ভালবাসা কারে কয় : সায়ন্তনী দাস ধর


  

         সুরেশ হঠাৎ এসে হিরের নেকলেস পরিয়ে দেয় মোহিনীকে। চমকে ওঠে মোহিনী। নেকলেসটা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় সে," ডার্লিং, এত দামি নেকলেস আমার জন্য!!! আমার কত দিনের শখ......" সুরেশ তার কথা বন্ধ করে দেয়, দুজনেই ভেসে যায় সুখের সাগরে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুরেশ বলে," আমার প্রিয়তমার পছন্দ হয়েছে, আর আমি তা হাজির করেছি। আজ যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে।" মনে মনে ভাবে মোহিনী, এত সুখ তার কপালে ছিল! পড়াশোনায় খুব একটা ভাল ছিল না সে। কিন্তু রূপের জোরে এই ধনী পরিবারে বিয়ে হয়েছে তার। ধীরে ধীরে শ্বশুরবাড়ির আদবকায়দা রপ্ত করেছে সে। সুরেশ স্বামী হিসেবে ভালোই। হ্যাঁ, স্বাধীনতা একটু কম এখানে, তাতে কি? যত্তসব!  কি করবে সে ঐসব স্বাধীনতা নিয়ে! ভালো ভালো খাবার, গয়না, শাড়ি- কিছুরই অভাব রাখে না সুরেশ। বছরে দু তিনবার বিদেশ ভ্রমণ, জন্মদিন ও বিবাহবার্ষিকীতে বিশাল পার্টি- জীবনে আর কি চাই! 


            মোহিনী খুশির আতিশয্যে ফোন করে তার বোন সোহিনীকে," কি রে, আজ কি দিল তন্ময় তোকে?" বরের অফিস, মেয়ের ইস্কুল- সকালবেলায় হিমসিম খাচ্ছিল সোহিনী, "তোকে পরে ফোন করছি......" বলে তখনকার মত নিস্তার পেল সে। উফ্, পারেও বটে দিদি, এত জাহির করার স্বভাব! ঝটপট কাজ সারতে থাকে সে, কিন্তু মনটা সুরে আজ কিছুতেই বাজতে চায় না। বর, মেয়ে বেরিয়ে গেলে ক্লান্ত সোহিনী এক কাপ চা নিয়ে আরাম করে বসে বারান্দায়। অজান্তেই এক দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। সত্যিই, তার বরটা একদম বেরসিক। আজ যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে, না চাইলেও সোহিনীর মনে থাকে, কিন্তু তন্ময়ের ওসব বালাই নেই। নির্দিষ্ট দিনে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে, এতে তার ঘোর আপত্তি! শুধু কি তাই? সে তো বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিনও মনে রাখতে পারে না। অথচ, সুরেশ'দা প্রতিটি উপলক্ষ্য নিয়ম করে মনে রেখে সারপ্রাইজ দেয় দিদিকে। সোহিনী অবুঝ নয়, সে বোঝে যে তন্ময় এমনই। তার বরটি এমনিতে কিন্তু খুব ভাল। সংসারের দায়িত্ব সোহিনীর উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছে। মাসের শেষে মাইনেটা তার হাতে তুলে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত থাকে। মধ্যবিত্ত পরিবার তারা, দিদির মত অত সম্পত্তি নেই তাদের, কিন্তু আছে ভালবাসা, নির্ভরতা। তবুও, বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে মনটা খারাপ হয় বৈকি! আরও খারাপ লাগে যখন মোহিনী ফোন করে। ফোনটা আবার বাজছে। নির্ঘাত মোহিনীই করেছে। ধুর, ভাল লাগে না। "কি রে , ফোন করলি না তো? শোন না, তোর জাম্বু আজ হিরের নেকলেস দিয়েছে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষ্যে। কি পাগল লোক, বল! একবার খালি বলেছিলাম, আমার ইচ্ছের কথা, ব্যাস, এনে হাজির! তোকে কি দিল তন্ময়?" "তুই তো জানিস 'দি, 'ও অন্যরকম। এসব খুব একটা পছন্দ করে না।" সোহিনীর কথায় দুঃখ প্রকাশ করে মোহিনী, "সত্যিই, কি আর করবি, বল!" ভাল লাগছিল না আর কথা বলতে সোহিনীর। এটাসেটা অজুহাত দিয়ে ফোন কেটে দেয় সে। মনের মধ্যে রাগ দুঃখ জমাট বাঁধতে থাকে। সন্ধ্যেবেলায় অসহ্য মাথাব্যথায় কাতরাচ্ছিল সে। ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল। অন্ধকারেই অনুভব করল, তন্ময় তার কপালে অমৃতাঞ্জন লাগিয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল সোহিনী। রাতে মেয়ে এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে খেতে ডাকল। ধড়মড় করে উঠে বসে সোহিনী। এ বাবা! কিছুই তো রান্না করেনি সে! মাথা ব্যথাটা অবশ্য সেরে গেছে।  তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে যায় সে। অবাক হয়ে দেখে, বাবা মেয়েতে অপটু হাতে খাবার বানিয়ে ফেলেছে। টেবিলে সাজিয়েও রেখেছে। "ম্যাডাম, খাবার হাজির...." সকালের মনখারাপের রেশটা মিলিয়ে যেতে থাকে সোহিনীর, কি এক অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা ভরে যায়। কোন কাজই ওরা ওকে করতে দেয় না সেদিন। খাওয়াদাওয়ার পর ঠেলেঠুলে তাকে শুতে পাঠিয়ে দেয়। বাকি কাজ সব করে দেবে ওরা। সোহিনী মনে মনে ভাবে, এই তো আসল সুখ। 


             সেদিন সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পর অলস সময় কাটাচ্ছিল সোহিনী। এমন সময় মোহিনী ফোন করে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ফোনেই। ভয় পেয়ে যায় সোহিনী, "কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? আমাকে বল, দিদি....." নিজেকে কিছুটা সামলে বলতে থাকে মোহিনী, "তোর জাম্বুর যে এই রূপ দেখতে হবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি।" অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে সোহিনীর। একটু দম নিয়ে বলতে থাকে মোহিনী, "সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। দেখি, পাশে তোর জাম্বু নেই। খুঁজে দেখতে গিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে তোর জাম্বুর গলার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে গিয়েছিলাম। শুনলাম, ফোনে কার সঙ্গে যেন খুব ভালবেসে কথা বলছে। এমন এমন কথা বলছিল, লজ্জায় আমার কানে আঙুল চাপা দিতে ইচ্ছে করছিল। আমি ঘরে ফিরে যাই। বেশ কিছুক্ষণ পর ঘরে এসে আমাকে জেগে থাকতে দেখে চমকে উঠেছিল 'ও। আমি সরাসরি প্রশ্ন করি ফোনের ব্যাপারে। প্রথমটায় স্বীকার না করলেও আমার চাপের কাছে হার মানে 'ও। হ্যাঁ, একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে ওর। কিন্তু অদ্ভুত কথা কি জানিস, সোহিনী? সেটা নিয়ে ওর কোন অপরাধবোধ নেই! বড় গলায় আবার বলছে, 'তোমার সংসার তোমারই থাকবে, আমি সংসার ভাঙব না।' কি ভাবে ও নিজেকে? আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব!" সোহিনী বলে, "সেরকম হলে বেরিয়ে আয় তুই সংসার থেকে, দিদি। আত্মসম্মানের থেকে বড় কিছু নেই।" "কি বলছিস তুই? আমি এত সহজে সবকিছু ছেড়ে দেব? কক্ষনো নয়। ঐ শাকচুন্নিকে কি করে ঘাড় থেকে নামাতে হয়, জানা আছে আমার ....." ফুঁসে ওঠে মোহিনী। আরও কতকিছু বলে যায় সে। কিছু কথা কানে ঢোকে, কিছু মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায় সোহিনীর। ফোন রেখে বসে বসে ভাবতে থাকে সে।


        নাঃ, আত্মসম্মানই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওটি বিসর্জন দিলে জীবনের আর কি-ই বা মূল্য! কপটতাপূর্ণ, মেকি, ভালবাসাহীন সংসারের কোন অর্থ নেই তার কাছে। হতে পারে তন্ময়ের ভালবাসার প্রকাশ কম, কিন্তু সে ভালবাসায় কোন খাদ নেই। যেটুকু অভিযোগ ছিল সোহিনীর মনে, আজ সবটুকু ভাসিয়ে দিল সে। এই বেশ ভাল আছে সোহিনী।

Post a Comment

Previous Post Next Post