" কি গো তোমার হলো ? এবার কিন্তু আমার সত্যি খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই বলতে বলতে রুদ্র ঘর থেকে বেরোতেই মা ডেকে বললেন তোর কি কথা শোনার সময় হবে ? কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো ! বলছিলাম তোর বাবার শরীরটা ভালো নেই। একটু ডাক্তার রায় কে খবর দিয়ে দিবি ? তোমাকে নম্বর দিয়ে দিচ্ছি তুমি ফোন করে নিও। আমার একদম সময় নেই , এই বলে সদর দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে আরেকবার হাঁক পারলো রুদ্র। এসে গেছি , এসে গেছি বলতে বলতে তিয়াশা এগিয়ে এলো। কি হয়েছে মা ? বাবা এখন কেমন আছেন ? জ্বর আর আসেনি তো ? না জ্বর আর আসেনি বৌমা। তবে কাশিটা একটুও কমেনি। তাই ডাক্তার রায় কে খবর দেওয়ার কথা বলছিলাম। ঠিক আছে মা , আমি খবর দিয়ে দেবো। আসি মা। সময়মত খেয়ে নিও। সাবধানে যেও বৌমা। এই বলে তিয়াশা বেরিয়ে যেতেই বাণীদেবী ভাবতে লাগলেন। নিজের ছেলে , তার সময় নেই বাবার খবর নেওয়ার। সে এত ব্যস্ত ! অথচ বৌমা সে তো পরের বাড়ির মেয়ে , দায়িত্ববোধের দিক থেকে অনেক ওপরে। ব্যস্ততায়ও সে আমার ছেলের থেকে ওপরে।" আসল ব্যাপার হলো , দায়িত্ব - কর্তব্য বোধ সবার থাকে না ! সে যতই ব্যস্ত হোক বা না হোক !
" তিমির বাবু সকাল থেকে মেয়েকে ফোনে পাচ্ছেন না দেখে খুব চিন্তিত হয়ে রয়েছেন। কারণ আজ তার ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার কথা। এদিকে ফোনে মেয়েকে না পেয়ে একাই যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে উনি যাবেন কি করে ? একা একা বেরোন না প্রায় অনেকদিন হলো ! তাই তো মেয়ে ঝুমির আসার কথা! কিন্তু কেনো যে সে এখনও এসে পৌঁচ্ছচ্ছে না , সেটাই তো তিমির বাবুর বুঝতে পারছেন না।আসলে ঝুমির ছোট থেকেই দায়িত্ব বোধ একটু কমই আছে। ওর স্বামী নীলাঞ্জন ব্যাংক ম্যানেজার হওয়া স্বত্বেও যখন যেখানে দরকার হয় ছুটে যায় , অথচ ঝুমি বাড়িতে থেকেও কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না ! আসল কারণ সেই একটাই , ব্যস্ত থেকে বা না থেকে ব্যস্ততার ভান করা।
পুজোর বাজার করতে যাবে বলে নীরা আজ নীল কে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলেছিল। সেইমত নীরা নিজে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে নিউ মার্কেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো সেই সন্ধ্যে সাতটা থেকে। রাত আটটা বেজে গেলো এখনও নীলের পাত্তা নেই। অনেকবার ফোন করেছে নীরা। অন্যবারের মতো এবারও যথারীতি নীল ভুলে গেছে। শেষবার ফোন ধরে নিজের ব্যস্ততার অজুহাত দিতেই নীরা সবটা বুঝতে পেরে লাইন কেটে দিল। রাতে বাড়ি ফিরে নানা অজুহাত দেখাতে থাকলো নীল। নীরা শুধু একটা কথাই বলে যে , " শোনো ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। আমিও কিন্তু তোমার মতন ই গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট এ কাজ করি। তারপরও যখন যেখানে যেরকম দরকার আমি চলে যাই। আর তুমি নিজের তৈরি করা অফিস , কাউকে কোনো জবাবদিহি দেওয়ার বালাই নেই , অথচ তুমি প্রয়োজনে সময় বার করে কোথাও যেতে পারো না। আসলে তুমি সবসময় নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে চাও ! এতে কিন্তু সবার কাছে মূল্য পাওয়া যায় না। বরং এতে মূল্যহীন হয়ে যেতে হয় , বুঝলে ? "
সকাল থেকেই নীপার মনটা ভালো নেই। সকাল হতেই মা ফোন করে বলেছে , " জানিস তোর বাবার কাল রাত থেকেই শরীরটা ঠিক নেই। প্রেসারটা বেড়েছে। আজ একবার আসবি , একটু ডাক্তার দেখিয়ে আনবো !" রবিবার হওয়াতে সুজিতও ঘরে। তাই ফোনটা রেখেই নীপা বলে উঠলো , " শুনছো , মা ফোন করেছিল , বললো বাবার শরীরটা ঠিক নেই। একবার যেতে বললো। চলো না যাই। নীপার কথাটা শেষ হতেই সুজিত বলে উঠলো , এখন তো হবে না। আমার অনেক পেন্ডিং কাজ আছে। বিকেলে চলো । এবেলা মাকে বলো একটু দেখে রাখতে। এটা তুমি কি বললে সুজিত ? মার পক্ষে সম্ভব ? আমরা গেলে বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আর তুমি বলছো বিকেলে যেতে ? কোনোকিছু হলেই তোমার এই ব্যস্ততার ভান করাটা বন্ধ করো। তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি থাকো তোমার পেন্ডিং কাজ নিয়ে !"
আমরা যারা কাজের নাম করে ব্যস্ততার ভান করি , তারা মনে হয় ভুলে যাই যে এতে সত্যিকারের কাজ করা মানুষগুলোকে অপমান , অসম্মান করা হয়। এমন অনেক মানুষ আছে যারা সত্যিকারের কাজ পাগল মানুষ। কাজকে তারা সম্মান করে। কখনও কোনো কাজকে অজুহাত হিসেবে খাঁড়া করে না। বরং যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও তারা নিজের নিজের নির্দিষ্ট কাজ সমাপ্ত করে। তাদের কাছে কাজ না করে ব্যস্ততার ভান করা বা যেকোনো পরিস্থিতিতে কাজকে অজুহাত হিসেবে দেখানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
পরিশেষে বলি , দায়িত্ব , কর্তব্যবোধকে সবার ওপরে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কাজের নামে অজুহাত না দেখিয়ে , সত্যিকারের ব্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। উন্নত জীব হিসেবে মানুষ যা গুণাগুণ অর্জন করেছে , সেগুলো কিছু অবিবেচক মানুষের জন্য মূল্যহীন হয়ে পড়বে , তা কখনোই হতে দেওয়া যায় না।