কাল রাত পর্যন্ত ঠিকই তো ছিল। আজ কি যে হলো গলায় ? সেটাই তো বুঝতে পারছে না ইরা। কেনো গলা দিয়ে খুব মিনমিনে আওয়াজ বেরোচ্ছে ? ভাগ্যিস গতকাল মিউজিকের পরীক্ষাটা হয়ে গিয়েছিল ! আজ হলে কী যে হতো ? এইসব ভাবতে ভাবতে মা র কাছে ছুটলো ইরা । " মা সব শুনে বললো , কি যে করিস না ! একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখিস না। বারবার বলি মাথার জানলাটা রাত্রে বন্ধ করে দিবি। তা শুনলে তো মা র কথা ! এবার কি হবে ? কালকে পরীক্ষা হয়ে গেলেও , গানের প্রাকটিস টা তো চালিয়ে যেতেই হবে ! স্যার কি বলেছেন মনে নেই ? কি হয়েছে মা ? কি হয়েছে রে দিদি ? আর বলিস না ! এ কিরে দিদি তোর গলার ভয়েস টা এরকম লাগছে কেনো রে ? মা দেখো দিদির গলার আওয়াজ টা কেমন পাল্টে গেছে। কি করে হলো ? এই বলতে বলতে নীরা মানে ইরার ছোট বোন সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। গলাটা কি ব্যথা হচ্ছে ? খুসখুস করছে ? কি করছে বল ! এই কথা মা জিজ্ঞেস করতে করতেই ইরার একটা ফোন এলো। হ্যালো হ্যালো , একি মা আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না কেনো ? এ কি হলো মা ? বলতে বলতে ইরা ভয় পেয়ে কেঁদে ফেললো। কিচ্ছু হয় নি , এই বলে মেয়েকে বুকে টেনে নিল মা । আমি আছি তো ! আজ ই ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবো। একদম ভাববি না তুই।"
মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেও , নিজে মনে মনে বেশ ভয়ই পেয়ে গেলেন মীরা দেবী। চারিদিকে যা সব রোগের নাম শোনা যায় , সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সত্যি তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। দুপুরটা কোনোমতে কাটিয়ে বিকেলেই মেয়েকে নিযে ডাক্তারবাবুর কাছে গেলেন মীরা দেবী। সব শুনে তিনি খুব একটা আশার আলো দেখাতে পারলেন না। ভালো করে পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিলেন। সঙ্গে কিছু নিয়ম মানার কথাও বলে দিলেন। আর হ্যাঁ এই সঙ্গে যে কথাটা ডাক্তার বাবু বললেন , তাতে ইরা চমকে না গেলেও মীরা দেবী হতবাক হয়ে গেলেন। উনি এককথায় যা বললেন , তা হলো ইরার গলায় সংক্রমণ হয়েছে। যা কিনা গলার স্বরের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। অল্প কয়েকদিনের ওষুধ দিলেন উনি। তারপর বিস্তারিত ভাবে পরীক্ষা করে দেখবেন বলেও বলে দিলেন। এতে মীরা দেবী আরও ভয় পেয়ে গেলেন।
খুবই চিন্তিত হয়ে দুজনে বাড়ি ফেরার পর বাবা অখিল বাবু এবং ছোট বোন নীরা সব শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে ইরার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোনো সাময়িকভাবে বন্ধই হয়ে গেলো। এতে সে চিন্তিত না হয়ে শুধু ডাক্তারবাবুর কথামত ওষুধ খেতে লাগলো। দু তিনদিন পর থেকে একটু একটু করে আওয়াজ বেরোতে শুরু করলো। তবে গলায় একটা জ্বালা - যন্ত্রণা থেকেই গেলো। ডাক্তারবাবু সব পরীক্ষা - নিরীক্ষা করে জানালেন যে, দীর্ঘদিন ধরে গলার ওপর চাপ পড়ায় ইরার ল্যারিংস এ ইনফেকশন হয়েছে যা কিনা ভয়ানক ক্ষতের সৃষ্টি করেছে! ইরার এই মুহূর্তে সব থেকে বড় বেদনার বিষয় হলো ও গান করতে পারছে না। ওর ব্যথা গলায় নয় , ওর ব্যথা মনে। গান ছাড়া যার একটুও চলে না , গানই যার জীবনের প্রাণ , সে কিনা গান গাইতে পারছে না এবং আর কখনও পারবে কিনা তাও ঠিক নেই। এই কথা মনে আসতেই ওর মনটা হু হু করে কেঁদে উঠছে। কিন্তু বাবা - মা , বোন এদের সামনে ও ওর মনের কষ্টটা দেখাবে না বলে , নিজেকে অনেক ভাবে সংযত করার চেষ্টা করছে ইরা। সে জানে না কতক্ষণ নিজেকে এভাবে সে সংযত রাখতে পারবে ? তবে যেকোনো মূল্যে তাকে যে থাকতেই হবে এটা সে বুঝে গেছে। সে ভেঙে পড়লে তার বাবা - মাকে একেবারেই শান্ত করা যাবে না। কারণ সন্তান দুঃখে থাকলে কোন বাবা- মা কি ভালো থাকতে পারে ! এইরকম নানা চিন্তা করতে করতে ইরা সে রাতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সবাই এই ব্যাপারটায় বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেলেও মা মীরা দেবীর মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না এই ভেবে যে, তার এতসুন্দর সুরেলা মেয়ে আর গাইতে পারবে না ? এটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে সত্যিই কষ্টকর ! আসলে ইরা সেই দুই , আড়াই বছর বয়স থেকেই শুনে শুনে গান করে। এতটুকু বয়সে এত নির্ভুল গান সত্যি ভাবা যায় না। ওর গানের প্রশংসা সবাই করতো। আর আজ সেই মেয়ে গান করতে পারছে না, মা হিসেবে এটা মেনে নেওয়া কি সম্ভব ? বেশ কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পরে একটু একটু করে গলার আওয়াজ বেরোলেও গান গাইতে পারবে কিনা সেই নিয়ে সন্দেহটা থেকেই গেলো। ইরা যাতে কখনও এই ব্যাপারটায় দুঃখ না পায় , কষ্ট না পায় , তাই মীরা দেবী সর্বদা সচেষ্ট থাকার চেষ্টা করলেন। তিনি নিজে সুযোগ পেলেই ইরাকে গান শোনাতে শুরু করলেন। বোন নীরাও একই কাজ করতে লাগলো। বাড়িতে সবসময় একটা গানের পরিবেশ তৈরি করলেন মা মীরা দেবী আর বোন নীরা। একজন মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার মানসিক অবস্থাও যখন একেবারে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে , তখন তার সবচেয়ে কাছের মানুষের উচিৎ তাকে সঙ্গ দেওয়া , সেই মানুষটির পছন্দের কাজগুলো করা। অসুস্থ মানুষটি যাতে মনের দিক থেকে খুব ভালো থাকে , মনে যাতে জোর পায় এবং সেই ধরনের কাজ যা তার অসুস্থতাকেও কমিয়ে দেয় , সেইসবই করা দরকার। যা এখানে মীরা দেবী আর তার ছোট মেয়ে করে দেখালো ! প্রত্যেক মানুষেরই কিছু ভালোবাসার বিষয় আছে। কোনো একজনের যদি সেই ভালোবাসার জায়গায় কোনোরকম আঘাত লাগে , তবে তার মনোবল ভেঙে যায়। তার নিজের লোকেদের উচিৎ সেই মানুষটির ভালোবাসার বিষয়টি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে তার মনে স্বস্তি এনে দেওয়া। এই কাজটি একমাত্র সেই মানুষটির আপনজনরাই করতে পারে । যা এই কাহিনীর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে।
ইরা আস্তে আস্তে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলো। কোনোদিনই আর গান করতে পারবে না বলে যা সে একদিন ভেবেছিল , বছরখানেকের মধ্যে সেই বাধা কাটিয়ে আবার সে সঙ্গীত জগতে ফেরার চেষ্টা করলো। সে আবার নিজের জগতে ফিরে যাওয়ায় , তার বাড়ির লোক ও চেনা - পরিচিত সবাই খুব ই খুশি হল এবং তাকে আবার সাদরে সবাই গ্রহণ করলো। নিজের চেনা জগতে ফিরে গিয়ে ইরাও আবার আগের মত আনন্দিত হলো।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে তার আপনজনদের ভূমিকা বিরাট থাকে। নিজের লোক বিপদে পড়লে আপনজনরা যদি এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ায় তবে অতি সহজেই কেউ বিপদমুক্ত হতে পারে। আজকের এই করোনা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যেখানে একেকটা পরিবার রিক্ত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ! সেখানে আপনজনদের উচিৎ দ্বিধা - দ্বন্দ্ব ভুলে কাছের মানুষের পাশে দাঁড়ানো।