তীর্থঙ্কর আজ প্রায় ছ'বছর পর নিজের গাড়িতে করে ছোটকাকে নিয়ে বইমেলায় এলো। সজলকে বলাই ছিল সে কার পার্কিংয়ের কাছাকাছি ছিল। এগিয়ে এসে গাড়ি থেকে হুইল চেয়ারটা নামিয়ে আনলো। ততক্ষণে তীর্থঙ্কর ছোটকার কোমর থেকে সিটবেল্টটা খুলে ফেলেছিল। ব্রজকিশোরকে সাবধানে কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়ে যত্ন করে হুইল চেয়ারে বসিয়ে হুইলচেয়ারে বসা ছোটকাকে নিয়ে নিজের স্টলের দিকে এগিয়ে গেল। শীতের বাতাসে রক্ত,মাংস,চামড়া হীন অস্থির অভাবে ব্রজকিশোরের পায়ের দিকের সূতীর পাজামা পতপত করে উড়ছিল। বইমেলার অনেক মানুষ তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথ ফাঁকা করে পাশে সরে দাঁড়িয় পরেছিল,কেউবা অটোগ্রাফ নেওয়ার তাগিদে কাঁধের ব্যাগ হাতরাচ্ছিল।
সরল,সাধাসিধে আর সদাহাস্য ব্রজকিশোর দত্ত সুবর্ণবণিক। বৌবাজারে মাঝারি আকারের সোনার দোকান ছিল। মানুষের কাছে সোনার কদর যে কতোখানি সোনার ব্যাবসায়ীরা তা ভালো করেই জানেন। শুধুমাত্র বাঙালির ঘরে নয় সব মানুষের ঘরেই এর কদর। এককালে মানুষের হাতে একটু পয়সা এলে একটু সোনা কেনা ছিল প্রধান কাজ।এখন সে রকমটা না হলেও বিয়ে,প্রেম,পূজা পার্বনকে কেন্দ্র করে সোনার ব্যবসা রমরমা হয় বইকি। উল্টো দিকে অভাবের পরিবারে ঘরের মহিলাদের অঙ্গ কিংবা পুটলি থেকে এক এক করে অলঙ্কার বিক্রি হতে আসে তাদের কাছে কিংবা বাঁধা পরে মহাজনের ঘরে। এছাড়া প্রায় দিনই পুরনো সোনা গলিয়ে নতুন ডিজাইনের গয়না গড়ার বায়না আসে কিংবা পালিশের ফরমাস জোটে। মন্দ চলেনা স্বর্ণকারের ব্যবসা। ব্রজকিশোরের ব্যবসাও বেশ ভালোই চলতো। দোকান সামলানোর সাথে সাথে কখনো সখনো কারিগরদের সাথেও হাত লাগাতেন তিনি। ছোট্ট তীর্থঙ্করকে রেখে প্রথমে বৌদি তারপর দাদা মারা গিয়েছিলেন তখনও বাবা বেঁচে ছিলেন।মায়ের আমলের রাতদিনের কাজের লোক সারদা পিসিও ছিল সে সংসারে। হঠাৎ ভেঙ্গে পরা এই সংসারে যদ্য যুবকের ভরসায় এবং তাগিদে বয়স্কা সারদা পিসি আর বৃদ্ধ বাবা ওই পিতৃমাতৃহীণ শিশুকে সামলানোর মতন ভরসা পেয়েছিলেন। বাবার আব্দারে আর নিজের উৎসাহে মাঝে মাঝেই দোকানে খদ্দের কম থাকলে ব্রজকিশোর কলেজস্ট্রীটে গিয়ে 'ছেলে ভুলানো ছড়া' থেকে শুরু করে অনেক রকম বই সংগ্রহ করতেন। রাতে বাড়ি ফিরে ব্রজকিশোর ছোট্ট শিশুকে নিজের হাতে সামলাতেন, নিজের পাশটিতে নিয়ে শুতেন। ছোট্ট সোনাকে তুষ্ট করার জন্য সে বুঝুক না বুঝুক উচ্চ স্বরে নানান মুখভঙ্গিমা করে তাকে বই পড়ে শোনাতেন। ছোট্টটা রঙিন বই আর ছোটকার ঠোঁট নাড়া দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পরতো। তাকে অনেক যত্নে করে বিছানায় শুইয়ে অনেকক্ষণ ধরে সস্নেহে তার ঘুমন্ত চাঁদ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন ব্রজকিশোর। তারপর শরৎচন্দ্র কিংবা রবীন্দ্রনাথের বই খুলে পড়তে পড়তে একসময় তাঁর নিজের চোখে ঘুম নেমে আসতো।
বাবা-মা দাদাকে ডাকতেন বড়খোকা বলে আর তাঁকে ডাকতেন 'ছোটোখোকা'বলে। বয়স্কা সারদা পিসিও 'ছোটখোকা' বলেই সম্বোধন করতেন। ছোট্ট তীর্থঙ্করের যখন বুলি ফুটলো তখন তাঁদের ডাক নকল করে যখন 'ছোটখোকা'বলে ডাকার চেষ্টা করতো তখন বাবা শিখিয়েছিলেন ওই 'ছোটকা' ডাকটা। সেই দিনগুলোর কথা মনে পরলে আজও ব্রজকিশোর নীরবে হাসেন। পিতৃমাতৃহীন সেই ছোট্ট ছেলেটাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রাখার মধ্যে যে কি সুখ ছিল তা তিনি আজও অনুভব করেন। পুরানো সেই জমজমাট সংসারে, নিজের নতুন যৌবনকালে, বিয়ে করে সংসার বাঁধার ইচ্ছা থাকলেও মা আর বৌদির মৃত্যুর পর সে স্বপ্ন যে কবে মনের অন্দর মহল থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল তা আজ আর ব্রজকিশোরের মনে পরেনা।
মল মাস হলে দুপুরে সোনার দোকানগুলোর খদ্দেরের সংখ্যা বেশ কম থাকে। সন্ধ্যেবেলা কিংবা ছুটির দিন গুলোতে খদ্দেররা ভীড় জমান। বছর দশেক আগে এমনই এক দুপুরে দোকানে একদল ছেলে মুখে কালো কাপড় বেঁধে তার দোকানে ঢুকেছিল। ব্রজকিশোর সে সময় ঠাণ্ডা পানীয় খেতে দোকান থেকে বেড়িয়েছিলেন। দোকানে ফিরে কাঁচের দরজা ঠেলে বুঝেছিলেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বেশ কয়েকবার দরজার বাইরে ধাক্কা মেরে কর্মচারীদের নাম ধরে ডাকাডাকি করাতে দুটো ডাকাত ছোকরা দরজা ফাঁক করে তাঁর কাঁধ ধরে দোকানের মধ্যে টেনে ঢুকিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। ব্রজকিশোর দেখেছিলেন কাঁচের দরজা দেওয়া ছোট্ট চতুষ্কোণ দোকানটার তছনছ্ অবস্হা! দেখেছিলেন, তারই এককোণে মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা আর হাত পা শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে মেঝেতে জড়সড় হয়ে বসে থাকা চারজন কর্মচারীর করুণ অবস্থা।স্বর্ণ অলঙ্কারে সজ্জিত দোকানে শোকেসে সাজানো আসল-নকল কোন অলঙ্কারের চিহ্ন মাত্র নেই।
একজন ছোকরা অলঙ্কার ভরা ব্যাগের চেন টেনে কাঁধে তুলতে তলতে বললো,-" আমাদের মিশন কমপ্লিট, এখন আর এই লোকটাকে বাঁধা ছাঁদা করতে গিয়ে সময় নষ্ট করিস না,দুটো পায়ের মালাইচাকিতে দুজনে মিলে বেশ কটা করে গুলি করে চিরজীবনের মতন বেটাচ্ছেলের চলার শক্তি নষ্ট করে দে,তাহলে,আমারা বেরোলে কোন থানা কিংবা পুলিশের কাছে পৌঁছনোর জন্য পায়ে হেঁটে ছোটোছুটি করতে পারবে না।" -"তবে তাই হোক"শব্দে সমবেত উল্লাসধ্বনির সাথে সাথেই "মিশন জিন্দাবাদ" শব্দটা শুনতে শুনতে ব্রজকিশোর দত্ত মাটিতে লুটিয়ে পরেছিলেন।
তার পরের ঘটনাগুলো খানিকটা স্মৃতিপটে আঁকা থাকলেও ব্রজকিশোর আর তা মনে করতে চাননা।তবে পরবর্তীতে তার শরীর থেকে দুটো পা বাদ যায়। পাহীন পঙ্গু মাুনুষটা নিজেকে প্রায় গৃহবন্দী করে ফেলেন। ভাইপো তীর্থঙ্করকে আর সোনার ব্যবসার ধারে কাছে যেতে দেননি। পড়াশোনায় ভালো ছেলেটা তার কাকার পরামর্শে কলেজস্ট্রীটে এক বই প্রকাশনার সংস্থা খোলে। শুরু থেকে ধাপে ধাপে নানান সমস্যার সন্মুখীন হয়েছে তীর্থঙ্কর,আবার বুদ্ধিবলে সেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টাও করেছে। এইভাবে একটু একটু করে যে অভিজ্ঞতা সে সঞ্চয় করেছে তারই ফলস্বরূপ আজ তার প্রকাশণ সংস্থা সফলতাকে ছুঁয়েছে।।
-"আজকালকার আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনেক কিছুই করা সম্ভব ছোটকা...।" তীর্থঙ্করের নিত্যকারের এ উপদেশকে নস্যাৎ করে দিয়ে ছোটকার একই উত্তর ভাঙা রেকর্ডের মতন বেজে ওঠে,-"জানি তো অনেক কিছুই সম্ভব।নৌকা ফুটো কিংবা ভাঙা তাই বলে কি মাঝি হাল টানা ছেড়ে দেবে! আরে আমার পাদুটোই না হয় নেই কিন্তু হাত তো আছে,আমি এই হুইল চেয়ারে বসে আমার হাতকে প্রাধান্য দিতে চাই এই কথাটা আর কতবার বলবো তোকে....তীর্থ?"
--"ছোটকা,আমি জানি তুমি শিল্পি মানুষ, সারা জীবনে ছোট-বড় অনেক অলঙ্কারে নিখুঁত নকসা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছো কিন্তু তোমার পা দুখানা ছাড়া বিধাতার গড়া 'তুমি' মানুষটা যে অপূর্ণ তা কেন বুঝতে চাও না বুঝিনা।"
-"বিধাতা দিয়েছিলেন আবার তিনিই সেটা কেড়ে নিয়েছেন।"
--"ছোটকা জীবনতো এক.....টাই..."
তীর্থের অর্ধসমাপ্ত কথার মাঝখানেই তার মুখের কথাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,-"হ্যাঁ একটাই জীবন, তাই সেই বিধাতাকে আমি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি 'ওই পায়ের সাথে এই হাত দুটোকে যখন কেড়ে নাওনি তখন তাঁর নৌকার মাঝি কেবল স্যাকড়া হয়ে হাতুড়ি ধরে থাকবে না অথবা ফুটো কিংবা ভাঙা নৌকা হয়ে মনের দুঃখে জীবন নদীর পারে বসে শুধুমাত্র তার শরীরে আছড়ে পরা ঢেউয়ের আঘাত সহ্য করার জন্যেও পরে থাকবেনা। সে অন্য নৌকার হাল ধরে নতুন তীরে ঠিকই পৌঁছাতে পারবে।"
এইভাবেই বেশ কিছুদিন দত্তবাড়িতে একই কথপোকথনের ভাঙা রেকর্ড বেজে চললো। জানুয়ারি মাসে শুরু হলো ছোটকার নতুন আব্দার
-"আমাকে বই মেলায় নিয়ে চল তীর্থ..।"
-"পা নেই তোমার,কি করে যাবে..আমার কথা শুনলে এতদিনে তুমি নিজের নাহোক নিজে নিজে নকল পায়ে অন্তত হেঁটে বড়াতে পারতে।"
-"ছেলেবেলায় তুই আমার কোলে উঠতিস মনে পরে? আমার যে এই বেলার বড় সাধ তোর কোলে চেপে গাড়িতে উঠি আর ওই কোলে চেপেই হুইল চেয়াড়ে বসি। তারপর, তুই বাপ আর আমি ছেলে হয়ে এ দোকান সে দোকান ঘুরে অ-নে-ক বই কিনি।" ব্রজ কিশোর দুহাত প্রসারিত করে বাচ্ছা ছেলের মতন 'অনেক' শব্দের অঙ্গভঙ্গি করলেন। তীর্থঙ্কর ছোটকার কথায় আর ভঙ্গিমায় না হেসে পারেনা বলে,-"ছোটকা,তুমি মনে করছো যে এ জন্মেই আমি এইভাবে তোমার ঋণ শোধ করবো! কিন্তু তা তো করবো না, আমি যে জন্ম জন্মান্তর তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চাই..আচ্ছা তুমিই বলো পিতৃ-মাতৃ ঋণ কি কখনো শোধ হয়?" মুখে যাই বলুক তীর্থঙ্কর ছোটকার মনবাঞ্ছা পূর্ণ করে। বছর দুই বইমেলায় ভাইপোর স্টলে বসে বই প্রেমীদের ভীড় পর্যবেক্ষণ করলেল ব্রজকিশোর। শুধু যে বই প্রেমীরাই এখানে ভীড় জমান তা তো নয় আসে অনেক কপোত কপোতী,স্টলের বাইরে, ফুড কোর্টে তাদের ভীড় জমায়। স্টলের উঁচু কাউন্টারে বসে মাঝে মাঝেই চোখ চলে যায় মেলার ফুড কোর্টের দিকে। কতো শিশু আসে বাবা মা কিংবা দাদু-ঠাম্মার হাত ধরে। বই চত্বরে ঢুকে তারা চঞ্চল হয়ে ওঠে। রঙচঙে বই ছাড়া কিছুই বোঝেনা তারা। শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বইয়ের টেবিলে সাজানো বই গুলোকে তারা ঘেঁটেঘুঁটে লণ্ডভণ্ড করে। ব্রজকিশোর বসে বসে দেখেন আর তাঁর স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তীর্থঙ্করের শিশুবেলা।
বইমেলা শেষে ব্রজকিশোর একদিন হাতে খাতা কলম তুলে নিলেন। লিখতে বড় সাধ হয়, দেখি এই হাতে নতুন কোনো শিল্প রচনা করা সম্ভব কিনা।"ব্রজকিশোর শুনেছিলেনর তাঁর পূর্বপুরুষের মাতামহী কিংবা পিতামহী ছিলেন কবি পরিবারের কন্যা। পরাধীনতার আমলে বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় তাঁর কবিতা স্থান পেয়েছিল। 'তাঁদের একফোঁটা গুণও যদি আমার রক্তে মিশে থাকে। দেখাই যাক না চেষ্টা করে।'মনে মনে এমনটাই ভাবেন।দিন কয়েকের মধ্যে সত্যি সত্যি লিখতে শুরু করলেন ব্রজকিশোর। দত্ত ঘরে খাতা কলমের অভাব নেই। দরকার পরলে পাশের বাড়ির ছেলেটার কলেজস্ট্রীটে' পেপার হাউস'নামে একটা দোকান আছে তাকে বলে দিলেই দিস্তা দিস্তা পৃষ্ঠা আর ডজন ডজন কলম দিয়ে যায়।। তীর্থঙ্করকে গুণাক্ষরেও জানতে দেন না তার নতুন কর্মকাণ্ডের কথা। মাস ছয়েক পরে তীর্থের হাতে তুলে দেন পাণ্ডুলিপি। বলেন,-"এই লেখা ছাপাতে চাই যা খরচ পরবে প্রকাশক মশাইকে দিতে রাজি আছি।" তীর্থঙ্কর বিস্ময়ের সাথে সেই পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে বলে -"ছোটকা কি করেছ তুমি! পুরো একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছো!বাঃ!" সেদিন অফিসে এসে মহানন্দে পাণ্ডুলিপি তুলে দেয় প্রুফ রিডার তন্ময়ের হাতে। পরের দিন তন্ময়কে প্রশ্ন করলো,-"কেমন দেখলে?" ইতস্তত করে সে উত্তর দিল-"প্লটটা ভালো কিন্তু লেখার মধ্যে বাঁধুনি,নেই বড্ড এলোমেলো।" তীর্থঙ্কর প্রশংসা শোনার আশা করেছিল কিন্তু নিজের সংস্থার প্রুফ রিডারের মন্তব্য শুনে মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও সংযত করলো নিজেকে, খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো,-"লেখক যখন খরচ করবেন তখন লেখা যেমনই হোক ছাপতে হবে...বই কি।" দিন শেষে ছোটকার শিশুসুলভ উদগ্রীব চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁকে নিরাশ করতে পারলো না তীর্থঙ্কর বললো -"ছোটকা নিশ্চিন্তে থাকো,ফাইনাল প্রুফ চেকিংটা না হয় তুমিই কোরো।এবার বলো পাঁচশো না হাজার কতো কপি ছাপবো?"ছোটকা এক লাফে হাজার কপি ছাপার খরচ করতে চাইলে তীর্থঙ্কর বললো -"নিজেদের পাবলিশিং হাউস সেখানে তুমি কেনো খরচ দেবে ছোটকা?"
-"ওরে নিজের প্রথম বই ছাপা হবে তাতে খরচ না করলে আমার আনন্দটা কিসে হবে...আর আমার এতো টাকা বাঁচিয়ে তোর লাভটাই বা কি? দেখিস কিন্তু, মলাট টা যেন বেশ ঝকঝকে হয়।"
ছাপা অবস্থায় বইটা ব্রজকিশোরর হাতে তুলে দিতেই বইটা খুলে প্রাণ ভরে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে সেই বইটাতে নিজে সই করে তীর্থঙ্করের হাতে দিয়ে ব্রজকিশোর বললেন,-"আমার লেখা প্রথম বই তোকে দিলাম তীর্থ।"ছোটকার ঝকঝকে চোখে জল টলমল করতে দেখে তীর্থ ছোটকাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরলো। সেবার তীর্থের কোল,গাড়ি আর হুইল চেয়ারকে বাহন করে প্রথম দিনই বইমেলায় সারাটা দিন কাটালেন ব্রজকিশোর। ডিসপ্লে র্যকে, স্টলে সাজানো কাঠের তাকে অন্যসমস্ত বইয়ের সাথে নিজের নাম লেখা ঝকঝকে বইগুলো প্রাণ ভরে দেখলেন। সারাদিনে কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে সেই বই কিনলো। নতুন প্রজন্মের হাতে নিজের লেখা বই দেখে বজকিশোর মনে মনে খুশী হলেন। কিন্তু তীর্থঙ্কল বুঝলো এই অল্পবয়সী ছেলে মেয়েগুলো বই বা লেখক সম্পর্কে অনভিজ্ঞ তাই এরা শুধুমাত্র বাড়িতে বয়স্কা মানুষেকে উপহার দেওয়ার জন্য সেই বই কিনলো।
-"আজ কটা বই বিক্রি হলো?"সেই থেকে নিত্য তীর্থঙ্করকে এই প্রশ্ন করতেন ব্রজকিশোর। তীর্থঙ্করের উত্তর ছিল আজ দুটো কিংবা পাঁচটা কিংবা দশটা ইত্যাদি। প্রায় ছয় মাস পর ছোটকার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে সে বললো-"এই নাও ছোটকা তোমার দুশোটা বই বিক্রির টাকা..তবে সমান দামে বিক্রি হয়নি। আমাদের স্টল থেকে দশ পার্সেন্ট ছাড় দিতে হয়েছে আর বুক সেলাররা কিনেছেন চল্লিশ পার্সেন্ট ছাড়ে। ব্রজকিশোরের সারল্য মাখানো মুখটা শিশুর মতন হেসে উঠলো।বল্লেন,-" তীর্থ আজ আমি তোর কোলে চেপে রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো।"তীর্থ মাথা নাড়ে,-"উঁহু,আজ তো শুক্লামাসীর রান্না হয়ে গেছে।বাড়িতে এতো খাবার থাকতে রেস্টুরেন্টে যাই কি করে ছোটকা!"
--"কোথায় ভাবলাম তোর কোলে চেপে...."
-"হ্যাঁ,আজ তোমাকে আমার কোলে চাপিয়ে এখান দেকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যাবো আর ওখানে চেয়ারে বসিয়ে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেবো।"ছোটকার কথার মাঝখানে তীর্থঙ্কর বলে উঠলো। ব্রজকিশোর বললেন,-" ও সব খাবার সকালে শুক্লাকে নিয়ে যেতে বলবি নয় ফেলে দিতে বলবি আজ আমি রেস্টুরেন্টেই যাবো।" তীর্থঙ্কর তার প্রিয় ছোটকার এই ছোট্ট শিশুর মতন আব্দার খুব পছন্দ করে আর সেই আব্দার শোনার লালসায় ছোটকার বায়নাকে এতো বুঝিয়ে নানান অজুহাতে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে। তবে মনে মনে সে অবশ্যই জানে শেষ পর্যন্ত ছোটকার বায়নার কাছে তাকেই হার মানতে হবে।আজ ছোটকার বায়না দেখে তীর্থঙ্করের দুই চোখ জলে ভরে উঠলো, ছোট্টছেলেরা বায়নার সাথে সাথে পা দাপকায় কিন্তু এই নিষ্পাপ মানুষটার পা দুটোই নেই। আদর করে ছোটকাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চোখের জল আড়াল করে সে বললো,-"তাই হবে ছোটকা, চলো তোমাকে সাজিয়ে দি।'
--"সাজাবি কিরে!"
-"বাঃ আমার ছোট্ট খোকা রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে, একটু সাজুগুজু করবে না!" ছোটকার গাল দুটো আলতো করে টিপে ধরলো তীর্থঙ্কর।
কয়েকদিনের মধ্যে ছোটকা তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তীর্থঙ্করের হাতে তুলে দিলেন। প্রুফ রিডারকে তীর্থঙ্কর বলে দিল -"কোনো মন্তব্য করবে না। লেখক সব টাকা অগ্রিম দিয়েছেন যখন, তখন লেখা যেমনই হোক বই ছাপা হবে।" সজলক বললো -"হাজার কপির ব্যবস্থা করো। এবারেও নতুন বইয়ের একখানা ছোটকার হাতে তুলে দিয়ে
ছোটকার খুশীতে উজ্জ্বল মুখখানা প্রাণ ভরে দেখলো সে। এইভাবে বছর পাঁচেক ছোটকা নতুন নতুন উপন্যাস লেখায় ব্যাস্ত থাকায় আর 'কলকাতা বইমেলা'য় যাওয়ার বায়না করলেন না। বরং বললেন, -" আমাকে কিছু নতুন-পুরাতন বিখ্যাত লেখকদের বই এনে দিস। যখন লিখতে লিখতে হাত ধরে যায় তখন ওগুলো পড়বো।" প্রতি বছর একটা করে বই প্রকাশ করার নেশা ব্রজকিশোরের মাথায় চেপে বসেছে। মানুষটা যেন ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠছেন। আগেকার মতন অল্পেতে উচ্ছাস প্রকাশ করেন না, তাঁর হাবে-ভাবে কেমন যেন গাম্ভির্যতা প্রকাশ পায়। তীর্থঙ্কর বলে,-" ছোটকা হাতকে বিশ্রাম দাও। ধীরে সুস্থে লেখো পাবলিশার তো তোমার ঘরেই আছে...চিন্তা কি।"ছোটকা বলেন,
-" জীবনটাতো ধীরে সুস্থেই কাটিয়ে দিলাম তীর্থ। নিজে বিয়ে করিনি বলে তোর বিয়ে নিয়েও ভাবনা চিন্তা করিনি,তোর বিয়ে করতে সাধ হয়না? আমার জীবনে তুই ছিলিস আমার একমাএ ভাবনা। শুধুমাত্র তোকে নিয়েই ছিল আমার সাধ আল্হাদ। তাতেই ছিলাম অভ্যস্ত।এখন তোর কথা জানতে চাই, তোর জীবনে যদি কেউ থাকে তাকে আনার ব্যবস্থা কর তীর্থ।"
তীর্থ মৃদু হেসে ছোটকার পাশটিতে বসে তার বাঁহাত দিয়ে ছোটকার বাঁ কাধ জড়িয়ে ধরে বলে,-" তোমার জীবনে যেমন আমি ছিলাম তোমার সর্বস্য তেমনই এখনও আমার জীবনে তুমি আমার সর্বস্য...আর....তাই বিয়ে করার কথা ভাবিনি। যখন ভাববো তোমায় নিশ্চয়ই বলবো ছোটকা।"
এরপর থেকে প্রতি বছর ছোটকার হাতে বই বিক্রির নাম করে বেশ কিছু টাকা তুলে দেয় তীর্থঙ্কর আর ছোটকাকে বায়না করার করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বায়না করে বলে,-"আজ কিন্তু আমাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে হবে বলে দিলাম। " ছোটকা মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বলেন,-"দুষ্টু ছেলে আগে আমাকে কোলে তোল।"
একদিন ব্রজকিশোর বললেন,-" আমার প্রথম বইটা তো হাজারটা ছেপেছিলিশ,গত বছর পর্যন্ত তোর হিসেব মতন আটশো বই বিক্রি হয়ে গেছে, সেরকম বিক্রি হলে এবছল ওই বই নিশ্চয়ই শেষ হতে চললো। পুণরমুদ্রণ করতে হবে। তবে কয়েকদিন ধরে বইটা অনেকবার পড়ে দেখলাম একদম বিচ্ছিরি লেখা! ভাবছি পাঠক হজম করলো কি করে আর করলোই যদি কোন সমালোচনাও করলো না কেন? শোন্ তীর্থ, লেখাগুলোকে আমি নতুন করে সাজিয়েছি। অনেক অংশ বাদ দিয়েছি আবার অনেক কিছু যোগও করেছি। এই করতে গিয়ে এ বছর আর নতুন কিছু লিখে শেষ করতে পারিনি। এই বছর এই বইটা ছাপাতে হবে বলে এটাকেই নতুন করে লিখলাম।নতুন মলাট দিস কিন্তু।"
এবারে প্রুফ চেকিংএর কাজটা অন্য একটা ছেলেকে দিল তীর্থঙ্কর। সজল বললো,-"তীর্থদা আবার 'ভাঙা নৌকার কাণ্ডারি'! স্টোর রুমে প্রায় হাজারটা ঝকঝকে নতুন বই পেটিবন্দী হয়ে পরে আছে এছাড়া আরও তিন হাজার বই নো নরন-চরণ অবস্থায় পেটী বন্দী...এবারেও কি...."
তীর্থঙ্কর বললো,-" নারে সজল ভেবে দেখলাম এবারে দশটার বেশী ছাপবো না।"
নতুন ছাপা বই ভর্তি সাইকেল ভ্যান আসতে সজল ভ্যানের ওপর থেকে প্যাকেটেমোড়া বইয়ের ছোট বাণ্ডিলটা এনে তীর্থঙ্করের টেবিলে রাখলো। পিঠে ব্যাগ নিয়ে কয়েকজন যুবক অনেকক্ষণ ধরে বই সাজানো র্যাকে কিছু বই খুঁজছিলো। ভ্যান থেকে বই নামানো শেষ করে সজল এসে দাঁড়ালো তীর্থঙ্করের টেবিলের কাছে। তীর্থঙ্কর বললো,-"প্যাকেটটা খোল, দেখি বইটা কেমন করলো।" সজল প্যাকেট খুলে একটা বই তুলে দিল তার হাতে। একজন যুবক এগিয়ে এসে বললো,-" নতুন বই? একটা দেখবো?"
সজল তার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলো। যুবক বইটা ধরে মনোযোগ দিয়ে মলাটের ছবি দেখে বই খুলে জোড়ে জোড়ে পড়লো,-"পুনরমূদ্রন,প্রথম প্রকাশ দু হাজার পনেরো। বইয়ের নাম 'ভাঙা নৌকার কাণ্ডারি'।" যুবকের দল এগিয়ে এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। -"লেখক ব্রজকিশোর দত্ত। নীল একটু দেখতো,বইটাকে পাঁচ বছরের মধ্যে আবার মূদ্রণ করা হয়েছে! ইন্টারেস্টিং..." একজন তার হাত থেকে বইটা নিয়ে জোড়ে জোড়ে দ্রুত প্রথম কয়টা পাতা পড়লো।অন্য যুবকেরা নিঃশব্দে মনোযোগ দিয়ে শুনলো। প্রথম যুবক বললো,-"এবার শেষের কটা পৃষ্ঠা পড় দেখি।" নীল নামের যুবক শেষের দুটো পৃষ্ঠা পড়তে সকলে সমস্বরে বললো -"বাঃ!এই রকমটাই তো খুঁজছিলাম।"একজন তীর্থঙ্করকে প্রশ্ন করলো,-" ইনি কি নতুন লেখক?নামটা যে খুব পরিচিত তা তো নয়।" তীর্থঙ্কর উত্তর দিল-"হ্যা,নতুন, এই বছর পাঁচেক লেখালেখি করছেন।" নীল বললো,-"ব-ছ-র পাঁচেক! তাহলে মনে হয় এটাই তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস! এরই মধ্যে বইটার পুনরমূদ্রণ করতে হোলো! বাঃ! গ্রেট! শৈবাল কটা নিবি? " শৈবাল নামের যুককটি বললো,-"পাঁচটা নে, আর একটা আমি নেবো। টোটাল ছ'টা নে।" নীল তীর্থঙ্করকে প্রশ্ন করলো,-" আরও যদি লাগে দু-একটা নিতে আসবো। ছটা বইয়ের বিল করুন।" সজল নিজের টেবিলে বই গুলো নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে ক্যাশমেমো লিখে কাগজের ক্যারি ব্যাগে ছ'টা বই ভরে দিতে শৈবাল জানতে চাইলো-"যদি দরকার পরে লেখকের বাড়ির ঠিকানা আপনাদের কাছে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই?" সজল তীর্থঙ্করকে দেখিয়ে বললো -"উনি তীর্থদার কাকা।" শৈবাল এগিয়ে এসে তীর্থঙ্করক বললো,-"বাঃ! তাহলে আপনার বাড়িতে গেলেই তাঁর সাথে দেখা হবে।আপনার ঠিকানাটা..." তীর্থঙ্কর একটা কার্ড এগিয়ে দিল। প্রুফ রিডার তন্ময় টিফিন খাওয়া শেষে অফিসে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো তারপর পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুক বের করে প্রত্যেকের কাছ থেকে সই সংগ্রহ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুবকদের চলে যাওয়া দেখলো। অফিসে ঢুকে শুভঙ্করকে প্রশ্ন করলো,-"এই পঞ্চপাণ্ডব কোন বইটা কিনলেন স্যার?"শুভঙ্কর চোখের ইশারায় টেবিলের ওপর পরে থাকা চারটে বই দেখালো। মুখে বললো,
-" নতুন সংষ্করণ।" অবাক চোখে একটা বই হাতে তুলে নীরবে প্রথম কয়টা পৃষ্ঠা পড়ে তন্ময় বললো,-"এ লেখার প্রুফ তো আমি চেক করিনি স্যার!" শুভঙ্করকে সে কথার উত্তর দেওয়ার সময় না দিয়ে সজল প্রশ্ন করলো,-"তুই ওদের সই নিলি কেন?" তন্ময় গধগদ কন্ঠে উত্তর দিল,-"সই নেবো না! কি যে বলো! ওরা 'পঞ্চপাণ্ডব' এতদিন সর্ট ফিল্ম করে নাম করেছে এখন ফুল মুভি করবে বল গল্প খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওরা পাঁচজন বন্ধু, একজন চিত্রনাট্য লেখে, একজন পরিচালনা করে, কেউ গান লেখে,কেউ সঙ্গীত পরিচালনা করে আর দরকার পরলে অভিনয়ও করে।
'ভাঙা নৌকার কাণ্ডারি'গল্পের চিত্রনাট্য লেখা হলো।
বড় পর্দায় রঙীন রঙে কলমের লেখাগুলো প্রাণ পেলো। মানুষ সেই কাহিনীর পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনার ঝড় তুললো। ব্রজকিশোর বা তীর্থঙ্কর এতোটা আশা করেনি। ব্রজকিশোর তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসকেও নতুন করে সাজিয়ে লিখেছিলেন। তৃতীয় আর চতুর্থ উপন্যাসে নিজের পাকা লেখার কাজ দেখে বেশ খানিকটা তৃপ্তি পেয়েছেন।
এবারের কলকাতা বইমেলায় তীর্থঙ্করের জোড়াজুড়িতে ব্রজকিশোর বইমেলায় এসেছেন তাঁর পা না থাকার দুঃখ কোনো দিনও ছিল না আজও নেই। তাঁর মতে ঈশ্বর দিয়েছিলেন আবার স্বয়ং ঈশ্বরই ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। টাকার অভাব ছিল না। চিকিৎসা করলে হয়তো নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতে পারতেন এমনকি চলাফেরার জন্য কারও ওপর ভরসা করতে হতো না। কিন্তু ছোট্ট ছেলেটি হয়ে তীর্থঙ্করের কোলে চাপার সুযোগটা তিনি এই জন্মে পেতেন না। স্বর্ণ ব্যবসায়ীর জীবন থেকে সরে এসে আর কোন ব্যবসামুখী হওয়ার লালসা ত্যাগ করে তাঁর শিল্পি সত্তা নতুন শিল্প সৃষ্টির সন্ধানে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিল। আজ 'প্রতিবন্ধী লেখক' নামে পরিচিত ব্রজকিশোর বইমেলার স্টলে হুইলচেয়ারে বসে বহু মানুষকে অটোগ্রাফ দিলেন। অনেকে তাঁর লেখা বই কিনে তাতেই তাঁর সই সংগ্রহ করেছে। তীর্থঙ্কর মুগ্ধ চোখে এ দৃশ্য দেখছে। 'ভাঙা নৌকার কাণ্ডারি' আবার হাজার কপি ছাপা হয়েছে।তার মনের অনেক ভার আজ লাঘব হয়েছে। ছোটকাকে এতোদিন ধরে বলা 'তাঁর লেখা বই বিক্রি হয়েছে' এমন মিথ্যাচার আর করতে হবে না। তবে এটুকু বুঝেছে ছোটকার মুখের হাসিটুকু দেখার জন্য এই মিথ্যাচার করে ফল খারাপ হয়নি। যে কোনো কাজের সামান্য সফলতা যে মানুষের মনের আশা আর চেষ্টাকে আকাশচুম্বী করে তোলে তার বাস্তব প্রমাণ তার পরম আদরের,পরম শ্রদ্ধার মানুষ হলো স্বয়ং ছোটকা। অকাতর পরিশ্রমে বিশ্বাসী প্রচন্ড অধ্যাবসায়ী মানুষটার আত্মবিশ্বাস আজ তাঁকে একজন স্বর্ণকার থেকে সফল লেখক করে তুলেছে। ছোটকার সঙ্গে চোখাচুখী হতে তিনি চোখের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। কাউন্টারের ভীড় পেরিয়ে তীর্থঙ্কর ব্রজকিশোরের কিছে পৌঁছোলে ছোটকা বললেন,-"আমার একটা বড় দায়িত্ব এখনও বাকি আছে,মনে হচ্ছে সেটাও খুব তাড়াতাড়ি সফল হবে। তোর জন্যে মেয়ে দেখা আমার হয়ে গেছে। ওই দেখ, ডানদিকের বুক কেসের সামনে ক্যামেরা হাতে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে...." তীর্থঙ্কর সেদিকে একনজর বুলিয়ে বললো,-"ওঃ!ও তো প্রুফ রিডার তন্ময়ের দিদি সায়ন্তিকা। নতুন কোন একটা ম্যাগাজিনের জন্য রিপোর্ট সংগ্রহ করতে এসেছে, তার ওপর, তুমি আজ আমার স্টলে আছো, দেখো এক্ষুণি কতো উৎসাহ নিয়ে তোমার ইন্টারভিউ নিতে আসবে।"
-"আঃ তুই থাম তো। আমি সেই থেকে দেখছি আমার কিংবা বইয়ের ছবি তোলার চাইতে বেশি তোর ছবি তুলছে।ওর তোলা ছবিগুলো ওর ওই ক্যামেরাতেই পেয়ে যাবি।"
তীর্থঙ্কর মুগ্ধ হয়ে ছোটকাকে দেখলো। নিজের যৌবন বয়সে নিজের সংসার তৈরী করার সখ বিসর্জন দিয়ে ভেঙ্গে পরা 'দত্ত পরিবার'এর হাল ধরে থাকা এই কাণ্ডারি মানুষটা তার নতুন নৌকারোহীর জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছেন সে স্বপ্ন হয়তো সত্যি সফল হবে..." ছোটকা বললেন -"শোন ওর ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ওর মা-বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। তোর মা-বাবার মৃত্যুর পর আমার বৃদ্ধ বাবা ভেঙ্গে পরেছিলেন, সেই ভেঙ্গে যাওয়া নৌকা ছেড়ে যখন ছোট্টো তোকে আর বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে এই নতুন নৌকার হাল ধরেছিলাম তখন আমি ছিলাম পরিশ্রমী আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সদ্য যুবক।সেদিনই ভেবে নিয়েছিলাম আমার এই নতুন নৌকায় লক্ষ্মীকে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। এইবার সেই সময় আসন্নপ্রায়।" নিজের কথা বলার ভঙ্গিতে নিজেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। বহুদিন পর ব্রজকিশোরের সারল্যে ভরা হাসি মুখখানা দেখে তীর্থঙ্কর সেই হাসিতে যোগ দিল। আর সায়ন্তিকা এই অমূল্য দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দী করলো।