মণিদীপার মন আজ ভালো নেই। সংযুক্তা এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। আজই ফিরে যাবে শ্বশুরবাড়ি।ক'টাদিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেছিল। এই কটাদিন প্রায় রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতো। ঘন্টা খানেকের জন্য ওর সঙ্গে আড্ডা মারতো। কেমন একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মণিদীপার জীবনে সংযুক্তা বন্ধু ছাড়া আর কিছুই নয়। তবু যেন এই কদিনে বড়ই আপনার হয়ে গিয়েছিল। কলেজ থেকে পাস আউট করার পর থেকে মণিদীপা একটার পর একটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েই চলেছে কিন্তু আজ পযর্ন্ত কোনটাতেই সফল হয়নি।। সংযুক্তা কিন্তু সরকারি চাকরির অপেক্ষাতে থাকেনি। ওর মতে হাতের মুঠোতে যেটা আছে তাকে সন্মান করলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে নাহলে সময় বয়ে যায়..তারপর শুধু ভাগ্যর ওপর দায় চাপাতে হয়। সবটাই বোঝে মণিদীপা কিন্তু কিচ্ছু করার নেই ব্যাপারটা পুরনো হয়ে গেছে দীর্ঘদিন বিনা চিকিৎসায় পরে থাকা ঘায়ের মতন মনের মধ্যে সরকারি চাকরি পাওয়ার লড়াইটা আরও জেঁকে বসেছে।
সংযুক্তা লড়াকু মেয়ে! আজীবন লড়াই করেছে দরিদ্র পরিবারের এই মেয়েটা। ভালো রেজাল্টের দৌলতে স্টাডি লোন নিয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ে আজ ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। জয়েন্ট দেওয়ার আগে যদি প্রপার গাইডেন্স পেত তাহলে যাদবপুরে পড়ার সুযোগটা হয়তো হাতছাড়া হতোনা। সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা তারও ছিল কিন্তু অভাবের সংসার আর ব্যাঙ্ক লোন শোধের জন্য ক্যাম্পাসে পাওয়া চাকরিটাতেই সে মনযোগ দিয়েছিল। সে লক্ষ্য করেছে,যে ছেলে মেয়েরা আজও সরকারি চাকরি পাওয়ার অপেক্ষাতে বসে আছে তাদের বাপ মায়ের কিছু পুঁজি আছে ফলে পেটের ভাত আর ভবিষ্যতের পথ চলার খরচ সম্পর্কে তারা নিশ্চিন্ত। যেমন তথাগত । অত্যন্ত মেধাবী আর ভালো স্টুডেন্ট ছিল ছেলেটা। এক্সামের জন্য পড়াশোনার প্রস্ততির সময় কারও যদি কিছু মাথায় না ঢুকতো তথাগতর কাছে গিয়ে বললেই সে আগ্রহ ভরে বুঝিয়ে দিত সকলকে। ওর এই বোঝানোর কায়দাটা বড় ভালো লাগতো। কিন্তু ক্যাম্পাসে ওর কেন যে চাকরি হলোনা ভেবে পায়নি সংযুক্তা। তারপর থেকে তথাগত সরকারি চাকরি ছাড়া চাকরি করবেনা এই জেদ নিয়ে বসে ছিল। ক্যাম্পাসে চাকরি না পাওয়ায় সংযুক্তা বন্ধুর প্রতি কর্তব্য পালন করার প্রবণতায় নিয়মিত তার খোঁজ খবর রাখতে থাকে। এই ভাবেই তথাগতর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। ফোর্থ ইয়ার কমপ্লিট করে দুই মাসের ট্রেনিং এ সংযুক্তাকে কোয়েমবাটুর যেতে হয়েছিল। দূরে থাকাকালীন ওরা বুঝতে পেরেছিল ওদের পরষ্পরের বন্ধুত্ব ভালোবাসার রূপ পেয়েছে।সেই ভালোবাসার গভীরতা যে কতোখানি তা বুঝতেও তাদের কোন বেগ পেতে হয়নি। সে প্রায় বছর চারেক আগের কথা। এদিকে ছেলেটার তখনও একই জেদ সরকারি চাকরি ছাড়া কোন চাকরি করবে না।
সংযুক্তা বোঝাতো,-"এই বয়সে এতো জেদ কোরোনা বয়স পেরিয়ে গেলে আফসোস হবে কিন্তু।"
তথাগতর উত্তর,-"এই বয়সে জেদ না করলে কবে করবো প্রিয়ে?"না হেসে পারতোনা সংযুক্তা। তথাগত বয়সের ধর্ম সম্পর্কে বিরাট একটা লিস্ট তুলে ধরেছিল। সংযুক্তার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার যোগাড়। সেই,বয়সের ধর্মেই কুমারী সংযুক্তা আর যুবক তথাগতের ঘনিষ্ঠতা বারে আর সে গর্ভবতী হয়। কেউ বোঝার আগেই দুজনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। নেহাত দরিদ্র বাবা মায়ের উপার্জনশীলা একমাত্র সন্তান, তাই, শিক্ষিত,বেকার অথচ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেটিকে তাঁদের মেয়ে ভালোবাসে জেনে তাকে জামাই করতে রাজি হয়ে যান সংযুক্তার বাবা-মা। তথাগতের বাবা-মা ছেলেকে বোঝান কিছু উপার্জন না করে বেকার অবস্থায় বিয়ে করা উচিত নয়। তাঁদের পরামর্শে সে ছাত্র পড়ানো শুরু করে। ইন্জিনিয়ার হয়েও ক্যাম্পাসে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে কলেজের সহপাঠী অনির্বানকে মুষড়ে পরতে দেখেছিল সংযুক্তা কিন্তু ইন্জিনিয়ারব্ খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল সে। এরপর 'শুভস্য শীঘ্রম' এই প্রবাদ বিশ্বাসি দুই পক্ষের মা-বাবার তোড়জোড়ে মাস দুয়েকের মধ্যে তথাগত আর সংযুক্তা আইনসন্মতভাবে এবং সামাজিক নিয়মে বিয়ে করে সংসারী হয়।
মণিদীপার জীবনেও প্রেম এসেছিল কলেজ লাইফে। মনের মিল না হওয়াতে সেকেন্ড ইয়ারে ব্রেক আপ হয়ে যায়। তার মতে প্রথম প্রথম জীবনে এমন অনেক ভুলভাল ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক হতেই পারে সুতরাং ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো। দ্বিতীয় প্রেম হয় অভিজিতের সঙ্গে। ক্যাম্পাসে অভিজিত চাকরি পায় কিন্ত মণিদীপা না পাওয়াতে অভিজিতকে এড়িয়ে চলতে থাকে সে। ..আজ মণিদীপা বড় একা। ফেসবুকে পুরনো কিছু বন্ধুর সঙ্গে গল্প করে বটে তবে সেগুলো মনে দাগ কাটার মতন এমন কিছু নয়। মণিদীপা বোঝে মনে মনে সে শুকিয়ে যাচ্ছে। বাপ-মা তাকে আর বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করেন না তাঁরা বুঝে গেছেন পুরানো চাল ভাতে বাড়ার মতোন তাদের মেয়ের জেদ আরও বেড়ে গেছে। নেতিবাচক আচরণ যুক্ত মেয়েটাকে তার এই জেদ থেকে নরানো তাঁদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। সুতরাং মেয়ে যতক্ষণ না সরকারি চাকরি পাবে ততক্ষণ তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যাবে না আর সেটা হয়তো এ জন্মে আর হওয়ার নয় এমনটাই বুঝে তাঁরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এই বয়স্কা বাবা-মা আজ তাঁদের আদরে বাঁদর মেয়েটাকে একটু ভয় করেই চলেন।
না পাওয়ার বেদনা কখনও কখনও বেদনাহীন এক হতাশায় পরিণত হয়। এই হতাশাকে প্রশ্রয় না দিয়ে যদি নিজের চলার পথের অন্য দিকের বন্ধ দরজাটাকে উন্মুক্ত করা যায় তাহলে নতুন উন্মাদনায় মেতে ওঠা সম্ভব হয়। বলা যায় না ওই পথেই তার সফলতা আসতে পারে। তথাগত এই পথেরই পথিক। অপরদিকে কখনও বা সেই না পাওয়ার বেদনা কেবল না পাওয়ার পেছনেই ছুটিয়ে মারে। শেষ পযর্ন্ত সফল হলে ভালো না হলে 'আঙ্গুর ফল টক'এর মতন ভাগ্যকে দোষারোপ করে। মণিদীপা এই দ্বিতীয় পন্থাকে বরণ করেছে। নেটজমানায় ইন্টারনেটের দৌলতে কিছু অচেনা ছেলে বন্ধুরা গায় পরে মেসেঞ্জারে মেসেজ করে গল্প করে। একজন সরকারি চাকুরে তাকে তো সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। অবশ্য ছেলেটা কতটা সত্যি বলছে সে ব্যাপরে মণিদীপা মনে সন্দেহ থেকেই যায়। তাই সে জানতে চায়,-"আমি তো চাকরি করিনা তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে কেন?" ছেলেটির বক্তব্য,-"তুমি সরকারি চাকরি পছন্দ করো আর তা পাওয়ার চেষ্টাও করছো। একদিন ঠিকই পেয়ে যাবে। আর আমি তো সরকারি চাকরিই করি তাহলে আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি কোথায়!"
মণিদীপার মাঝে মাঝে মনে হয় এ জীবনে আর চাকরি বাকরি করা হবে না তার চাইতে সংসারি হওয়াই ভালো। কিন্তু একজন অচেনা অজানা ছেলে কেবল সরকারি চাকরি করে এই সুবাদে তাকে বিয়ে করে ফেলবে এমন মতিভ্রম এখনও তার হয়নি। যাক গে, এ জীবনটা নাহয় বৃথাই যাক। কি আর হবে! সবার সাধ তো এক জন্মে পূর্ণ হওয়ার নয়। নির্বান্ধব আর নিঃসঙ্গ জীবনে সংযুক্তাকেই শুধু মনে পরে তার, তাই তাকে ফোন করে বলে,-"তুই এবারে এলে ছেলে আর তথাগতকে সঙ্গে আনিস।"সেদিন সংযুক্তা অফিসে ব্যস্ত ছিল তা সত্ত্বেও নির্বান্ধব বন্ধুটিকে ভরসা দিয়ে বললো,-"তথাগতর স্টুডেন্টদের এখন এক্সাম চলছে, কিছুদিনের মধ্যে শেষ হবে, তখনই যাবো নাহয়। তুই নিশ্চিন্তে থাক।"
সংযুক্তা কিচেনে কাজ করতে করতে দেখতে পেল তথাগত একরাশ টাকা টেবিলে রেখে গুণছে। সে হেসে বললো,-"তোমাকে ইনকামট্যাক্স দিতে হয়না...বেশ আছো।" তথাগত দাঁত বের করে হাসলো। সংযুক্তা আবার বললো,-" টাকা পয়সা গোণা হলে হাতটা ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ো...বলা যায়না ওই হাতেই আবার কখন ছেলেকে কোলে তুলে নেবে।"এবার সংযুক্তা ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,-" এবার ভাবছি একদিন তোমাকে আর ছেলেকে সঙ্গে করে মণিদীপার বাড়ি যাবো...তোমার স্টুডেন্টদের এক্সাম কবে শেষ হবে?"
-"এই তো সামনের সপ্তাহে আমার কাজের চাপ কম থাকবে "
--"বেশ,একদিন ওখানে গেলে সারাদিন তুমি তীর্থকে নিয়ে মণিদীপাদের বাড়ি থাকবে আমি চেষ্টা করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিস থেকে বেড়িয়ে পরার, তারপর তোমাদের সাথে মিট করে ওখানে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে বাবা-মায়ের কাছে যাবো। "
-"তীর্থবাবু কি এই বাড়ির মানুষদের ছেড়ে থাকতে পারবে অতোক্ষণ?" তথাগতকে চিন্তিত দেখায়।
-"হ্যাঁ--হ্যাঁ পারবে। ও খুব শান্ত,আদর পেলে সবার কাছে যায়। মণিদীপাদের বাড়িতেও ঠাকুরদাদা আর ঠাকুরমার বয়সী দাদু-দিদাকে পেয়ে যাবে আমাদের দুষ্টুটা।"
মণিদীপা আশা করেনি এতো তাড়াতাড়ি সংযুক্তা কথা রাখবে। খুব খুশী হলো সে। অনেকদিন পর তথাগতকে দেখলো। কলেজের সেই সবার প্রিয় ইয়ং ছেলেটার মধ্যে একটু কি পরিবর্তন হয়েছে!
আর ওদের ছেলেটা যেন রাজপুত্র! ওর ছেলেকে কোলে নিয়ে কতো আদর করলো। মা বাবার সঙ্গে আলাপ করালো। তীর্থ খুব শান্ত ছেলে। আদর খেতে ভালোবাসে। মনিদীপাকে ছেলের প্রতি যত্ন নিতে দেখে তথাগত ভাবলো মেয়েরা যেকোন সময় যে কোন বয়সে মা হয়ে ঊঠতে পারে। সমস্ত মেয়েদের মাতৃরূপ হয়তো একই রকমের হয়! সংযুক্তা যখন ছেলে সামলায় এইভাবেই সামলায়। মাঝে মাঝেই মণিদীপা তথাগতের দিকে তাকাচ্ছিল আর দেখছিল তথাগতের দৃষ্টিতেসে যেন বিস্ময় দেখথে পেলো। মণিদীপার নিত্যকার হতাশাময় একক জীবনে আজ যেন সব নতুন হয়ে উঠেছে। মনে মনে সে অন্য কথা,ভাবছিল, সংযুক্তা চাকরি করে তাই হয়তো ছেলে সামলাতে পারে না আর সে পারছে, এই দেখেই হয়তো তথাগত খুশি হচ্ছে। মণিদীপা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে থাকে -"তোর ছেলে হয়তো মাকে যত না চেনে তোকে বা তোর বাড়ির লোককে বেশি চেনে?" "তোর ছেলে তোকে বেশি ভালোবাসে না সংযুক্তাকে।" প্রশ্নগুলো তথাগতর মোটেই ভালো লাগলো না। বিরক্তির স্বরে বললো,
-"তা কেন হবে! মাকে ছেলে চিনবে না তা আবার হয় নাকি! আশ্চর্য সব প্রশ্ন করছিস।"
আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়েছে সংযুক্তা সেই সল্টলেক থেকে বেহালা। ক্যাবে চলে এলো।ছেলে মাকে দেখে ছটফট্ করছিল মায়ের কোলে ওঠার জন্য। তথাগত ছেলেকে নিয়ে একটু বাইরে যেতেই সংযুক্তা স্নান করে জামাকাপড় পাল্টে তবে ছেলে কোলে নিল। তথাগত বললো,-"শুধু দুধ খেয়েছে।" সংযুক্তা মৃদু হেসে তথাগতর ব্যাগ থেকে ছেলের ফুডের কৌটো আর সরঞ্জাম বের করে যত্ন করে ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পারালো। তথাগত মণিদীপাকে লক্ষ্য করছিল আর ভাবছিলো বোকা মণিদীপা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তার বোকা বোকা ধারণা গুলোর সঠিক উত্তর পেয়ে গেছে। ছেলেকে ঘুম পারিয়ে চা, মিষ্টি খেয়ে অনেক গল্প করলো ওরা। চাকরির প্রসঙ্গ উঠতে তথাগত বললো,-" ক্যাম্পাসে চাকরি পেলাম না বলে মনে মনে খুব রাগ হয়েছিলো ভেবেছিলাম জীবনে আর চাকরি করবো না,আর যদি করি তাহলে শুধু সরকারি চাকরি করবো...আসলে বাপের টাকা আছে তাতেই আমার জীবন কেটে যেতে পারে এই রকম একটা ধারণা ছিল মনে। পরে অবশ্য সরকারি চাকরির জন্য একবার মাত্র বসেছিলাম। তাতে যখন ফেল মারলাম তখন,জটাধারী শিব-শম্ভু হওয়ার প্ল্যানে ছিলাম, কিন্ত তোর ওই বন্ধু..থুরি বান্ধবী স-ং-যুক্তা আমাকে সংসারের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলো....শেষ পযর্ন্ত এই মেনকা রূপসীর ফাঁদেই পা দিলাম।" সংযুক্তা ঘুমন্ত ছেলে কোলে মজার ছলে তথাগতর দিকে চেয়ে চোখ পাকালো, তার ঠোঁটের কোলে মৃদু হাসি ছড়িয়ে ছিল। তথাগত আবার কথা শুরু করলো,-"বাপ-মাকে বললাম বিয়ে করবো। তাঁরা বললেন বেকার ছেলে বিয়ে করবে কি! বললাম বৌ ইঞ্জিনিয়ার। বৌয়ের পয়সায় খাবো। বাপ বললো,-"তোমার কি প্রেস্টিজ নেই! কিছুনা করলে অন্তত ছাত্র পড়াও।" হ্যাঁ ওটা আমি খুব ভালো পারি তাই ওটাই শুরু করে দিলাম।" সংযুক্তা বললো,-"সত্যি, তোমার বোঝানোর কায়দাটা এতো ভালো যে কলেজে যখনই আমার কোথাও বুঝতে আটকাতো আমি তোমার কাছে যেতাম।" মণিদীপা বললো,-"আমরা অনেকেই যেতাম।" তথাগত এবার মণিদীপাকে প্রশ্ন করলো,
-"তোর কি ইচ্ছে? শুধু সরকারি চাকরির পেছনে ছুটে মরবি? আচ্ছা একটা কথা বল্, মনে কর, আমরা দুজন বেকার, বাপের টাকার দৌলতে একটা অফিস খুললাম সেখানে কেউ চাকরি করতে এলোনা কারণ সবাই সরকারি চাকরি চায়, তাহলে তুই কি করবি? এবার মনে কর যদিওবা কেউ এলো কিন্তু দেখলি পাশ করার চারবছর পরেও তার কোন এক্সপেরিয়েন্স নেই। তুই কি তাকে চাকরি দিবি?" মণিদীপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তথাগত বললো,-"এক্সপেরিয়েন্সের খুব দরকার রে। তুই এক কাজ কর, সরকারি চাকরির পরীক্ষাও দিতে থাক আর প্রপার ইনটারভিউ দিয়ে বেসরকারি কোনোও অফিসে জয়েন কর, মনটা ফুরফুরে হবে...আর সেই সঙ্গে যখন মাসের শেষে পকেটে মাইনা ঢুকবে তখন দেখিস তোর সেল্ফ কন্ফিডেন্সটাও বারবে।..লড়াই করার আগেই হেরে বসে আছিস কেনো? শোন, এই কথাগুলো আমার বাবা মা আমাকে বলেছিলেন, বিয়ে করতে চাই শুনে।..ছেলেমেয়েদের বয়সের দোষে করা ভুলগুলো তাঁরাই তো দায়িত্ব নিয়ে শুধরে দেন।" মণিদীপা মাথা তুললো। তার বাবা-মাও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তবে অন্য রকম ছিল তাঁদের ভাবনা। তাঁরা বলেছিলেন আগে বিয়ে করো তারপর চাকরি। কারণ সে তাঁদের জানিয়েছিল চাকরি না পেলে বিয়ে করবে না। কিন্তু সেই আশায় ছাই পরেছে। আজও সে সরকারি চাকরি পায়নি!
আজ তথাগতের কথাগুলো তার ভাবনাগুলোতে জট পাকিয়ে দিল।
-
তথাগতকে দেখার পর থেকে মণিদীপার মনে ঝড় উঠেছে। এতো সুন্দর করে বোঝায়। এমন মানুষ যদি পাশে থাকতো তাহলে জীবনে কোনো ভুল সে হয়তো করত না। কলেজ জীবনে তথাগত আর তার মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা যুক্তিসংগত ছিল। প্রথমত, দুজনেরই পরিবার ছিল সচ্ছল। দ্বিতীয়ত,ক্যাম্পাসে তাদের দুজনেরই চাকরি জোটেনি। তৃতীয়ত, দুজনেই ক্যাম্পাসে চাকরি না পেয়ে সরকারি চাকরি পাওয়ার বাসনা মনের মধ্যে পোষন করেছিল। তা সত্বেও তাদের বন্ধুত্ব কেন গাঢ় হলো না! কেন তার একবারও মনে হয়নি তথাগতই তার জন্য উপযুক্ত অথচ সংযুক্তা কি করে যে তথাগতর এতো কাছাকাছি আসতে পেরেছিল! আজ বড় আফসোস হচ্ছে তার, ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। কিন্তু কি করে জানেনা তার নিজের ওপর থেকে রাগের সমস্তটাই হঠাৎ সংযুক্তার ওপর ঘুরে গেল। বিরক্তিতে ভরে গেল মনটা। তার সুস্থ মন তাকে বোঝালো এতে সংযুক্তার দোষ কোথায় সে স্বয়ং কখোনোই তথাগতের প্রতি আগ্রহ দেখায় নি। এই সুন্দর ভদ্র ছেলেটার প্রতি অনেকেরই নজর ছিল তাই সে নিজেকে সেই অনেকের দলে ভিড়তে দেয়নি। এছাড়া তার আত্মঅহংকার কখনই তথাগতর পড়া বোঝানোর ক্ষমতার কাছে নিজেকে নতি স্বীকার করতে দেয়নি। সে জায়গায় সংযুক্তা হয়তো মাত্রাতিরিক্ত ভাবে তথাগতের প্রতি আগ্রহী ছিল। মণিদীপা নিজেকে প্রশ্ন করেছে সে কি আসলে সংযুক্তার সুখকে হিংসা করছে? কিন্ত প্রবল হতাশারোগাক্রান্ত মণিদীপার মনে তথাগতকে আঁকরে ধরে নিজের আশার স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলার প্রবণতা যেন ক্রমশ বেড়েই চললো।
মণিদীপা জানে সংযুক্তা এখানে এসেছে কদিন বাবা মায়ের কাছে থাকবে বলে। তথাগতর ছাত্র পড়ানো থাকে বলে ওরা দুজনে একসঙ্গে বাপের বাড়িতে এসে থাকতে পারেনা। এখন পড়ানোর চাপ কম আছে তাই কিছুদিন ওরা ছেলে নিয়ে এখানেই থাকবে। মণিদীপা ফোন করে তথাগতকে ডাকলো। বললো,-"চল্ আমরা দুজনে একসাথে প্রিপারেশন নি। দুজনেই কোথাও একসাথে ইন্টারভিউ দেবো না হয়।" তথাগত বললো,-"আমি ইন্টারভিউ দেবোনা কারণ আমার চাকরির দরকার নেই। তুই দে। " মণিদীপা তথাগতর হাতদুটো ধরে বললো,-" আমাকে একটু পড়াগুলো দেখিয়ে দিবি চল।" তথাগত বললো,-"এ সব তোর বন্ধু পারবে....আমি পারবো না। ওকে বলে দেবো যেকটাদিন এখানে আছে সেই কদিন তোকে হেল্প করবে।" মণিদীপা দাঁতে দাঁত চেপে হিস্ হিস্ করে বললো,-"না সংযুক্তা নয় আমাকে তুই দেখাবি,পড়াবি। আমার তোর হেল্প চাই।" সে শক্ত করে তথাগতর হাতদুটো চেপে ধরলো। তথাগত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,-" তোর ভালো চেয়ে সংযুক্তা আমাকে তোর সাথে দেখা করতে বলেছিল। তাছাড়া তুই কোনদিনও আমার তেমন বন্ধু ছিলিস না, আজও নয়।" মণিদীপা ক্রুদ্ধ চোখে ওর দিকে তাকালো। -"খুব সাধুপুরুষ মনে করিস নিজেকে তাই না? বিয়ের আগে সংযুক্তার সঙ্গে কিভাবে মেলামেশা করতিস আমি জানিনা মনে করেছিস!" তথাগত বুঝতে পারছিল মণিদীপা আর নিজের মধ্যে নেই। তার নিজের সমস্ত না পাওয়ার রাগ ওই সফল মেয়েটার ওপর গিয়ে পরেছে। যে মেয়েটা তার দুঃখে দুঃখী হয়। যে মনেপ্রাণে তার বান্ধবীকে সুখী আর সফল দেখতে চায়। কিন্তু,ওই সরল মেয়েটা হয়তো ভাবতে পারেনি তার এই বান্ধবী কেবল মাত্র নিজের জেদের বশে পুরুষ সঙ্গী পাওয়ার সুখটাও হারিয়েছে। আজ তাই সে সংযুক্তার ভালোমানুষীর সুযোগ নিয়ে তারই স্বামীকে তার থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে।
-তথাগত বললো,-" সংযুক্তা বড় ভালো মেয়ে। চাকরি না পেয়ে যখন আমি মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে পরেছিলাম সে সময় ও আমার পাশে ছিল।আমাকে সাহস যুগিয়ে ছিলো। তার সেই হৃদ্যতা আমি ভুলতে পারিনি আজও। এখন ও চায় তোর যেন ভালো হয়। তুই আমাকে ফোন করে ডাকলি দেখে ও আমাকে এখানে আসতে বললো, যেন তোকে কিছু বোঝাতে পারি। আর তুই ওর এই সহানুভূতি কে ভালোমানুষীর দূর্বলতা ভেবে তাকেই ঠকাতে চাইছিস। পৃথিবীতে এক ধরণের ভালো মানুষ থাকে যাদের বোকা মনে হয়। তারা হয়তো ঠকার জন্যেই জন্মায়। কিন্তু আমার মতো মানুষ যদি তার পাশে থাকে তাকে ঠকানো কখনই সম্ভব বা সহজ হয়না। প্রহরীর মতন আমি তাকে অবশ্যই রক্ষা করবো। একবার ভেবে দেখ্, সংযুক্তার মতন বন্ধুকে তুই যদি হারাস তাহলে তুই যে আরও একা হয়ে যাবি মণিদীপা। এটা মনে রাখিস আমি কখনই সংযুক্তাক ঠকাবো না আর ঠকতেও দেবোনা। ঠিক সেই জন্যেই তোর স্বপ্নকে সত্য করার জন্যে তোর পাশেও থাকবো না। প্লিজ তুই সংযত হয়ে নিজেকে সামলা। এখনও দেরী হয় নি। এতো ভেঙ্গে পরিস না। আমি যাচ্ছি। " চলে যেতে যেতে তথাগত বললো,-"ভাবিস না,তোর বন্ধুকে এসব কথা কিচ্ছু বলবো না। পারলে সংযুক্তা এলে ওর থেকে হেল্প নিস। ওর স্বচ্ছ মন কখনই কিছু হারানোর ভয় আতঙ্কিত হয়না বা স্বার্থপরের মতোন নিজের একার জন্য ভেবে এক পাও পেছোয় না।" ভীষণ ভাবে লজ্জিতা মণিদীপা কিছুক্ষণ মাথা নত করে রইলো। ফিরে যেতে যেতে তথাগত শুনতে পেলো মণিদীপা বলছে,"সংযুক্তাকে আসতে বলিস।ও ছাড়া আমার যে কোন বন্ধু নেই।"