পেতাম তাহলে জীবনে দুঃখ থাকত না। আর দুঃখ না থাকলে অনুভূতি থাকত না। কেননা সুখের বিন্দু বিন্দু অনুভূতির উৎসস্থল তো ওই দুঃখ। আমি তো নকল সুখকে ধরতে গিয়ে আসল সুখকে হারিয়ে দুঃখসাগরে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলেছি। সাঁতরে পাড়ে ওঠার অনেক চেষ্টাই করলাম কিন্তু পারলাম না! আসলে সাঁতরে যে সাগর পার সম্ভব নয় তা ভুলে গেসলাম। হয়ত ধীরে ধীরেই সাগরে তলিয়ে যাবো।


– কী হলো ঘুঙুর চুপ কেন? ফোন বাজছে ফোনটা তোলো…

-অ্যা.. হ্যাঁ

— ওই খবরটা শুনলি?

-কী খবর?

— আরে সেই আমাদের কলেজে একটা মুসলিম ছেলে পড়ত, আরে ওই যে ছন্দ। যার জন্য হোস্টেলের পাঁচিল টপকাতে গিয়ে তুই গার্ড দিদিদের কাছে ধরা পড়েছিলিস, তারপর বাব্বা সারারাত মাঠে বসে কী কান্ড টাই না করতিস। বিরিয়ানি নিয়ে তোদের তো ন্যাকামির শেষ ছিল না…

-তুই কী এইসব বলার জন্য ফোন করেছিস?

— আরে না.. ঠিক সেইজন্য না। হ্যাঁ রে আমি না অনেকদিন আগে শুনেছিলাম তোর সঙ্গে নাকি ওর বিয়েও হয়েছিল, তারপর তোকে রেখে দুবাই চলে যায়। সেখানে কী কী কান্ড করে বেরিয়েছে কে জানে বাবা …

-ইন্দু..

— আমি জানি জানি তোদের মধ্যে আর কোন সম্পর্ক নেই, তুই ওকে আর ভালোবাসিস টাসিস না।

-তোর কথা বলা শেষ, আমি তাহলে ফোনটা রাখছি।

— আরে শোন না…আমাদের কলেজের সামনে যে বড়ো ছাতিম গাছটা আছে তাতে আজ বিকেলে accident করেছে, একদম সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছে। কী করে যে এটা হলো কেউ না কিছু বুঝতে পারছে না। তবে হ্যাঁ জানিস তো যেমন কর্ম তেমন ফল। তুই তো কত ভালোবেসেছিলিস আর কী করল তোকে ফেলে রেখেই চলে গেল। এটাই তো হবার ছিল। হ্যালো হ্যালো তুই কী শুনতে পাচ্ছিস? যা কেটৈ দিলো!

– লাল আলতা পায়ে ঘুঙুরের ছন্দ কিন্তু বেশ লাগে। এজন্মে আর ভুল শুধরানোর সুযোগ পেলাম না! পরজন্মে… না না এ আমি কী বলছি! এই জন্মের মতো তোমার পরজন্মটাকেও নরক যন্ত্রনাতে ভরিয়ে তুলতে পারবো না। তুমি তোমার মতই সুখে থেকো।

   তুমি কাঁদছো ঘুঙুর? কেঁদো না আমার জন্য তোমার চোখের মতি আর ঝড়িও না।

-কেন আমাকে ফেলে চলে গেলে ছন্দ? কেন আমার কাছে আগে ফিরে এলে না? কেন চোখের জল ঝড়তে ঝড়তে আজ একটা আস্ত পাহাড় চোখের কোণে, তুমি সেই পাহাড়ে খুশির ঝর্ণা তৈরি করতে এলে না? কেন আমায় ভালোবাসলে না আমার মতো করে? কেন কেন কেন?

– আমি তোমায় ভালোবাসি তো আজও ঠিক একই ভাবে। আমি জানি তুমি এ যন্ত্রণা টাও ঠিক সামলে উঠতে পারবে।

-হুম…, আমাকে দেবার জন্য তোমার কাছে তো ওই একটাই অমূল্য রত্ন আছে যন্ত্রণা! 

– ঘুঙুর  ঘুঙুর…

-অ্যা..

–আমি তবে আসি? কী হলো কিছু বলবে না?

-হ্যাঁ বলব তো, বলব।

     " ছন্দ থাকুক চোখের পাতায় 

       ছন্দ থাকুক গানে,

       ছন্দ থাকুক ঘুঙুরে 

       ছন্দ থাকুক মোর প্রাণে। 

       ছন্দ থাকুক স্বপ্নেতে 

       ছন্দ থাকুক মনে,

       রইল না শুধু ভাগ্যে ছন্দ 

       রইল না এ পোড়া জীবনে।।"


_ ও..  দিদিমনি সকাল হলো উঠে পড়ো কেনে?

   এ.. কী! দিদিমনি তো সারা দিচ্ছে লা বটে! এটা কী হয়ে গেল.. গো! ( কান্নায় ফেটে পড়ে)

          এমন সময় হঠাত ছম ছম শব্দ শোনা গেল ওই বুঝি ঘুঙুর তার ছন্দ ফিরে পেয়েছে। হ্যাঁ লাল আলতা পায়ে ঘুঙুরের রিনি ঝিনি ছন্দ কী যে ভালো লাগে, বলুন? ঘুঙুরের ছন্দ না থাকলে চলে? না.. না… একদমই চলে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post