শীতের সূর্য ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে নেমে আসছে। পৃথিবীর প্রতি টি প্রাণ সজীবতার আনন্দে নতুনের সন্ধানে সকলেই অন্বেষণ রত। রুগ্ন বাতাসও উত্তরে সজোরে প্রবাহিত স্বচ্ছলতার অভিপ্রকাশে। ক্লান্ত জীবন গুলি একে একে ঝড়ে পড়ছে আত্ম গৌরবে। কেউ ভাবছে জীবনের কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাসেই শুরু করবে নতুন প্রশ্বাসের সৃষ্টি। মধ্যগগনে জীবনেরা সৃষ্টির নব উদ্যোগে এগিয়ে চলেছে।
"ধীরে ধীরে রামধনুর সাত রঙ ফ্যাকাশে হয়ে মিলিয়ে গেল। কিশোর তার ভালোবাসার কথা কখনও বলতে পারল না, বলতে পারার কথাও না। শহুরে মেয়ে। রূপে গুণে রূপবতী। যেন কাজল চোখের কোনো স্বর্গের দেবী। সে কি গরিবি চালচলনে বড় হওয়া কিশোরের বুকে বাসা বাঁধতে পারে!"
কিশোর। ইসলামপুর গ্রামের একমাত্র হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়ে জীবন শুরু করেছে। নিন্ম মধ্য পরিবারের সন্তান। পড়াশোনায় দারুণ মেধা। মা মরা ছেলেটিকে অভিরূপ মুখুজ্যে সর্বস্ব দিয়ে লালন পালন করেছেন। কিন্তু ঈশ্বর বিরূপ হয়ে মা মরা ছেলেটিকে একা করে অভিরূপ মুখুজ্যেকে বিপুল ফুল সম্ভার ও পত্র বাহারে শেষ শয্যা পেতে স্বর্গলোকে গমন করালেন।
প্রতিটি মানুষের মতো কিশোরও নিজের অস্বিত্ব টুকু টিকিয়ে রাখবার জন্য পড়াশোনার পাঠ শেষ করল। কোমল স্বভাবের ছেলেটি কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। নদীর তীরে বসা কবিতা লেখা ছেলেটি শোবার ঘরেও স্থির থাকে না। কত রকমের ভাবনা মনে গেঁথে রচিত কবিতা গুলি ঘরের এক তাকে সুসজ্জিত অবস্থায় থেকে থেকে অনেক সময় পেয়ে ধূলাভরনে আবৃত হয়ে যেন কিশোরের স্বপ্ন গুলি চিরতরে কবরের তলদেশে শায়িত করল। গাছ গাছালি পূর্ণ বাগানটিতে কিশোরকে অনেক দিন পর দুপুর বেলা বসে থাকতে দেখা গেল। দুচোখের স্বপ্ন গুলি বুকে নিয়ে জীবনের শেষ শক্তি টুকু দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে কিশোর শহরে চলে আসল।
অপরিচিত এক অন্য জগত। সেখানে কেউ তার আপন নয়। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য মানুষ দিনরাত ছুটে চলেছে। সকলেই মূল্যের জন্য দৌড়ায়। কিন্তু কিশোর তো স্বপ্নের জন্য দৌড়ায়। এই অপরিচিত জগতে কে তার স্বপ্নের মূল্য দেবে।
কিন্তু গ্রামেই তার কেই বা আপন ছিল। মা বাবা কবে ছেড়ে চলে গেছেন। আর যারা ছিল সুস্থ সবল ছেলেটিকে বোঝা ভেবে দূরে সরিয়ে দিল। কেউ একটি বারও কাঁধে হাত রেখে বলল না - আমি তোর পাশে আছি। মূল্য নয় মূল্যবোধ প্রয়োজন। উৎসাহ মানুষকে সাফল্যের অনেক কাছে পৌঁছে দেয়। কিন্তু কিশোর এসবের কিছুই পায়নি। কেউ তাকে ব্যর্থ বলেছে কেউ বা তাকে করুণা করেছে।
স্বাধীন একাকী চিত্তের ছেলেটি করুণা নেবে কি প্রকারে। রাত্রি জেগে দুচোখ ভরে দেখা স্বপ্ন গুলি নিয়ে কিশোর এখন কিশোর শহরের ছোটো একটি সংস্থায় কর্মরত। সেও বাঁচবার লড়াই করছে দিনরাত। তবুও এখন কিশোরকে একটু বেশি ভাবনাগ্ৰস্ত মনে হয়। শহরের কোনো বাবুর মেয়ের মন ধরেছে। মেয়েটির নাম স্মৃতি। সেও নাকি ভিন দেশের এক গাঁ থেকে এসেছে শহরে। অপরূপ রূপ-লাবণ্যে মেয়েটি সত্যিই অপ্সরা। তবে সকলের চোখেই ভালোলাগার দৃষ্টি ভঙ্গি ভিন্ন রকম। কেউ রাধা প্রেমী তো কেউ সীতা বিরহী। কিশোরের স্মৃতিকে হয়তো ভিন্ন চোখের ভঙ্গিতে অপ্সরা মনে হল।
প্রথম দিন স্মৃতিকে দেখেই কিশোরের হৃদয়ে যেন কোনো এক আন্দোলন ঘটে গেল। এত পরিচিত মুখ যেন এর আগে সে কখনও দেখেনি। সারারাত জেগে কিশোর মেয়েটির কথা ভাবতে লাগল। মেয়েটি তার সত্যিই পরিচিত নয় - তবুও খুব চেনা। চোখের দৃষ্টি যেন বারে বারে কিছু বলতে চায়। হয়তো কিশোরের সেই ছোটোবেলার স্বপ্নে দেখা নীল ওড়নায় গা ঢাকা দেওয়া রাজকন্যা। ক্রমে কিশোরের সঙ্গে স্মৃতির বন্ধুত্ব হল। কিশোর এতদিনে এমন এক বন্ধু পেল যা তার জীবনে অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল। মেয়েটি ও কোনো এক প্রাচীন বন্ধনে কিশোরের উপর অধিকার দেখাতে শুরু করল নাকি করুনা করল বোঝা গেল না।
স্মৃতিই প্রথম কিশোরের জীবনের মেঘগুলিকে জড়ো করে বৃষ্টি রূপে ঝড়িয়ে দিল। তাই কিশোর প্রথম সুন্দর জীবনের স্বল্প স্বাদ অনুভব করল। এই প্রথম কিশোর কাউকে পেল যার কোলে মাথা রেখে চির শান্তির প্রসাদ পেতে পারে। জীবনটাকে খুশি আর রঙীন করতে পারে। যার স্পর্শে জীবন রামধনুর সাত রঙে রঙিন হবে --- যা শুধু বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পূর্ণ।
ধীরে ধীরে রামধনুর সাত রঙ ফ্যাকাশে হয়ে মিলিয়ে গেল। কিশোর তার ভালোবাসার কথা কখনও বলতে পারল না, বলতে পারার কথাও না। শহুরে মেয়ে। রূপে গুণে রূপবতী। যেন কাজল চোখের কোনো স্বর্গের দেবী। সে কি গরিবি চালচলনে বড় হওয়া কিশোরের বুকে বাসা বাঁধতে পারে! ভালোবাসা সকলের জন্য নয়, শুধু করুণা ছিল ভেবে কিশোর সুপ্ত ভালোবাসাকে চোখের জল ঝড়িয়ে নষ্ট করে দিল।
চোখের জলে ভালোবাসা বেড়ে চলল। জীবনের অঙ্গীকার আর স্বপ্ন গুলি জেগে জেগে কিশোর কে আরও উদ্যমী করল তা পূরনের লক্ষ্যে। সেই কাজল কালো অচেনা-চেনা মুখটি কিছুতেই ভুলতে পারল না। কত বড় ঘরের মেয়ে - করুণা করতে পারে, ভালোবাসতে পারে না। এই ভেবে কিশোর উদ্যমী স্বপ্ন গুলি কে স্থির করে আপন মনে বসে রইল।
কিশোরের হৃদয়ে যে ভালোবাসা ছিল তা জীবন্ত শরীর থেকে যদি বের করে এনে দেখানো যেত তাহলে হয়তো স্মৃতির বিশ্বাস হতো। কিশোর শুধুই ভাবত যদি বুকটা ফেটে একবার তার ভালোবাসা আত্মপ্রকাশ করত তাহলে স্মৃতিকে ভালোবাসার কথা বলতে হতো না। তাকে সারাজীবনে একটি বার ও হারাবার যন্ত্রণা পেতে হতো না। ভালোবাসা যদি সত্যিই মনের মানুষকে খুঁজে না পায় তবে কিশোরের তো কিছুই করার নেই বিরহের যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া। সংকোচ তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। যদিও সে তার স্মৃতিকে কথা দিয়েছে সে অনেক বড় হবে, তার স্বপ্ন গুলি পূরণ করবে তবে আর ভালোবাসা কেন....।
অবশেষে স্মৃতির গাঁয়ের বাড়ি থেকে একটি চিঠি আসে। সামনের মাসেই তার বিবাহ স্থির হয়েছে। তাই তাকে বাড়ি ফিরে আসতে হবে। অবশেষে স্মৃতির ঘরে ফেরার দিন এল।
কিশোর স্মৃতিকে কত সাধ করে বলেছিল " আমি অনেক বড় হবো। আর তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো জানতে পারবে। আমার কাগজে নাম বেড়োবে।আমি সত্যিই অনেক বড় হবো। " আজ যেন তার কথা গুলি তাকে নিয়েই ঠাট্টা করতে লাগল। স্মৃতি চলে গেল। তবুও কিশোর একটি বার ভালোবাসার কথা বলল না। এসব হয়তো স্মৃতির মনে কখনো আসেনি। স্মৃতি, কিশোরের স্মৃতি হয়েই চলে গেল। চোখের জল দিয়ে কিশোর বুকের জ্বালাকে নেভাতে চেষ্টা করল। কেমন করেই বা তার চোখে এত জল এসে পরল বোঝা গেল না। স্মৃতি খুব ভালো, তার কত ভালো ঘরে বিয়ে হবে, ঢাকা বাজবে ঢোল বাজবে, নহবত বসবে। সবাই কত আনন্দ করবে। কিশোর স্মৃতির খুশি কে কাড়ল না। চিরদিনের মত সেই কাজল কালো চোখ দুটি দেখা শেষ করে কিশোর নিজেই বিদায় নিল।শুরুর আগেই সব শেষ হয়ে গেল।
স্মৃতি বাড়ি ফিরে এসেছে। শহরে মেয়ের গ্রাম্য জীবন। কিশোর, স্মৃতির গ্রাম্য জীবনের কিছুই জানত না। শুধু অচেনা জগত টাকে নিয়ে কল্পনায় অনুভব করত। হয়তো স্মৃতির হৃদয়েও ভালোবাসা ছিল কোনো এক বড় ঘরের রাজপুত্রের জন্য।
লক্ষ্য বা স্বপ্ন উঁচু হওয়ায় শ্রেয়। ভালোবাসা পাবার জন্যে সুন্দর একটি মনের প্রয়োজন। যে ভালোবাসতে জানে সেই ভালোবাসা পেয়ে থাকে। সুন্দর এর পূজারী সকলেই। সুন্দর ও অতি সুন্দরের পূজারী। স্বল্প বাধা হয়ে কিশোর স্মৃতির জীবনে থাকল না। উদ্যমী মনটাকে চিরতরে কবরে শুইয়ে রাখল।
মাঠময় খেলে বেড়ানো মেয়েটি সত্যিই শহরে গিয়ে কত বদলে গেছে। বিবাহ হয়ে গেল স্মৃতির কোনো এক রাজপুত্রের সঙ্গে। একটি মিষ্টি কন্যার জন্ম দিল। তবে স্মৃতির প্রয়োজন না থাকলেও তার কপালেই কিশোর কে একবার দেখার সুযোগ আসল। দৈনিক সংবাদপত্রে ছোটো একটি কলমে বেড়িয়েছে----- এক পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কিশোর মুখার্জি নামে এক যুবকের......। এক মালবাহী গাড়ি তার বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে। উচ্ছিষ্ট পদার্থের মত হৃদয় টি আজ পথের মাঝে পড়ে আছে। আজও যদি স্মৃতি একবার এসে সেই হৃদয়ের শব্দটি শুনত যার প্রতিটি ধ্বনি "স্মৃতি স্মৃতি" বলত। স্মৃতি এসবের কিছুই বুঝল না।
কিশোর সত্যিই অনেক বড় হয়েছিল, কাগজে তার নাম বেড়িয়েছে।
(প্রথম প্রকাশ ২০১৩)


